বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

মানবাধিকার ও ইসলাম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ২৩ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০২ এএম

ক. মানবাধিকারের এই উচ্চকণ্ঠের যুগে পরিবার- ব্যবস্থা ক্রমশ যেখানে দুর্বল হয়ে পড়ছে নগরায়ণ ও শহরায়নের পাশাপাশি লাগামহীন ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পরিবারের নির্ভরশীল সদস্য বিশেষত শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও অন্যান্যদের প্রতি ক্রমশ নিরাপত্তাহীনতা, অধিকার না পাওয়ার ও লাঞ্ছনার আশংকা বাড়ছে। অথচ রাসূল সা. দৃঢ়ভাবে পারিবারিক দায়িত্ব পালনে তাগিত দিয়েছেন। কুরআনে পিতা-মাতার সাথে সন্তানের সম্পর্ক ও দায়িত্বের কথা স্পষ্ট ঘোষণা করে বলা হয়েছে- “তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে ‘উফ’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বলবে। “আল-কুরআন, ১৭ : ২৩”।
খ. মুহাম্মদ সা. নিজ মা-বাবার সম্মান-মর্যাদা ও পরিবারে তাদের অধিকার রক্ষার বিষয়টি কুরআনের নির্দেশনার আলোকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি বলতেন, পিতা-মাতার সন্তুষ্টি ব্যতীত বেহেশতের দ্বার উন্মুক্ত হবে না। “যফীরুদ্দীন পুরানুহাভী, মাওলানা মুহাম্মদ, ইসলামের যৌন বিধান, মাওলানা মুহাম্মদ হাসান রহমতী অনূদিত, ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮৭, পৃ. ২৭”। নিজের পরিবারে যিনি সততা, ন্যায়পরায়ণতা, দায়িত্ববোধ ও সকল সদস্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না তিনি যতই জগৎ জয় করুন, শ্রেষ্ঠ মানুষ হতে পারবেন না- এটিই মহানবী সা. এর জীবন দর্শন। অন্যদিকে তাঁর মতে পরিবারে স্ত্রীর মর্যাদাও অনেক উঁচুতে। তিনি বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে তারাই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ব্যক্তি যারা তাদের স্ত্রীদের কাছে উৎকৃষ্ট এবং পরিবার পরিজনদের সাথে স্নেহশীল ব্যবহার করে”। “আসমা, খাতুন হাফেজা, নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মহানবী সা. সীরাত স্মরণিকা, ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৪১৫, পৃ. ৫১”। তাঁর যুগে এই কথা বলা ও পরিবারে তার অনুশীলন করা ছিল অত্যন্ত কঠিন এবং যুগান্তকারী এক পদক্ষেপ।
৫। বৃহত্তর সমাজ-জীবনে শান্তি, সাম্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠা : মুহাম্মদ সা. নিজ পরিবার, আত্মীয়-স্বজনের পর দৃঢ়ভাবে প্রতিবেশীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। মেহমানদের অধিকারও তিনি নির্ধারিত করেছেন। তাঁর মতে “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষদিনে ঈমান রাখে, সে যেন অবশ্যই মেহমানদের সম্মান করে, প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয় এবং অবশ্যই ভাল কথা বলে অথবা চুপ থাকে। “বুখারী, ইমাম, আস-সহীহ, অধ্যায় : আল-আদাব, অনুচ্ছেদ : মান কানা ইউমিনু বিল্লাহি ওয়াল ইয়াউমিল আখিরি, আল-কুতুবুস সিত্তাহ, রিয়াদ : দারুল সালাম, ২০০০, পৃ. ৫০৯”।
৬। অসহায়-বঞ্চিত ইয়াতীম ও বিধবাদের অধিকার : মুহাম্মদ সা. সমাজে ইয়াতীম, বিধবা অসহায়দের অধিকার রক্ষার ও তাদের কল্যাণে সারা জীবন কাজ করে গেছেন এবং অন্যকেও তেমনি দায়িত্ব পালনের তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন : ক্ষুধার্তকে খাবার দিও, পীড়ত ও রুগ্নকে দেখতে যেও এবং মুসলমান হোক কি অমুসলমান, সকল নির্যাতিত মানুষকে সাহায্য করো। “ইসলাম, মাওলানা আমিনুল, মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মহানবী সা. ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮৭, পৃ. ৭”। ইয়াতীমের তত্ত্বাবধানকে উৎসাহিত করতে তিনি বলেছেন- আমি এবং ইয়াতীমের তত্ত্বাবধানকারী বেহেশতে এভাবে থাকবে। তিনি আরো বলেছেন- বিধবা এবং গরীব-মিসকীনদের সাহায্য-সহায়তার চেষ্টা সাধনকারী, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী অথবা দিনভর রোযা ও রাতভর নামায আদায়কারীর অনুরূপ। এ হাদীসটিতে দেখা যায়, অপরিহার্য ‘ইবাদত এর সাথে গরীব-মিসকীন ও বিধবাদের সাহায্য ও সেবাদান করাকে সমতুল্য ঘোষণা করে তাদের অধিকার আদায়ের পথ সুপ্রশস্ত করেছেন। মানবতার মুক্তিদূত মুহাম্মদ সা. ইয়াতীম, অসহায়দের সম্পদ হরণ করাকে তিনি কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন- ‘ইয়াতীমদের সম্পদ আত্মসাৎ করা মানুষের ইহকাল ও পরকাল ধ্বংসকারী পাপের মধ্যে গণ্য হবে।’ “ ইসলাম, মাওলানা আমিনুল, মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মহানবী সা. প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৬”। রাগ বা ক্রোধ যা প্রায়শই আমাদের সমাজ জীবনে অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাকে তিনি সর্বান্ত কারণে দমন করতে বলেছেন। এভাবে পরনিন্দা, পরচর্চা, কুৎসা রটনা, চুরি এমনকি অযথা সন্দেহ করাকেও নিষিদ্দ করেছেন তিনি।
৭। শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী সা. : ইসলাম কল্যাণময় জীবন বিধান। মানব জীবনের সকল স্তর ও সকল বয়সের জন্য শান্তি ও কল্যাণের পথনির্দেশ ইসলামে বিদ্যমান। মানবজীবনের মূলভিত্তি হল শৈশবকাল। তাই ইসলাম শৈশবের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছে। শিশু সন্তানের গুরুত্বারোপে আল-কুরআনের ভাষ্য হচ্ছে- ‘ধন-ঐশ্বর্য ও শিশু সন্তান পার্থিব জীবনের শোভা’। “আল-কুরআন, ১৮ : ৪৬”।
শিশুর খাওয়া দাওয়ার পাশাপাশি শিশুকে জাগতিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক, পারিপার্শ্বিক, শিষ্টাচার, আক্বীকা, খতনা, সুন্দর একটি নাম নির্ধারণ, পরিস্কার- পরিচ্ছন্নতার শিক্ষায় উজ্জীবিত করা প্রতিটি পিতামাতার অন্যত দায়িত্ব। নবী স. বলেন, ‘কারো সন্তান জন্মগ্রহণ করলে সে যেন একটি সুন্দর নাম রাখে এবং উত্তমরূপে তাকে আদব-কায়দা, শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়।’ “সম্পাদনা পরিষদ, দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ২০০৮, পৃ. ১৫৯”।
উপসংহার : বর্তমানে জাতিসংঘের The Universal Declaration of Human Rights- এর উপস্থিতি সত্তে¡ও বিশ্বের প্রায় ছয়শ কোটিরও অধিক মানুষ আজ চরম ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, বেকারত্ব, নাগরিক অধিকার দলন, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ইত্যাদির যাঁতাকালে প্রি হচ্ছে। দেশে-দেশে জনপদে আজ ঐক্যবিধ্বংসী সন্ত্রাস, হত্যা-রাহাজানি, মারামারি-হানাহানি, নৈরাজ্য, যুদ্ধের বিভীষিকা, তথাকথিত মানবাধিকারে ধ্বজাধারীদের ব্যবহার মানবতাবিধ্বংসী অত্যাধুনিক মারণান্ত্রেস কবলে আজ সারাবিশ্ব চরম হুমকীর সম্মুখীন। বস্তুত আল্লাহ প্রদত্ত এবং রাসূল সা. প্রদর্শিত মানবাধিকারের আদর্শই কেবল বিশ্বমানবতার সামগ্রিক কল্যাণ, মুক্তি ও সফলতা সর্বজনীনভাবে নিশ্চিত করতে পারে। ইসলামের সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থার আলোকে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব বিনির্মাণের পথে ঐক্যবদ্ধ ঈমানী প্রতিজ্ঞা-প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে আসা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হবে বিশ্বের প্রতিটি বনী আদমের মানবাধিকার ততো তাড়াতাড়ি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন