শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

এত ব্যর্থতা সত্ত্বেও জাতিসংঘের মতো বিশ্বসংস্থার প্রয়োজন আছে

আমজাদ হোসেন | প্রকাশের সময় : ২৪ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০২ এএম

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান এবং সেই সঙ্গে বিশ্বশান্তি রক্ষার জন্য ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ২৮ এপ্রিল মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনের ঘোষিত ‘চৌদ্দ দফা’ দাবির ভিত্তিতে লিগ অফ নেশনস প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বিশ্বসংস্থা শান্তিপূর্ণ উপায়ে কয়েকটি আন্তর্জাতিক বিরোধ মিমাংসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তবে এ সংস্থার ব্যর্থতার জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের বিপর্যয় ঘটে এবং ফ্যাসিবাদী ও নাৎসিবাদী একনায়কতন্ত্রের উত্থান হয়, ফলে বিশ্ববাসী আরও একটি ভয়াবহ ও নৃশংস বিশ্বযুদ্ধের সম্মুখীন হয়।

মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সন্ধির শর্তাবলির মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল। পরবর্তীতে বৃহৎ শক্তিবর্গ নিজেরাই জাতিপুঞ্জের আরোপিত চুক্তিগুলি অমান্য করতে থাকে। হিটলারের ভার্সাই চুক্তি লঙ্ঘন করে অস্ত্রসজ্জা, অস্ট্রিয়া ও চেকোশ্লোভাকিয়া জয়, রাইন অঞ্চলে জার্মান বাহিনী মোতায়েন প্রভৃতি জঙ্গি কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে থাকেন। মুখে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বললেও শক্তিশালী জাতিসমূহ পরস্পর অস্ত্র প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। জার্মানি, ইতালি, জাপান একের পর এক আগ্রাসী পদক্ষেপ নিলে জাতিপুঞ্জ তাদের নিরস্ত করতে ব্যর্থ হয়। জার্মানি ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে চেকোশ্লোভাকিয়া এবং ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে পোল্যান্ড আক্রমণ করলে জাতিপুঞ্জ নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলার পরে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ ও অশান্তি দূর করার জন্য বিশ্ব নেতাদের নানা প্রচেষ্টায় এবং গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয় জাতিসংঘ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী শক্তিবর্গ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন, চীন এবং ফ্রান্স এই জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্যেক্তা। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আইন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন এবং মানবাধিকার বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করা। জাতিসংঘ সনদের মূল কথা, সকল রাষ্ট্রের প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গি, সকল রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। কেউ অন্য রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের উপর হস্তক্ষেপ করবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নৃশংসতায় সারা পৃথিবী নির্বাক হয়ে গিয়েছিল। মানবসভ্যতা হুমকির মুখে পড়ে গিয়েছিল পারমাণবিক হামলায়। সেই মুহূর্তে জাতিসংঘের ঘোষণা পৃথিবীর মানুষকে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার নতুন করে স্বপ্ন দেখায়।

১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের উদ্যোগে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। ১৯৫০ সালে সৃষ্ট কোরিয়া সঙ্কট, ১৯৫৬ সালে সৃষ্ট সুয়েজ সঙ্কট এবং কঙ্গো ও সাইপ্রাস সঙ্কট নিরসনে জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা পালন করে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করায় ১৯৮৮ সালে এ বাহিনীকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। এছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণ ও নিরস্ত্রীকরণে জাতিসংঘের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সিয়েরা লিয়নের গৃহযুদ্ধ বন্ধ, সুদানের স্বাধীনতা ও ইন্দোনেশিয়ার একটি খ্রিস্টান অধ্যুষিত অঞ্চল-পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতা ছাড়া সংঘাত নিরসনে জাতিসংঘের উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা নেই। বছরের পর বছর ধরে সিরিয়া ও ইয়েমেনে ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। বিশ্বের পরাশক্তিগুলো তাদের ক্ষমতার দাপট দেখাতে গিয়ে এই দুটি দেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে। সিরিয়ার যুদ্ধে এখন পর্যন্ত কয়েক লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। বাস্তুহারা হয়ে অভিবাসী হয়েছে কোটি মানুষ। তুরস্কের সমুদ্রসৈকতে ভেসে আসা সিরীয় শিশু আয়লান কুর্দির ছোট নিথর দেহের ছবি আমাদের মনে করিয়ে দেয় অভিবাসী-সংকট মোকাবেলায় জাতিসংঘ চরম মাত্রার ব্যর্থ একটি প্রতিষ্ঠান। সিরিয়ার ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে জাতিসংঘের একচোখা আচরণ স্পষ্ট। অন্যদিকে গরিব দেশ ইয়েমেনও রক্ষা পায়নি বিশ্বদানবদের হাত থেকে। তাদের অসহায় শিশুদের কান্নার আওয়াজ জাতিসংঘ শুনতে পায় না। লেবানন সঙ্কট নিরসনে শুধু শান্তিরক্ষী বাহিনী গঠন করেই জাতিসংঘ তার দায়িত্ব শেষ করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে বিদ্যমান সংকট নিরসনে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ জাতিসংঘ নেয়নি। বসনিয়ায় সার্ব বাহিনীর পৃথিবীর ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা, চেচনিয়া গণহত্যা, রুয়ান্ডার হুতি কর্তৃক তুতশীদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ, ফিলিস্তিন ও ইরান সংঘর্ষে নির্লজ্জভাবে ইসরাইলকে সমর্থন করা, কাশ্মির সঙ্কট গণভোটের মাধ্যমে সমাধান করার কথা থাকলেও তা এখনো করতে পারেনি। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠার পর থেকে পৃথিবীর অনেক বড় সঙ্কটে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেনি জাতিসংঘ। বসনিয়ার সেব্রেনিতসায় সারা বিশ্বের সামনে গণহত্যা পরিচালনা করল সার্বরা। জাতিসংঘ নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলো। অভিযোগ রয়েছে, জাতিসংঘর শান্তিরক্ষী বাহিনী সার্ব বাহিনীকে জ্বালানি তেল দিয়ে সহায়তা করেছিল। এখন আবার সেই সার্বদেরই ধরে ধরে সাজা দেওয়া হচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য। সিভিলিয়ানদের রক্ষা ও গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র ধ্বংসের নামে ইরাকে, সোমালিয়ায় যুদ্ধের আয়োজন করে দিয়েছে জাতিসংঘ। ন্যাটো জোটকে বিশ্বের যত্রতত্র যুদ্ধের বৈধতাও দিয়েছে জাতিসংঘ।

চোখের সামনে ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হলো। অসহায় ফিলিস্তিন জাতির জমি দখল করে বসতি স্থাপন করছে ইসরাইল আর ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমি থেকে তাদের বিতাড়িত করছে। ইসরাইলকে প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন করছে জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিনিয়ত ইসরাইল ফিলিস্তিনের গাজায় বোমা নিক্ষেপ করছে, তাদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের অবরুদ্ধ করছে, তাদের সন্তানদের পঙ্গু করে দিচ্ছে। ফিলিস্তিন মা-বোনরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। অথচ এ বিষয়ে জাতিসংঘের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ বিশ্ব দেখেনি। মিয়ানমার রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর গণহত্যা চালিয়েছে। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে জাতিগতভাবে নিধনের চেষ্টা করেছে। তাদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। জাতিসংঘ যাকে জাতিগত নিধনের টেক্সটবুক উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এরপরও নিরাপত্তা পরিষদ কোনো ধরনের রেজ্যুলেশন গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের নিরপেক্ষ ভূমিকার কথা থাকলেও তা কখনই পালন করতে পারেনি। মিয়ানমার কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তখন শুধু মানবিক দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার সীমান্ত খুলে দিয়েছিল তাদের জীবন রক্ষার স্বার্থে। অথচ, আজ এতদিন পার হয়ে গেলেও জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে।

ভারতের কাশ্মির রাজ্যে দিনের পর দিন মুসলিম জাতি নির্যাতনের স্বীকার হয়ে আসছে। নিয়মিত তাদের ওপর হামলা, মামলা, অত্যাচার করা হচ্ছে। সেখানকার তরুণীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। তাদের রাজনৈতিক নেতাদের অবৈধভাবে বন্দি করে রাখা হয়েছে। সর্বশেষ সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করে কাশ্মিরিদের অধিকার খর্ব করেছে ভারত সরকার। দেশে দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সন্ত্রাসবাদ আশংকাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। বিশ্বের একতার প্রতীক জাতিসংঘ এই সন্ত্রাসবাদের মূল কারণ উদঘাটন করে তার সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্বে মার্কিনিদের আধিপত্য যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে। তাদের অস্ত্রের সামনে পুরো বিশ্বকে মাথা ঝুঁকিয়ে রাখতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজেদের স্বার্থে একের পর এক শান্তিপূর্ণ দেশকে অশান্ত করে তুলছে, তাদের অস্ত্রের ঝনঝনানিতে পুরো মধ্যপ্রাচ্য কাঁপছে। ইরাক ও আফগানিস্তানে একতরফা মার্কিন হামলায় জাতিসংঘ দর্শকের ভূমিকা ছাড়া কিছুই করতে পারেনি।

এত ব্যর্থতার পরও জাতিসংঘের মতো একটি সংস্থা থাকার আবশ্যকতা অস্বীকার করা যায় না। জাতিসংঘের ব্যর্থতার একটি বড় কারণ হলো, বৃহৎ শক্তিবর্গের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া। এদের ক্রীড়নক হওয়া থেকে তাই জাতিসংঘের মুক্ত হতে হবে। বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহের আগ্রাসন ও যুদ্ধ থেকে ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্রসমূহের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করতে হবে, নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে। ইরাক, আফগানিস্তানসহ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, কাশ্মির, ফিলিস্তিনসহ পরাধীন দেশসমূহের অধিকার ও স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। অন্যান্য সংকট নিরসনেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে।
লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন