শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলমানদের নিয়ে পশ্চিমাদের পুরনো নীলনকশার পুনরাবৃত্তি

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২৮ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০১ এএম

ভোগবাদী নীতির উপর ভর করে বেড়ে ওঠা পুঁজিবাদের চরম বিকাশ এবং কর্পোরেট রাজনৈতিক লুণ্ঠনের পথ ধরে সারাবিশ্বে মানবিক সত্ত্বা চরম অবক্ষয়ের শিকার হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে শিল্পোন্নত ও ধনী জাতি থেকে শুরু করে তৃতীয় বিশ্বের হতদরিদ্র দেশগুলো পর্যন্ত অভূতপূর্ব এক সামাজিক, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবক্ষয় ও অনিশ্চয়তার নিগড়ে নিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে। এ থেকে উত্তরণের পথ জানা না থাকায় দেশে দেশে সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও চিরায়ত মূল্যবোধ যেন ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছে। মূলত পরাশক্তি বলে কথিত রাষ্ট্রশক্তিগুলো ঔপনিবেশিক লুণ্ঠন ও শোষণের মধ্য দিয়ে যে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটিয়েছিল তা ধরে রাখার অব্যাহত প্রতিযোগিতা থেকেই এখনকার দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক তৎপরতার বিকাশ সূচিত হয়েছিল। গত দুই হাজার বছরের মধ্যে বিশ্ব যে সামাজিক, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে, তার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকায় ইসলাম ধর্মের বিস্তার এবং রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। খৃষ্টীয় সপ্তম শতকে ইসলামের আর্বিভাবের বহু আগেই প্রতিকুল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইহুদিরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিতাড়িত ও অনাবাসী হয়ে রাশিয়া, ইউরোপসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে তাদের সংখ্যা কখনোই কোনো দেশের পুরো সমাজের প্রতিনিধিত্ব করার মত সংখ্যাগরিষ্ঠ বা মূল প্রভাবক শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি। এ কারণে গত আড়াই হাজার বছরেও ইহুদিরা নিজেদের কোনো রাষ্ট্র কায়েম করতে পারেনি। অন্যদিকে গত দেড় হাজার বছরে বিশ্বে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। জনসংখ্যা এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিশ্বে মুসলমানদের অবস্থান প্রাচীন পৌত্তলিক ও আব্রাহামিক অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য বহু আগেই ঈর্ষা ও অসূয়া আশঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইউরোপীয়দের ক্রুসেড থেকে শুরু করে একবিংশ শতকের একেবারে শুরুতে সূচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বুশ প্রশাসনের নেতৃত্বে তথাকথিত ওয়ার অন টেররিজম, ইসলামোফোবিয়া ও এন্টি মুসলিম হেইট ক্রাইমের মাধ্যমে ইসলামের অব্যাহত প্রভাব বিস্তারের অনিবার্যতা রোধ করা যায় নি। একদিকে পুঁজি ও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের কারসাজি অন্যদিকে ননওয়েস্টার্ন ও মুসলমানদের সম্পদ এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার চাবিকাঠি নিজেদের হাতে কুক্ষিগত রাখতে গত কয়েক শতাব্দী ধরে পারস্পরিক স্বার্থে সমন্বিত একটি গোপণ ষড়যন্ত্র সর্বদা সক্রিয় রয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যের মরুময় ঊষর ভূমি মানব সভ্যতা ও প্রধান ধর্মগুলোর উদ্ভব ও বিকাশের সক্রিয় সাক্ষী হয়ে আছে। আব্রাহামিক ধর্মগ্রন্থ ও জুদাইজম ও ক্রিশ্চানিটির চরম অধঃপতিত অবস্থায় ইসলাম বিশ্বের জন্য এক অভাবনীয় রেঁনেসা ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণ মানুষের উপর শাসক ও শক্তিমানের শোষণ-বঞ্চনা ও লুন্ঠনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিপরীতে ইসলাম যে মৈত্রী সহমর্মিতা ও সাম্যবাদের ঘোষণা দিয়েছে, তা বৈষম্যহীন ও শোষণহীন সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মুসলমান খলিফাদের জন্য এক অলৌকিক জিয়নকাঠি হয়ে উঠেছিল। খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতকে শেষ ক্রুসেডে মুসলমানদের জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের মধ্য দিয়ে ইউরেশিয়ায় যে নতুন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল, তা মোকাবেলায় নিজেদের হাতে কোনো বিকল্প রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক গাইডলাইন পশ্চিমাদের হাতে ছিল না বলেই ওসমানীয় সুলতানরা সাতশ বছর ধরে ইউরোপ-এশিয়ার বিশাল অঞ্চলের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। গত একশ বছরে মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়া-আফ্রিকার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ইতিহাসের বিবর্তন লক্ষ্য করলে সহজেই বোঝা যায়, ইউরোপীয়দের ঔপনিবেশিক ম্যান্ডেট এবং বিশ্বযুদ্ধোত্তর পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অধীনে কিভাবে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ তাদের মৌলিক রাজনৈতিক অধিকারের বুনিয়াদগুলো হারিয়ে ফেলেছে। প্রথম মহাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অটোমান সাম্প্রাজ্যের পতন ও ষড়যন্ত্রমূলক ভাগাভাগির পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো আর কখনোই আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে নতুন নতুন প্রযুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ লব্ধ হয়েছিল তার প্রধান লক্ষ্য ও মনোযোগ র্ছিল পুঁজির উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ও লুণ্ঠন ব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করে তোলা। গণতন্ত্রের লেবাসধারি পশ্চিমারা দেশে দেশে স্বৈরতন্ত্র, সামরিকতন্ত্র এবং রাজাদের একচ্ছত্র ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়ে মূলত জনগণের সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ জারি রেখেছে।

সারায়েভোর ট্রেন স্টেশনে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান রাজপুত্র আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ আততায়ীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯১৪ সালের ২৮ জুন। এর মাত্র ৬ বছর আগে ভারতের স্বাধীনতাকামী আন্দোলনের কর্মী খুদিরাম বসুকে বৃটিশ ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে বইবোমা দিয়ে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে ফাঁসির দন্ড দেয়া হয়। প্রায় একই সময়ে সংঘটিত এ দু’টি ঘটনাই ছিল ঔপনিবেশিক ও আঞ্চলিক আধিপত্যবাদ ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মুক্তিকামী মানুষের সংক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ারই অংশ। আর্চডিউক ফার্দিনান্দকে হত্যার সাথে জড়িত ১৯ বছর বয়েসী গাব্রিলো প্রিন্সেপ ছিলেন সার্ব-যুগো¯øাব জাতীয়তাবাদী। এরা সার্বিয়ার উপর অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান দুঃশাসনের অবসানকল্পে বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করছিল। এই হত্যাকান্ডের ঘটনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করেছিল। সার্বিয়া-যুগোস্লোভিয়ার উপর অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যের বিষয়টা একটা আঞ্চলিক ইস্যু। এই ইস্যুতে সংঘটিত হত্যাকান্ড ও তার প্রতিক্রিয়ায় সংঘটিত বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপের কোটি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। তবে এই যুদ্ধের নীলনকশা ও ফলাফল ছিল ইউরোপীয়দের হাজার বছরের মুসলিম বিদ্বেষ এবং মুসলমানদের ভূ-খন্ড নিয়ে শত বছরের মহাপরিকল্পনার অংশ। সেই ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা থেকে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানরা এখনো বের হতে পারেনি। এখানকার জনগণের মধ্যে যে মুক্তির তীব্র আকাক্সক্ষা রয়েছে, বিগত দশকের প্রথমদিকে সংঘটিত আরব বসন্তের আন্দোলনে তা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেই জুজুর ভয়কে কাজে লাগিয়ে পশ্চিমা শাসকরা মধ্যপ্রাচ্যের রাজাদের কাছে হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি ও নিরাপত্তার নামে গোলামির চুক্তিতে আবদ্ধ করা হয়েছে। আরেকটু পিছিয়ে অবলোকন করলে দেখা যায়, প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১০১৪ সালের জুলাই মাসে। যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল চার বছর। তবে যুদ্ধের দ্বিতীয় বছরে বৃটিশ, ফরাসি ও ইতালিয়রা যুদ্ধশেষে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সম্পদ ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ভাগাভাগি নিয়ে একটি গোপন চুক্তিতে উপনীত হয়। রাশিয়াও প্রাথমিকভাবে এ চুক্তির একটি অংশ হলেও ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার আর এ চুক্তির অংশ থাকেনি। মূল পক্ষ হিসেবে দুই দেশের পক্ষে বৃটিশ রাজনীতিবিদ, আইনজ্ঞ ও মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ স্যার মার্ক সাইকস এবং ফরাসী কূটনীতিক ফ্রান্সিস জর্জ পাইকটের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুসারে বিশাল অটোমান সাম্প্রাজ্যভুক্ত দেশগুলোকে অক্যুপাইড এনিমি টেরিটরি বলে আখ্যায়িত করা হয়। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, যুদ্ধের ঘোষণা এবং অংশগ্রহণকারিদের মধ্যে ইউরোপীয়রাই মূল ভূমিকায় থাকলেও যুদ্ধশেষে শুধুমাত্র অটোমান শাসিত মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোকে শত্রæর ভূমি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সাইকস পাইকটের গোপণ চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার এক বছর পর যুদ্ধ শেষ হওয়ার এক বছর আগে ১৯১৭ সালে বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বালফোর বৃটিশ ইহুদিদের তার পক্ষে রাখতে ফিলিস্তিনের মাটিতে একটি স্বাধীন ইহুদি আবাসভূমি গড়ে তোলার প্রতিশ্রæতি দেয়া হয়। বালফোর ডিক্লারেশন নামে পরিচিত সেই রাজনৈতিক প্রতিশ্রæতিটি আজও মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব সংকটের কেন্দ্রভূমি।

বালফোর ডিক্লারেশনের শত বছর এবং ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠার সাত দশক পেরিয়ে এসে আরব-ইসরাইল সংকট যখন এক গভীর খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে, ঠিক তখন ফিলিস্তিনী আইনজীবীরা বালফোর ঘোষণার জন্য বৃটেনের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিয়েছে। ফিলিস্তিনের অধিকৃত ভূ-খন্ডের ৯৩ শতাংশ মুসলমান ফিলিস্তিনিকে নিজ ভিটামাটি থেকে বিতাড়িত করে অস্ত্রের জোরে ৭ ভাগ ইহুদির জন্য ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৮ সালে বালফোর ডিক্লারেশন বাস্তবায়ন করা হয়। এর পেছনে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের উপর ইঙ্গ-ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী চক্রের ভাগাভাগি ও লুন্ঠনের দীর্ঘস্থায়ী ষড়যন্ত্রের মহাপরিকল্পনা। গাল্ফ ওয়ার, ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, লেবাননে গত দুই দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যে একের পর এক যে যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, তার পেছনের কুশীলব হিসেবে বৃটিশ ও ফরাসীদের ভূমিকা দেখে সাইকস-পাইকটের সেই পুরনো চুক্তির বোঝাপড়ার কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। এখন মধ্যপ্রাচ্যের উপর পুরনো দখলদারিত্ব ও নতুন নতুন আঞ্চলিক সংকট ও অব্যাহত হুমকির পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল সরকারের যুগপত ভূমিকা দেখা গেলেও সব ক্ষেত্রেই নেপথ্য শক্তি হিসেবে বৃটেন এবং ফরাসীদের মধ্যে একটি নিবিড় বোঝাপড়া লক্ষ্য করা যায়। আপাত দৃশ্যে তারা নিজেদের আড়ালে রাখার চেষ্টা করলেও সময়মত তাদের দন্ত-নখর বেরিয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। মার্কিন ও জায়নবাদিশক্তির সমন্বিত তৎপরতার সাথে ইঙ্গ-ফরাসিরা নেপথ্যের অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ বুশ থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প আর বৃটেনে টনি বেøয়ার থেকে বরিস জনসন এবং ফরাসিদের জ্যাক শিরাক থেকে ইমানুয়েল ম্যাক্রো পর্যন্ত কি অদ্ভুত সমন্বয়! মধ্যপ্রাচ্য, তৃতীয় বিশ্ব ও মুসলমানদের যে কোনো বৃহত্তর প্রশ্নে তারা যেন হরিহর আত্মা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে শুধুমাত্র ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রকাশ্য আহম্মকির সাথে তাল মিলাতে পারছে না পশ্চিমা বিশ্ব।

আমাদের নজরুল লিখেছেন, ‘উহারা প্রচার করুক হিংসা বিদ্বেষ আর নিন্দাবাদ/ আমরা বলিব সাম্য শান্তি এক আল্লাহ জিন্দাবাদ/ ইহারা চাহুক সংকীর্ণতা পায়রার খোপ, ডোবার ক্লেদ/ আমরা চাহিব উদার আকাশ, নিত্য আলোক প্রেম অভেদ।’

আজকের বিশ্ব মুসলিমের সংকট হচ্ছে নেতৃত্বের, বিশ্বমানবতার মুক্তির জন্য ইস্পাত কঠিন ঐক্যের সমন্বিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট পশ্চিমা পুঁিজবাদি লুণ্ঠন ও বিশৃঙ্খলার রাজনৈতিক এজেন্ডার চির অবসান ঘটাতে পারে। এটা ওরা জানে বলেই সব সময় তারা মুসলমানদের মধ্যে বিভাজনের দেয়াল সৃষ্টির পাশাপাশি মুসলমানের মৌলিক বিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বোধের উপর আঘাত করে চলেছে। শত বছর ধরে ওরা মধ্যপ্রাচ্যের উপর দখলদারিত্বের কালোহাত বিস্তার করে রাখতে গিয়ে একদিকে বিভেদ বৈরিতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে অন্যদিকে বিশ্বজনমত বা পাবলিক সেন্টিমেন্টকে বিভ্রান্ত করতে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি শব্দগুলো মুসলমানদের উপর ট্যাগ করে দিয়ে ইসলামোফোবিয়া এজেন্ডার বাস্তবায়ন ঘটাচ্ছে। পশ্চিমাদের ইসলাম বিদ্বেষ-হিংসা নীতির বিরুদ্ধে মুসলমানরা কখনোই পাল্টা অপপ্রচারের পথ গ্রহণ করেনি। এটা ইসলামের নির্দেশের পরিপন্থী, কারণ কোরানে উল্লেখিত পয়গম্বরদের মধ্যে ঈসা (আ.) এবং মূসা (আ.) উচ্চ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত। এছাডাও অন্যান্য ধর্মাবলম্বিদের ক্ষেত্রেও নিন্দা বা অমর্যাদার সুযোগ ইসলামে নেই। সর্বধর্মের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, নিরাপত্তা ও বিশ্বশান্তি নিশ্চিত করতে ইসলামের আদর্শই সবচেয়ে কার্যকর পন্থা। ইন্টারফেইথ রিলেশনের ক্ষেত্রে ইসলাম যতই সুবিধাজনক অবস্থানে থাক না কেন, পশ্চিমা পুুঁজিবাদ ও লুটপাটতন্ত্রের জন্য ইসলাম মার্ক্সবাদি কমিউনিজমের চেয়েও বিপজ্জনক আদর্শ বলে তারা মনে করছে। এ জন্যই পশ্চিমা বিশ্বে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অপপ্রচারণা একতরফাভাবে ইসলাম বিদ্বেষ যা’ এখন ইসলামোফোবিয়ায় রূপ নিয়ের্ছে। স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তি বিশ্বে মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক স্বার্থ বাঁচিয়ে রাখতে একটি কমন প্রতিপক্ষ হিসেবে কমিউনিজমের পরিবর্তে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে তারা ইসলাম ও মুসলমানদের টার্গেট করে অগ্রসর হয়েছে। স্যাটানিক ভার্সেস থেকে হান্টিংটনের ক্লাশ অব সিভিলাইজেশন থিসিস একটি সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। বিগত দশকের মাঝমাঝিতে সুইডিশ পত্রিকার একজন কার্টুনিস্ট হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ব্যঙ্গচিত্র এঁেক ইউরোপ জুড়ে তোলপাড় বিক্ষোভ ও অস্থিতিশীলতার জন্ম দিয়েছিল। সেই কার্টুনিস্ট লার্ভিক্স স্টকহোমের অডিটরিয়ামে ও রাস্তায় সাধারণ মানুষের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার সংবাদও পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এরপর ফরাসি কমিক পত্রিকা শার্লি এবদো মহানবীর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করে যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে তারপর শার্লি এবদো কার্যালয়ে যে আত্মঘাতি সন্ত্রাসী হামলা ও রক্তাক্ত বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে তা ফ্রান্স বা ইয়োরোপের জন্য সুখকর বিষয় নয়। টাকার বিনিময়ে কাজ করা সে সব কার্টুনিস্টদের কেউ কেউ যখন আর বিদ্বেষমূলক কার্টুন আঁকবেন না বলে ঘোষণা দিচ্ছেন তখন ফরাসী প্রেসিডেন্ট নিজেই ঘোষণা করেন, তার দেশ প্রফেট মোহাম্মদের কার্টুন প্রকাশ বন্ধ করবে না। এর মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য মুসলমানদের নিয়ে ফরাসিদের পুরনো গোপন অভিসন্ধি আবারো প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে।

ইসলামের সাম্য-মৈত্রীর শিক্ষা ইউরোপের যাজক ও সামন্তবাদী শোষণযন্ত্রের উপর সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিকভাবে বিজয়ী শক্তি হিসেবে যতদিন টিকে ছিল ততদিন মানব সত্তার বিকাশ ও ইন্টিগ্রিটি অক্ষুন্ন ছিল। এরপর পুঁজিবাদি শক্তির প্রতিযোগিতামূলক চাকচীক্যের ক্ষণস্থায়ী মোহ ভেঙ্গে গেছে বহু আগেই। গত সাত দশকে কোনো বিশ্বযুদ্ধ বা বড় কোনো আঞ্চলিক যুদ্ধের ইতিহাস নেই। এর মধ্যেও দেশে দেশে রাজনৈতিক ও জাতিগত সংঘাত, রক্তপাত অব্যাহত রয়েছে। এর প্রায় প্রতিটির সাথে পশ্চিমা অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের যোগসুত্র খুঁজে পাওয়া যায়। আইএস নামক জুজু সৃষ্টি করে মধ্যপ্রাচ্যের পশ্চিমা বশংবদ শাসকদের কাছে হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি সাম্প্রতিক ঘটনা। পারমানবিক সমঝোতা চুক্তির পর ইরান জুজুও অনেকটা অকেজো হয়ে গেছে। এখন ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানের পথে না গিয়েই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে ইসরাইলের আধিপত্য মেনে নেয়ার দাসখতে সই করিয়ে নেয়ার ভেল্কিবাজি চলছে। ইরান-তুরস্ক কৌশলগত মৈত্রী এবং সামরিক সামর্থ্য মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা আধিপত্য ঠেকিয়ে দিতে শুরু করেছে। সাইক্স-পাইকট এগ্রিমেন্ট অনুসারে মধ্যপ্রাচ্যের উপর যথেচ্ছ নিয়ন্ত্রণ আর কাজ করছে না। ষড়যন্ত্রমূলক বালফোর ডিক্লারেশনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বৃটিশদের মামলা করছে ফিলিস্তিনীরা। প্যারিস-লন্ডন, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন থেকে শুরু করে ইসরাইলে পর্যন্ত ম্যাক্রোর ইসলাম বিদ্বেষি মন্তব্যের প্রতিবাদ হচ্ছে। মানুষ ফরাসি পণ্য বর্জনের ঘোষণা দিচ্ছে। পুঁজিবাদি পণ্য সভ্যতার বিরুদ্ধে এটাই হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর ও বলিষ্ঠ প্রতিবাদ।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (8)
Md Ahasan Bin Aiyub ২৮ অক্টোবর, ২০২০, ১:৩৪ এএম says : 1
যাই করুক ইসলাম ছিলো আছে এবং থাকবে,,,, ইনশাআল্লাহ।
Total Reply(0)
Ujjal Ahammad ২৮ অক্টোবর, ২০২০, ১:৩৫ এএম says : 1
আল্লাহ তাদের বিচার অবশ্যই করবেন।
Total Reply(0)
Sharif Mahmud ২৮ অক্টোবর, ২০২০, ১:৩৬ এএম says : 1
দাজ্জালের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে
Total Reply(0)
MD Fayas ২৮ অক্টোবর, ২০২০, ১:৪১ এএম says : 1
ইনশাআল্লাহ সারাবিশ্বে যেমন ইসলামের বিজয় সুনিশ্চিত, তেমনি ভাবে ফ্রান্সের পতনটাও সুনিশ্চিত হয়ে উঠবে।
Total Reply(0)
Syed Abdul Awal ২৮ অক্টোবর, ২০২০, ১:৪৩ এএম says : 1
ইহুদী নাস্তিকবাদরা ইসলামকে নতজানু করতে প্রতিনিয়ত ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে কিন্তু তারা এটা ভাবেনা যে ইসলাম কোন মানব রচিত বা মানব মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত কোন ধর্ম নয়,স্বয়ং মহান আল্লাহ ই ইসলামের হেফাজতকারী,ইনশাআল্লাহ,তাই ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে ইসলামের বিজয় সুনিশ্চিত।
Total Reply(0)
রুহান ২৮ অক্টোবর, ২০২০, ১:৪৬ এএম says : 1
তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণমুলক সুন্দর এই লেখাটির জন্য জামালউদ্দিন বারী সাহেবকে অসংখ্য মোবারকবাদ জানাচ্ছি
Total Reply(0)
MD Iqbal Ahmed ২৮ অক্টোবর, ২০২০, ৫:১৮ এএম says : 0
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম আমি একজন মুসলিম হিসেবে মাহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে আশা রাখি একটা সময় আসবে যখন সারা বিশ্ব মুসলিমরা স শাসন করবে এবং আল্লাহর মনোনীত ধর্ম দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে, এবং ইসলামের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে, বেইমান ইহুদী খৃষ্টান মুনাফেকর গুষ্টির সময় মনে হয় আর বেশি নাই তাই মরার আগে মরন কামর হিসেবে এই সব অপকর্ম করতেছে
Total Reply(0)
Jack Ali ২৯ অক্টোবর, ২০২০, ১২:১১ পিএম says : 0
We muslim are mainly responsible because we are million trillion far away from Islam and we are following the Kafir life style. Stern warning from Allah [SWT] regarding unity of Muslim Ummah: Surah 8:Al-Anfal: Ayat: 73.. And those who disbelieve are allies of one another, [and] if you [Muslims of the whole world collectively] do not do so [i.e: become allies, as on united block under one Khalifah] (a chief Muslim ruler for the whole Muslim world) to make victorious Allah’s religion of Islamic Monotheism), there will be Fitnah [war, battles, polytheism] and oppression on the earth, and a great mischief and corruption (appearance of ;polytheism). It has been mentioned in Tafsir At-Tabari, that the best interpretation of this above Verse: [-And those who disbelieve are allies of one another, ] (and) if you (Muslims of the whole world collectively) do not do so (i.e; become allies, as one united block. “That if you do not do what We [Allah] have ordered you to do , [i.e: all of you (Muslims of the whole world] do not become allies as on united block to make Allah’s religion Islam) victorious, there will be a great Fitnah (polytheism, war, battles, killing, robbing, a great mischief, corruption and oppression, adultery, fornications,”) ] And it is Fitnah to have many Khalifahs (Muslim rulers). As it has been mentioned in Sahih Muslim By ‘Arfajah, who said: I heard Allah’s Messenger [SAW] saying: “When you all (Muslims) are united [as one block] under a single Khalifah [chief Muslim ruler] then a man comes up to disintegrate you and separate you into different groups, then kill that man.”
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন