মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪৩০, ০৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

সেই ডা. উত্তমের বিরুদ্ধে মামলা

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ৩০ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০১ এএম

আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে আলোচিত সেই ডা. উত্তম কুমার বড়–য়ার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়েছে। গত ২১ অক্টোবর দৈনিক ইনকিলাবে ‘শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, এক লাইটের দাম ৮০ লাখ, তদন্ত রিপোর্ট ধামাচাপা’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশিত হয়। অতপর রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ও প্রফেসর (চলতি দায়িত্ব) ডা. উত্তম কুমার বড়–য়াসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ায় বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। অভিযুক্ত অন্য দুজন হলেন- হাসপাতালের বাজারদর কমিটির চার সদস্য নিউরো সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সৌমিত্র সরকার এবং নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান ডা. রতন দাশগুপ্ত। গতকাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল মান্নান এ মামলা দায়ের করেন। শৃঙ্খলা অধিশাখার আওতায় মামলা নং- ৮০/২০২০ ডা. উত্তম কুমার বড়–য়া, মামলা নং- ৮১/২০২০ ডা. সৌমিত্র সরকার এবং মামলা নং- ৮২/২০২০ ডা. রতন দাশগুপ্ত।

মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, উপরিল্লেখিত ৩ জনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা, ১৯৭৯ পরিপন্থী এবং সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩(খ), ও ৩ (ঘ) বিধি মোতাবেক অসদাচরণ ও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হলো। একই সঙ্গে কেন বিধিমালার অধীনে যথোপযুক্ত দÐ প্রদান করা হবে না সে বিষয়ে নোটিশ প্রাপ্তির ১০ কর্ম দিবসের মধ্যে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিবের নিকট কারণ-দর্শানোর নির্দেশ প্রদান করা হয়। এছাড়া ব্যক্তিগত শুনানি চাইলে তাও জানাতে নির্দেশ দেয়া হয়।

সূত্র মতে, হাসাপাতালের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ক্রয়কারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে হাসপাতালের জন্য ৮টি অপারেশন থিয়েটার (ওটি) লাইট (দাম ৮০ লাখ টাকা) প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অধিক মূল্যে ক্রয় করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের ৪ কোটি ৫৯ লাখ ৬৪ হাজার টাকা অর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে। একই সঙ্গে অর্থবছরে ২টি কোবলেশন মেশিন প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অধিক মূল্যে ক্রয় করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ৭৮ লাখ টাকার অর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে। এছাড়া একই অর্থবছরে ২টি এ্যানেসথেশিয়া মেশিন প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অধিক মূল্যে ক্রয় করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ১ কোটি ১৭ লাখ ২৫ হাজার টাকার অর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে। এসব আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারের ৬ কোটি ৪০ লাখ ৩১ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে।

চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করেন কমিটির আহŸায়ক অতিরিক্ত সচিব মো. ইসমাইল হোসেন, কমিটির সদস্য যুগ্ম সচিব শাহিনা খাতুন এবং উপসচিব হাসান মাহমুদ। এরপর তদন্ত প্রতিবেদনটি অজ্ঞাত কারণে আলোর মুখ দেখেনি। গত ২১ অক্টোবর দৈনিক ইনকিলাব ‘শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, এক লাইটের দাম ৮০ লাখ, তদন্ত রিপোর্ট ধামাচাপা শীর্ষক সংবাদ প্রকাশের পর চলতি সপ্তাহে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক তদন্ত প্রতিবেদন অনুমোদন করেন। আর গতকাল আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করেন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল মান্নান।

সূত্র মতে, তদন্ত কমিটি ২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর হাসপাতাল পরিদর্শন করে। এ সময় অভিযোগ ও কাগজপত্র পরীক্ষা করা হয় এবং হাসপাতাল পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বক্তব্য নেয়া হয়। তদন্ত কমটি ক্রয় পরিকল্পনার সঙ্গে সংযুক্ত তালিকায় দেখেন, ওটি লাইটের চাহিদা রয়েছে ২০টি। আরসিএস এন্টারপ্রাইজ থেকে দুটি ওটি লাইট কেনা হয় এক কোটি ৫৯ লাখ ৭০ হাজার টাকায়। প্রতিটির ক্রয়মূল্য ৭৯ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। কার্যাদেশ থেকে দেখা যায়, কেনা হয়েছে আটটি ওটি লাইট। এতে ব্যয় হয়েছে ৬ কোটি ৩৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা।

দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, ২০১৮ সালে যন্ত্রপাতিসহ একটি কোবলেশন মেশিন কেনা হয় ৯৬ লাখ টাকায়। আরেকটি ২৫ লাখ ৬৪ হাজার টাকায়। যদিও প্রাইস গাইডলাইনে এর দাম ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৩৯ হাজার ৩০০ টাকা। এ সংক্রান্ত কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখা গেছে, আরসিএস এন্টারপ্রাইজ থেকে কোবলেশন মেশিন কেনা হয়েছে। কার্যাদেশে দেখা গেছে, ‘কোবলেশন মেশিন উইথ আল স্ট্রান্ডার্ড এক্সেসোরিস’ একটি কেনা হয়েছে ৯৬ লাখ টাকায়। এর অরিজিন ইউএসএ উল্লেখ করা হয়েছে। আরেকটি কেনা হয়েছে ‘কোবলেশন সিস্টেম ফর ইএনটি সার্জারি’ ২৫ লাখ ৬৪ হাজার টাকায়। এটিরও অরিজিন ইউএসএ। পরিচালকের বক্তব্য সর্বনিম্ন দরদাতা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। প্রাইজলিস্টে ইউনিট মূল্য সর্বোচ্চ ১৬ লাখ টাকা। দুটি মেশিনে মূল্যের বিশাল পার্থক্য রয়েছে। এ বিষয়ে পরিচালক কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি। এ দুটি মেশিন কেনায় সরকারের অতিরিক্ত অর্থ অপচয় হয়েছে ৭৮ লাখ টাকা। এ মেশিন কেনার ক্ষেত্রেও তদন্ত কমিটি পরিচালকসহ উল্লিখিত পাঁচজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করার সুপারিশ করেছে।

একইভাবে তৃতীয় অভিযোগে ‘দুটি এনেসথেসিয়া মেশিন ইউথ ভেন্টিলেশন’ কেনায় সরকারের এক কোটি ১৭ লাখ ২৫ হাজার টাকা অর্থিক ক্ষতির প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এক্ষেত্রে কমিটি হাসপাতাল পরিচালক ও বাজারদর কমিটির চার সদস্যের বিরুদ্ধে পৃথক বিভাগীয় মামলা করার সুপারিশ করে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ডা. উত্তম হাসপাতালের সব ক্ষমতা এককভাবে নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন। এজন্য তিনি গড়ে তোলেন একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই চক্রের সঙ্গে আরো জড়িত আছেন অত্র প্রতিষ্ঠানের সহকারী পরিচালক। গত ১৬ জানুয়রি একাউন্টেন্ট নাসিরকে দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত করা হলেও তাকে দিয়ে ওই পদে অফিস করানো হচ্ছে। একজন ওয়ার্ড মাস্টার যিনি তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হয়েও ও লুটপাটের সুবিধার্থে তাকে লোকাল ওয়ার্ডে ম্যানেজার মেইনটেন্সের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এই চক্রটির ভয়ে এই প্রতিষ্ঠানের গত ৬-৭ বছর যাবৎ কোন প্রতিদ্ব›িদ্বতামূলক টেন্ডার প্রসিকিউর হয় না।

সংশ্লিষ্টরা জানায়, দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছেন প্রফেসর ডা. উত্তম বড়–য়া। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চলতি বছরের ২৯ জুলাই চট্টগ্রাম সদর রেজিস্ট্রি অফিসে দুই কোটি টাকা মূল্য দেখিয়ে চট্টগ্রাম বৌদ্ধ মন্দির সংলগ্ন একটি ভবন জমিসহ করলেও প্রকৃতপক্ষে তার দাম সাড়ে তিন কোটি টাকা। এর আগে ৭ জানুয়ারি তার ভাই দিলীপ কুমার বড়–য়ার নামে চট্টগ্রাম বৌদ্ধ মন্দির সংলগ্ন একটি জমিসহ বাড়ি ক্রয়ের বায়না ৫ কোটি টাকা মূল্য দেখানো হলেও মূলত তার দাম ছিল ১২ কোটি টাকা। জমি কেনার এসব কাগজপত্র ইনকিলাবের কাছে রয়েছে। চট্টগ্রামে বাড়ি কেনা ছাড়াও ইন্দ্রিরা রোডে ২০০০ বর্গফুট ফ্ল্যাট, ধানমন্ডি ২৮-এ ৩০০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, শ্যামলী স্কয়ার এ বাণিজ্যিক দোকানসহ নামে/বেনামে বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। এছাড়া দেশের বাইরে মালয়েশিয়াতে তিনি ফ্ল্যাট কিনেছেন এবং সম্প্রতি আমেরিকাতে ফ্ল্যাট কেনার জন্য অগ্রিম টাকা দিয়েছেন। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, তিনি কোন প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন না। শুধুমাত্র সরকারি চাকরির থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে কিভাবে এত সম্পদ গড়ে তোলা যায় সে বিষয়ে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। তবে তদন্ত কমিটি এ বিষয়গুলোকে তাদের এখতিয়ার বর্হিভ‚ত হওয়ায় তদন্তে এগুলো এড়িয়ে গেছেন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ইনকিলাবকে বলেন, কেউই জবাবদিহীতার বাইরে নয়; চলমান প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যেখানেই এ ধরণের অনিয়মের ঘটনা ঘটবে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ইতোমধ্যে স্বাস্থ্যখাতের অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এটা চলমান প্রক্রিয়া। তাই কেউ অপরাধ করলে অবশ্যই তার শাস্তি পাবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (6)
Sebul Ahmed ৩০ অক্টোবর, ২০২০, ২:২৫ এএম says : 0
প্রকৃত ঘটনা খুঁজে বের করে দোষীদের শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ ।
Total Reply(0)
Amirul Kahan ৩০ অক্টোবর, ২০২০, ২:২৭ এএম says : 0
মূর্খরা যদি চোর হয় তা অল্প কিছু সম্পদ চুরি করে, আর শিক্ষিতরা যদি চোর হয় তাহলে পুরো জাতির সম্পদ চুরি করে।
Total Reply(0)
Ak Babul ৩০ অক্টোবর, ২০২০, ২:২৭ এএম says : 0
দূর্নীতি দিনের পর দিন নিজেদের রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন রেকর্ড তৈরী করছে।দূর্নীতিবাজ এর বিচার করার মতো নেই কোন আইন। অসৎ শক্তি কখনো ন্যায়বিচারক হয় না সমস্যা এখানে।
Total Reply(0)
Towfiqul Islam ৩০ অক্টোবর, ২০২০, ২:২৭ এএম says : 0
বালিশ কেথার দাম বাড়ছে লাইট কেন পিছনে থাকবে
Total Reply(0)
Md. Sujan Atk ৩০ অক্টোবর, ২০২০, ২:২৮ এএম says : 0
মেসি রোনালদো মত কাপ দেয়া উচিত
Total Reply(0)
Ismail Hossain ৩০ অক্টোবর, ২০২০, ২:২৮ এএম says : 0
"দেশের লাল বাত্তি সাথে এই বাত্তির আলো আরো উজ্জল ভূমিকা রাখবে"
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন