বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মুক্তাঙ্গন

খন্ডিত নয় সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণই সমাধান

প্রকাশের সময় : ১৭ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আলী এরশাদ হোসেন আজাদ
অঝক তিন অক্ষরের শব্দের অর্থ জিজ্ঞাসা। অঝক-এর মাধ্যমে জ্ঞান-প্রজ্ঞার রহস্যের সন্ধান মিলে। অ- অঃঃরঃঁফব (দৃষ্টিভঙ্গি) ঝ-ঝশরষষ (দক্ষতা) ক- কহড়ষিবফমব (জ্ঞান)-এগুলোর সমন্বয়ে তৈরি হয় যোগ্যতা। এগুলোর যিনি বিকাশ ঘটান তিনিই শিক্ষক। শিক্ষকের আদর্শÑ শিষ্টাচার, ক্ষমা, কর্তব্য পরায়ণতা (শি.ক্ষ.ক)। একজন শিক্ষক হলেন খরভব ংঃঁফবহঃ। তবে শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষার মনোন্নয়ন, শিক্ষকদের পেশাগত বঞ্চনা সবকিছু একটি সামষ্টিক বিষয়। এজন্যই সবার প্রত্যাশা ‘শিক্ষা জাতীয়করণ’।
অনেক হতাশা, আক্ষেপ-অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে এমপিওভুক্তগণের বকেয়াসহ নতুন বেতনস্কেল প্রাপ্তি আশার দ্যুতি ছড়াচ্ছে। এমপিওভুক্তগণের ভাগ্যে জুটলো না বৈশাখীভাতা। তারা যে গ্লানিকর উৎসবভাতা পান তা ঘোচানোরও নেই কোনো আশাবাদ। বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজই সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র পেশাজীবী যারা ‘সিকিভাগ’ উৎসবভাতা পান। শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দকৃত উৎসবভাতা ২৫%, কর্মচারীবৃন্দের জন্য ৫০%! বৈষম্যটি পীড়াদায়ক। দিব্যদৃষ্টিতে তখন সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পাদটীকা’ গল্পের প-িতমশাই ভেসে ওঠেন, তিনি যেন ‘লাট সাহেবের কুকুরের কয় ঠ্যাং এর সমান’ ? লেখকের ভাষায় ঝরষবহপব রং মড়ষফবহ!
জানা গেছে, এমপিওভুক্তগণ টাইমস্কেল, সিলেকশন গ্রেড, উচ্চতর বেতনস্কেলও পাবেন না। যদিও সরকারিগণ যথাক্রমে ১০ ও ১৬ বছরে স্বয়ংক্রিয় উপায়ে কাক্সিক্ষত পরবর্তী ধাপে উন্নীত হবেন। সরকারিগণ ৫% বার্ষিক প্রবৃদ্ধি সুবিধা পেয়েছেন গত জুলাইয়ে। এমপিওভুক্তগণের ৫% বার্ষিক প্রবৃদ্ধি, মূল বেতনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া জাতীয় বেতনস্কেলে বিঘোষিত নীতির অংশ। তবুও এমপিওভুক্তগণের বেতনের ৫% বার্ষিক প্রবৃদ্ধির বিষয়টি অনিশ্চয়তায় অন্ধকারে ঘুরপাক খাচ্ছে। বর্তমান সরকার বেসরকারি শিক্ষকদের বাড়িভাড়া ১০০০ টাকা এবং চিকিৎসাভাতা ৫০০ টাকা করলেও তা নিতান্তই অপ্রতুল। জোরের সঙ্গে বলা হচ্ছে, বেসরকারি শিক্ষকগণকেও আয়কর দিতে হবে। অথচ বেসরকারি শিক্ষকগণ শুধু তাদের প্রারম্ভিক বেতনের শতভাগ সরকারিভাবে পেয়ে থাকেন। তাই বেসরকারি শিক্ষকগণের বঞ্চনার অবসান না ঘটিয়েই নতুন করে আয়করের বোঝা চাপানো ‘মরার ওপর...’ তুল্যই নয় বরং বেসরকারি শিক্ষকগণের বঞ্চনার অবসান যেন ‘কুঁজর চিত হয়ে শোয়ার আকাক্সক্ষা’র সমার্থক!
সম্প্রতি মাউশি প্রকাশিত জাতীয়করণের জন্য ১৯৯টি কলেজের তালিকার ফলে নানান অসংগতি নতুন বিতর্ক, ক্ষোভ-হতাশা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যেই সারাদেশে মানববন্ধন, হরতাল, সড়ক অবরোধের কর্মসূচিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও আমজনতা সোচ্চার হয়েছে। অসংখ্য কলেজের বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আপত্তি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার সংসদ সদস্য এবং কলেজ কর্তৃপক্ষ। আপত্তিগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব কলেজের মধ্যে কোনোটির জমি নেই, কোনোটি সদ্য স্বীকৃতি পেয়েছে আবার কোনোটি গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি ও বঙ্গবন্ধুর খুনীর সহচরের কলেজ। গাজীপুর জেলার সর্বপ্রথম ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজকে তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। অপেক্ষাকৃত বয়োকনিষ্ঠ ও দূরবর্তী অজপাড়াগাঁয়ের কলেজও তালিকায় রয়েছে। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ উদ্বোধনকৃত ‘অর্ধশতাব্দি প্রাচীন কাপাসিয়া কলেজ’ উপজেলা সদরের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ কলেজ। প্রায় ২০ একর জমি, ৪টি বিষয়ে অনাসর্, পাস কোর্স, উচ্চমাধ্যমিকসহ ৩৫০০-এর বেশি শিক্ষার্থী, সুবিশাল অবকাঠামো, বিস্তৃত খেলার মাঠ, ৩টি পুকুর, সবুজ-শ্যামলে মনোরম কলেজটিতে সরকারিকরণের যুক্তিসংগত অসংখ্য উপাদান রয়েছে।
অতীতে সামরিক শাসনামলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারিকরণের কোনো নীতিমালা ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনপূর্ব বিভিন্ন জনসভায় ঘোষণা করেছেন, প্রত্যেক উপজেলায় একটি স্কুল ও একটি কলেজ তিনি সরকারি করবেন। সব সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন সদরে থাকে, তেমনিভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারিকরণের ক্ষেত্রেও উপজেলা সদরের স্কুল-কলেজ বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার।
সাম্প্রতিক তালিকার কলেজগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি কলেজ মহান জাতীয় নেতা-নেত্রী ও বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের নাম ও স্মৃতিধন্যÑ যা অবশ্যই সরকারি হবার যৌক্তিকতা বাড়িয়ে দেয়। তবে মানবসম্পদ উন্নয়ন, শিক্ষার মানোন্নয়ন ও নগরায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে কি না এবং প্রতিষ্ঠানের বয়স, অবস্থান, অবকাঠামোগত সুবিধা, ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা, যোগাযোগের ব্যবস্থা বিবেচনায় আনা খুবই প্রাসঙ্গিক। ক্ষেত্রভেদে দেখা গেছে বিশেষ সুবিধা পাবার কৌশলে একই প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তনের ঘটনা কালেকালে ঘটেছে বারবার। কাজেই, প্রয়োজনে যেভাবে নির্বাহী আদেশে পিজি, ইপসা, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বা অন্যান্য জাতীয় প্রতিষ্ঠানের নতুন নামকরণ করা হয়েছে সেভাবেই মহান জাতীয় নেতাদের নামে উপজেলা সদরে কলেজের নামকরণ করে হলেও ঐসব কলেজ সরকারিকরণ করা বেশি যৌক্তিক।
সম্প্রতি ১৬টি সরকারি কমার্স ইনিস্টিটিউটকে এক ঘোষণায় সাধারণ কলেজ করা হয়। আশির দশকে এক ঘোষণায় মহকুমা সদরের কলেজগুলো জাতীয়করণ হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলের সূচনায় যে সব জেলা সদরে সরকারি মহিলা কলেজ ছিল না এমন ১২টি জেলায় এক ঘোষণায় মহিলা কলেজ জাতীয়করণ হয়। প্রধানমন্ত্রী উপজেলায় একটি কলেজ জাতীয়করণের ঘোষণার পরও কাক্সিক্ষত ফল পেতে নীতিমালা তৈরির অপেক্ষা, জরিপ ইত্যাদির সুযোগে দীর্ঘসূত্রিতা, পক্ষপাতিত্ব ও অনিয়ম, দুর্নীতি, দুর্নামের ভয় রয়েই গেছে। কাজেই ‘এক ঘোষণা’য় উপজেলা সদরের কলেজগুলো জাতীয়করণ প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় বাস্তবায়ন দ্রুততর করবে বলে আশা করি।
সবকিছুর পরও বলতেই হয়, খ-িত নয় সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণই একমাত্র দাবি ও সমাধান। কেননা, যে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যত উন্নত সে দেশকে তত উন্নত বিবেচনা করা হয়। কিন্তু আমাদের শিক্ষার যৎসামান্য উন্নয়ন হলেও উন্নতি হয়নি শিক্ষকদের জীবনমান। অভিন্ন সিলেবাসে পাঠদানকারী ৯০ ভাগের বেশি বেসরকারি শিক্ষক বা দুষ্টলোকের ভাষায় ‘বেদরকারী’, যাদের সঙ্গে সরকারিদের পার্থক্য পর্বত সমান। বিশেষত বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় পদমর্যাদা অনুযায়ী সুযোগ সম্মানীর দাবি উপেক্ষিত। প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ও সর্বনি¤œ পদের সবাই একই পরিমাণ বাড়িভাড়া পান। তারা বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট, পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল ও উৎসব ভাতা পান না, তারা পদোন্নতি, সেচ্ছা অবসর, বদলি সুবিধাসহ অসংখ্য বঞ্চনার শিকার!
শিক্ষকের বঞ্চনার জন্য আমরা শিক্ষকগণও কমবেশি দায়ী। কারণ (১) ঢাকা বা বড় বড় শহরের বড় প্রতিষ্ঠানের ‘বড় স্যার, টিচার’(!) যারা তারা তেমন কষ্টে নেই। তারা নেতা, তারা কর্মসূচি দেনÑ কিন্তু কিছু হয় না, (২) মফস্বলের কারো কারো ক্ষেত্রে শিক্ষকতা পুরো মাত্রায় একমাত্র পেশা নয়Ñতারা স্থানীয় এবং পাশাপাশি অন্যকিছু করেন, (৩) ‘ইজ্জতের কামাই খাই’Ñ সম্মানজনক ‘সেবাব্রত’ এমন মানসিক অবস্থান ও নিষ্ক্রিয়তায় কেউ কেউ ভাগ্যলিপি মেনে নিয়ে ভাবেনÑ ‘যা হয় হবে, সবাই পেলে আমিও পাবো খামোখা কথা বলে কী লাভ’, (৪) আকাশের লক্ষ তারার মতোই নানান পরিচয়ে বিভক্ত আমাদের শিক্ষকসমাজ এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দলীয় লেজুড়বৃত্তিও কম দায়ী নয়।
প্রসঙ্গত, ইউনেস্কো ১৯৬৬ সালের প্যারিস সন্মেলনে ১৩টি অধ্যায় ও ১৪৬টি ধারা-উপধারায় শিক্ষকের মর্যাদা ও অধিকারের সুপারিশ প্রণীত হয়। যাতে শিক্ষকের চিকিৎসা- স্বাস্থ্যসেবা, ছুটি বেতন-ভাতা ও মর্যাদার ক্ষেত্রে বলা আছে- (ক) সম্মানজনক পারিতোষিক নিশ্চিতকরণ, (খ) যুক্তি সংগত জীবনমান বিধান কল্পে সুবিধাদি নিশ্চিতকরণ, (গ) স্কেল অনুযায়ী নিয়মিত বেতন-ভাতাদি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা এবং (ঘ) জীবনধারণের ব্যয়বৃদ্ধির সঙ্গে বেতন কাঠামো পুনঃবিন্যাস ও বর্ধিত বেতন প্রাপ্তির নিশ্চয়তা ইত্যাদি। কিন্তু বাংলাদেশে জাতীয় শহিদ মিনারের পবিত্র অঙ্গনে সমবেত মানুষ গড়ার কারিগরদের ওপর ‘ইতর প্রাণি’ দমনের ‘রাসায়নিক যৌগ’ প্রয়োগ করা হয়েছে! বেশিরভাগ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ প্রতিষ্ঠান থেকে তেমন কোনো আর্থিক সুবিধা পান না। তবে যেসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিকঅবস্থা ভালো, ব্যবস্থাপনা স্বচ্ছ ঐ সব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ বেশকিছু সুবিধা প্রতিষ্ঠান থেকেই পান। এক্ষেত্রেও সবকিছু প্রতিষ্ঠান প্রধান ও পরিচালনা পরিষদের আন্তরিকতার ওপর নির্ভরশীল। এমন কি দীর্ঘ দিনের প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত সুযোগ-সুবিধাদি প্রতিষ্ঠান প্রধান ও পরিচালনা পরিষদ চাইলেই বন্ধ করে দেয়াও বিচিত্র নয়। কোন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ কোথায় কী সুবিধা পাচ্ছেন, কোথায় শিক্ষকগণ অভ্যন্তরীণ বৈষম্য-বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন তাও সরকারের নজর এড়িয়ে যায়। অথচ এক্ষেত্রে জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি।
পরিশেষে বলবো, বর্তমান সরকার প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণের সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন। তাই সবার প্রত্যাশা ‘দেশের সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা’ অচিরেই জাতীয়করণের যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বর্তমান সরকার। প্রতিশ্রুত ‘স্বতন্ত্র বেতনস্কেলে’র বিষয়েও প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি যেন সময়ের দাবি। অন্যদিকে অসংগতিতে ভরপুর খ-িত জাতীয়করণের চলমান প্রক্রিয়ার মস্ত মহড়ায়, সমস্ত শিক্ষকসমাজের মধ্যে বৈষম্য, হতাশা, অপমানের তিক্ত অভিজ্ঞতা তৈরি করবে। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার এবং শিক্ষকের সম্মান সবার ওপরে। কবির ভাষায়Ñ
“এক ফোটা পদধূলি নহে পরিমাণ,
গয়া কাশি বৃন্দাবন তীর্থের সমান”।
(মৈমনসিংহ গীতিকা; কবি বংশিদাস)।
ষ লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ
কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন