শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

চরম অবক্ষয়ের শিকার নতুন প্রজন্ম

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০২ এএম

আজকাল শহরাঞ্চলেতো বটেই গ্রামাঞ্চলেও আর্থিক দিক দিয়ে স্বচ্ছল প্রায় বাড়িতেই টিভি আছে। এসব টিভিতে প্রতি সপ্তাহে ভিন্ন ভিন্ন দিনে থাকে বিভিন্ন পরিবেশনা। থাকে খেলাধূলা, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, নাটক, সিনেমা ও সিরিয়াল। এসব অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে থাকে বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপন। এদিকে কেবল লাইনের সুবাদে দেশ বিদেশের ৬০/৭০টি চ্যানেলের নানা জাতীয় অনুষ্ঠান দেখানো হয়। প্রতিদিনই কোনো না কোনো চ্যানেলে দেখানো হয় ছবি। ইচ্ছে করলে যে কেউ প্রতিদিনই সিনেমা দেখতে পারেন। সপ্তাহে ১ দিন অর্থাৎ শুক্রবারে বাড়িতে সবাই মোটামুটি অবসর থাকেন। এ দিন নানা চ্যানেলে ছবি দেখার জন্য সবাই আগ্রহী থাকেন।
ধরা যাক, আপনি সপ্তাহে ১টি সিনেমা দেখেন। তা’হলে মাসে ক’টা হলো। ৪টি। বছরে ৫২টি। ধরে নিলাম, আপনার অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। তাহলে একই ঘরে আপনি, আপনার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, বাবা-মা, ভাই বোনদের সঙ্গে স্থুল শরীরী নাচের কুৎসিত দৃশ্য, প্রৌঢ় মুখশ্রী সম্পন্ন নায়কদের যন্ত্রণাদায়ক নৃত্য, সল্প বসনা নায়িকাদের আদিম উল্লাস সবকিছু সম্মিলিতভাবে দেখতে বাধ্য। বাড়ির শিশুটি হয়তো কেজি ওয়ান বা টু-র ছাত্র, সে শতাধিক খুন আর ধর্ষণ দৃশ্য দেখছে আপনার কাছে বসেই। যে হিসেবটি দেওয়া হল তা শুধু এক বছরের। শিশুটির বয়স যদি হয় সাত কিংবা আট বছর তা হলে সে ঠিক কতটা অমানবিক দৃশ্য দেখার দর্শক হল? প্রতিটি দৃশ্য কি তার সরল শৈশবের স্নায়ুকে ক্ষত বিক্ষত করছে না? প্রতিটি যৌন দৃশ্য কি তাকে রোগাক্রান্ত করে তুলছে না? শৈশবে এটুকু বয়সেই তার মনের গহীন প্রদেশে কি জন্ম নিচ্ছে না এক অজ্ঞাত অপরাধবোধ? অসুস্থ, অস্বাভাবিক মনোবিকলের শিকার হয়ে বেড়ে উঠছে যে বিষবৃক্ষ, সে আমার-আপনার প্রিয়, অতি প্রিয় স্নেহের সন্তান। টিভি সেটটির খরিদ্দার আপনি, মাসে মাসে দু’শ-চার’শ টাকা তুলে দিচ্ছেন কেবল মালিকদের কাছে বিনিময়ে কি পাচ্ছেন?
বিজ্ঞজনের লেখায় পাই, ‘বর্তমান বিশ্বে প্রচার মাধ্যম পরমাণু বোমার চেয়েও শক্তিশালী। পরমাণু বোমাতো কেবল ধ্বংস করে, মানুষ মারে। কিন্তু প্রচার মাধ্যম সে তো মানুষ মারে না, মানুষকে দখল করে নেয়। সে যেমন চায়, মানুষকে তেমনিভাবে ভাবায়, হাঁটায়, বলায়, খাওয়ায়, স্বপ্ন দেখায়।’ ২০১৫ সালের এক সমীক্ষায় প্রকাশ, সত্তর বছরের এক বৃদ্ধ ইংরেজ তার জীবনের ১২টি বছর টিভি দেখতে ব্যয় করেছেন। আমেরিকার একটি পরিবারে তাদের জীবদ্দশায় এক চতুর্থাংশ সময় টিভির সামনে বসে কাটিয়েছেন। জাপানের ৯৫ শতাংশ পরিবার নিয়মিত টিভির দর্শক। ফ্রান্সে ৮৮ শতাংশ মানুষের অবসরের সিংহভাগ দখল করে রাখে টিভি। ১৯৮৫ সালে ঢাকার অনুষ্ঠিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক শিশু চলচিত্র উৎসব। এর সমাপ্তি অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন তদানীন্তন তথ্য ও বেতার মন্ত্রী । তিনি তখন জানিয়েছিলেন, পশ্চিমের দৃশ্য এবং দূরদর্শনের মাধ্যমগুলোর সর্বগ্রাসী অগ্রগতি অচিরেই পৃথিবীটাকে নরকের অধিশ্বর শয়তানের হাতে তুলে দেবে। ক্ষমতা হস্তান্তরের এ ভয়াবহ কর্মকান্ডে প্রধান কান্ডারী হবে টেলিভিশন। তাঁর মতে, পশ্চিমা দেশগুলোতে পাঁচ থেকে পনেরো বছর বয়সী শিশু এবং কিশোররা সিনেমা ও টিভির দৌলতে ইতোমধ্যে চল্লিশ হাজার ধর্ষণ এবং পঞ্চাশ হাজার হত্যাকান্ডের সাক্ষী। ফ্রান্সের কালচার অ্যান্ড কমিউনিকেশন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মন্ত্রী জাক লাং বলেন, ‘সদ্য স্বাধীন দেশগুলোর জাতীয় সংস্কৃতি এবং নৈতিক মূল্যবোধের বৈশিষ্ট্যকে ভয়াবহভাবে বিষাক্ত করা হচ্ছে সাংস্কৃতিক এ ধারার প্রচারের মধ্য দিয়ে।’
খুব সম্ভব ১৯৮০ সালে পাবলিক অপিনিয়ন পোলের মাধ্যমে একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য জনসমক্ষে এসেছিল। ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা। সেখানকার টিভি দর্শকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল যে, আগের সপ্তাহে তাদের মধ্যে টিভি সিরিয়ালের বিজ্ঞাপিত পণ্য সামগ্রীর মধ্যে কোনগুলো তাদের মনে আছে। প্রায় অধিকাংশ দর্শকই মার্কিন বহুজাতিক সংস্থার পণ্যবস্তুর নাম বলেছিলেন। কেউ কেউ অন্য কিছু। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল, তাদের স্মরণে থাকা পণ্যসামগ্রীর প্রথম দশটির তালিকায় একটিও নিজের দেশের বস্তুর নাম ছিল না। এছাড়াও আরো এক দিকও রয়েছে। আগের শিশুটির কথায় ফিরে যাই। জানাচ্ছেন বাংলাদেশের জনৈক নাট্যব্যক্তিত্ব-‘আমাদের সমাজে ছোটরা সোল্লাসে টেলিভিশনের অমর সিরিয়াল ও সুনির্বাচিত সিনেমায় বোধহয় প্রতি পনেরো মিনিটে ৫টি খুনের দৃশ্য দেখে। এছাড়া আরো কিছু হত্যার সঙ্গে থাকতে হয় তাদের। যেমন দৃষ্টি দিয়ে খুন,কথা দিয়ে খুন, উপেক্ষা দিয়ে খুন। এ ছোটদের দাদা দাদী তারা যে সামাজিক জন্তু, তাদেরও যৌনজীবনের প্রয়োজন আছে তারা তা জানতেন। কিন্তু তারা বা তাদের পূর্বপুরুষেরা একইসঙ্গে ‘ভালবাসা’ নামের একটি বস্তুও আবিস্কার করতে পেরেছিলেন? কিন্তু এখন সে সব সম্পূর্ণভাবে তুলিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমাদের সমাজ জীবনে অপরিহার্য হয়ে উঠা টেলিভিশনের কল্যাণে একটা তেরো বছরের ছেলে বা মেয়ে সে প্রায় প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষভাবে যৌন উত্তেজক যৌন আচরণকে উসকে দেওয়া নৃত্যগীত দেখছে এবং তারই সঙ্গতকারী সংলাপ শুনছে। ফলে গ্রামে-শহরে চৌদ্দ বা ষোল বছরের একটি ছেলে সুযোগ-সুবিধাজনক পরিস্থিতিকে একটি মেয়ে পেলে আগে তাকে ধর্ষণের চিন্তা-ভাবনায় আছন্ন, প্রভাবিত হয়ে পড়ছে। বন্ধুত্ব বা প্রেম করার ইচ্ছা সেখানে জোরালো নয়। পরবর্তী কর্ম হিসাবে আইনের শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য মেয়েটিকে খুন করে বনে-জঙ্গলে অথবা পাট ক্ষেতে ফেলে দিয়ে দিব্যি শিষ দিতে দিতে বন্ধুর বাড়ি যাবার জন্য ট্রেন বা বাসে উঠে পড়ছে।’
আর লিখছেন একজন পরিচালক ‘আপনি যখন মধ্যরাতের গভীরে স্ত্রীর সঙ্গে টিভির সামনে বসবেন, ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ তথা ‘আনসেনসর্ড’ ছবি দেখার জন্য, তখন আপনার সন্তান নাগালের মধ্যেই নিদ্রাতুর থাকবে, পাশের ঘরে থাকবেন আপনার ভাই, বোন, বাবা-মা। শিশুদের ঘুম ভাঙবে শৈশবের অমলিন সারল্য, প্রলয়ঙ্কারী এক অষ্পষ্ট মালিন্যের অতি ধীর সংক্রমণে আসক্ত হতে থাকবে সংগোপনে। পাশের ঘরে ভাই-বোন। স্বভাবতই তাদের ঘুম আসবে না, অবদমিত আকাঙ্কায় অসুস্থ হবে তারা। আপনি কিভাবে পরের দিন, দিনের আলোয় পুরনো সেই সম্ভ্রম, সেই অপত্য স্নেহ নিয়ে তাকাবেন আপনার সহোদয়ের দিকে? নৈতিকতার তর্জনী কি অধিকারে তুলে ধরবেন তাদের দিকে।
অথচ অন্য ধারার সিনেমা আগে তৈরি হয়নি? এখনো হচ্ছে না? চিলির কথা বলি। সেখানে যখন শ্রমিক বস্তিগুলো পরিণত হচ্ছিল বন্দি শিবিরে, সন্ত্রাসে ডুবে যাচ্ছিল গোটা দেশ, কোকাকোলা আর ডিসকো কালচারে পচে যাচ্ছিল সমগ্র জাতির রুচিবোধ, নিরস্ত্র চলচিত্র শিল্পীরা তখন সশস্ত্র হয়ে উঠলেন। পুলিশ খুনে বাহিনীর প্রহরা টপকে পৌঁছে গেলেন শ্রমিক বস্তিতে। সেলুলয়েডের ফিতেয় তারা বন্দি করলেন সীমাহীন শোকের বিস্ফোরণকে।
বলিভিয়ার তামার খনিগুলো ছিল আমেরিকার প্রভুদের দখলে। শ্রমিকেরা দীর্ঘ শোষণের পর রুখে দাঁড়ালেন। অমানুষিক পুলিশি অত্যাচার চলল। কাছের পাহাড়ের আড়াল থেকে ল্যাটিন আমেরিকান চলচিত্র যোদ্ধা বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান হারমান ছবি তুলতে থাকেন। এক সময় পুলিশের মেশিন গানের নল ঘুরে আসে ক্যামেরার দিকে। হারমান বুঝতে পারেন বিপদটা। তবু নড়েন না। মেশিনগানের প্রথম বুলেটটি লেন্স ভেঙে তাঁর কপালে লাগার আগের মুহুর্ত পর্যন্ত ধরা থাকে সে দৃশ্য। ক্যামেরায় চোখ রেখে একজন মানুষের দেহ অসংখ্য বুলেটে ঝাঝঁরা হয়ে ধীরে ধীরে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে। এ দৃশ্য ধরা পড়ে হারমানের পেছনে রাখা সহকর্মীর ক্যামেরায়।
২০০৮ সালের কথা। উনিশ বছরের সাহসী আফগান কন্যা অলকা সাদাত স্বল্প দৈর্ঘের তথ্যচিত্রের জন্য ‘শান্তিপুরস্কার’ পায়। দুটো তথ্যচিত্র তৈরি করেন সাদাত। ‘মে বি দে আর ফর ইউ এন্ড মি’ নামে। প্রথমটি মূলত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সেসব মেয়ের খন্ডচিত্র, যারা বেশিরভাগ বলি হয়েছেন গার্হস্থ্য হিংসার। ওরা সুবিচারের আশা করেন। আর তাই, তাদের গল্প শুনিয়েছেন অলকাকে। আর সেসব সেলুলয়েডে বন্দি করে পাঠিয়ে দিয়েছেন সারা বিশ্বে। দ্বিতীয় ছবিটির বিষয়বস্তু সেসব মেয়েকে নিয়ে যাদের স্বামী আফগান সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন। সরকার থেকে তাদের ব্যারাকে রাখা হয়েছে। অলকা সেই ব্যারাক থেকে তুলে এনেছেন মহিলাদের জীবন যুদ্ধের কাহিনী। ব্যারাক বাহিনী কেউ কেউ মুখ খুলেননি। ভয়ে। কাকে ভয়? বলেছেন স্বামীর নিষেধ আছে নিজেদের কথা জানাবার। কিন্তু স্বামী কোথায় তিনি হয়ত আর বেঁচে নেই।
অলকার বড় বোন চব্বিশ বছরের রোয়া সাদাতও তৈরি করেন দু’ ঘণ্টার ‘থ্রি ডটস’ নামের কাহিনী চিত্র। নায়িকা এক স্বামীহীনা। তিনটি সন্তানের মা। ছ’বছরের দুর্ভিক্ষের সঙ্গে লড়াই করে তিনি বেঁচে থাকার জন্য বাধ্য হন একজন সেনা নায়ককে বিয়ে করতে। কিন্তু বিয়ের পরপরই সেই সেনানায়কটি তাকে ইরানে আফিমের চোরাচালানকারী হিসেবে পাঠিয়ে দেয়। এক সময় তিনি গ্রেফতার হন। আফগান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘থ্রি ডটস’ সেরা পুরস্কারে ভূষিত হয়।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। হিংসা, বিশ্ব সংসারের কূটচালগুলোইতো উঠে আসছে সিনেমার পর্দায়? তা দেখাও কি উচিত বাড়ির কনিষ্ঠ শিশুটির? না, শিশুদের উপযুক্ত ছবিও তৈরি হচ্ছে। চলচ্চিত্রের সুস্থ, স্বাভাবিক, দায়বদ্ধ একটি প্রবল প্রবাহ আমাদের পাশেই বয়ে চলেছে। কিন্তু তার সংবাদ আমরা কেউই জানতে পারি না। জানতে দেওয়া হয় না।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Jack Ali ৪ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০৯ পিএম says : 0
Because our country is ruled by the Kafir Law.. We must rule our country by the Law of Allah then all the heinous crime will disappear and only then we will be able to live in our country in peace, security and also with human dignity.
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন