শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

তামিম মারজানসহ দশজন শনাক্ত : আটক জেএমবির ৪ তরুণীর পরিচয় পেয়েছে র‌্যাব

প্রকাশের সময় : ১৭ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, গুলশান হামলার ঘটনায় তামিম, মারজানসহ দশজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের তিনি এ তথ্য জানান। অন্যদিকে গ্রেফতার জেএমবির ৪ তরুণীর পরিচয় প্রকাশ করেছে র‌্যাব। র‌্যাব-৪-এর কর্মকর্তারা গতকাল ওই ৪ জনের পরিচয় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। এদের মধ্যে একজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষানবিশ চিকিৎসক। অপর তিনজন মানারাত ভার্সিটির ছাত্রী।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর মিরপুরের পাইকপাড়ায় র‌্যাব-৪ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়।
র‌্যাব জানায়, ওই চারজনকে গাজীপুরের সাইনবোর্ড, মগবাজার ও মিরপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন জেএমবির নেত্রী আকলিমা রহমান, ঐশী, মৌ ও মেঘলা। আকলিমা মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্রী।
র‌্যাব জানায়, গত ২১ জুলাই র‌্যাব জেএমবির দক্ষিণাঞ্চলের আমির মাহমুদুল হাসানকে গাজীপুর থেকে গ্রেফতার করে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, তাদের কার্যক্রমে মেয়েদের একটি দল জড়িত। ওই দলের নারী সদস্য আকলিমা রহমান তাকে গত রমজান মাসে ১২ হাজার টাকা ইয়ানত (চাঁদা) জোগাড় করে দেন। এর পর থেকে র‌্যাব আকলিমাকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখে। র‌্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্রী আকলিমা বিভিন্ন সময় জেএমবির দাওয়াতি কার্যক্রমে যোগ দিতে প্ররোচনা দিয়ে আসছিলেন। তার বিরুদ্ধে ‘নতুন ধারার’ জঙ্গিবাদে উৎসাহ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তার ওপর নজরদারির ধারাবাহিকতায় র‌্যাব-৪-এর একটি দল গতকাল দিবাগত রাত দুইটার দিকে তাকে গ্রেফতার করে। এ সময় তার মুঠোফোনে জঙ্গিবাদ ও বিপুল পরিমাণ অন্যান্য তথ্য পাওয়া যায়। দেড় বছর ধরে তিনি এই জিহাদি দলের সঙ্গে রয়েছেন। মাহমুদুল হাসানের কাছ থেকে বাইয়াত গ্রহণের পর তার সংশ্লিষ্টতা আরও বেড়ে যায়।
এদিকে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন, গুলশান হামলার তামিম মারজান ছাড়া আরো সাত-আটজনের সাংগঠনিক নাম পাওয়া গেছে। তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত এখনো জানা যায়নি। গুলশান হামলায় তাদের বিভিন্ন ধরনের ভূমিকা রাখার তথ্য পাওয়া গেছে। তারা সবাই দেশের ভেতরেই আছে। তবে তাদের সুনির্দিষ্ট অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়নি, ছবিও পাওয়া যায়নি।
এক প্রশ্নের জবাবে কাউন্টার টেররিজমের প্রধান বলেন, পুলিশের তরফ থেকে গুলশান হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী মারজানের ছবি প্রকাশ করে প্রাথমিক সাফল্য পাওয়া গেছে। মারজানের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে কিছুদিন আগে তাকে চট্টগ্রাম এলাকায় দেখা গিয়েছিল বলে পুলিশের ‘হ্যালো সিটি’ অ্যাপে মানুষ তথ্য দিয়েছে।
সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার পরিকল্পনাকারী হিসেবে নাম উঠে আসা তামিম চৌধুরী ও জিয়াউল হক গ্রেফতার আছেন কি না জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম বলেন, গুলশান হামলার ঘটনায় শুধু হাসনাত রেজা করিম গ্রেফতার আছেন। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তামিম ও জিয়া কোথায় আছে বা তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে কি না, তা জানা নেই।
হাসনাত করিমের জড়িত থাকার বিষয়ে কীভাবে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশÑএমন প্রশ্নের জবাবে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান বলেন, হাসনাত করিমের পূর্ব ইতিহাস, জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে তার জড়িত থাকা, ঘটনাস্থলে তার উপস্থিতি, তার কিছু ছবি দেখে এমনটা মনে হয়েছে। বিস্তারিত জানার জন্য তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পাওয়া ও বর্তমানে পুলিশের রিমান্ডে থাকা তাহমিদ খান সম্পর্কে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, তার সম্পর্কে এখনো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তার দ্বিতীয় দফা রিমান্ড চলছে।
গুলশান হামলার ঘটনায় মারজানের দায়িত্ব কী ছিলÑএ সম্পর্কে জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম বলেন, মারজানকে গ্রেফতার করা যায়নি। গ্রেফতার করলে এ ব্যাপারে জানা যাবে।
গুলশান হামলার ঘটনায় যেসব জঙ্গি মারা গেছে, তাদের সঙ্গে তামিমসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যোগাযোগের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান বলেন, ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া ডিভাইসগুলো পরীক্ষাগারে আছে। এ ব্যাপারে প্রতিবেদন পাওয়া গেলে যোগাযোগ সম্পর্কে জানা যাবে।
র‌্যাবের অভিযানে আটক ৩ তরুণী জঙ্গি মানারাতের
একজন ঢাকা মেডিকেলের শিক্ষানবিশ চিকিৎসক
ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির চার সদস্যকে র‌্যাব গ্রেফতার করেছে, যারা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলের ছাত্রী।
তারা হলেনÑমানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের ছাত্রী আকলিমা রহমান, মৌ ও মেঘনা এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষানবিশ চিকিৎসক ঐশী।
র‌্যাব-৪-এর সিপিসি ১-এর অধিনায়ক মেজর সাইদ বলছেন, আটকদের মধ্যে আকলিমা জেএমবির নারী বিভাগের উপদেষ্টা, অন্যরা তার সহযোগী।
র‌্যাব জানায়, গত ২১ জুলাই জেএমবির ‘দক্ষিণাঞ্চলীয় আমীর’ মো. মাহমুদুল হাসান ওরফে হাসানকে (২৭) টঙ্গী থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছ থেকে কয়েকজন নারী জঙ্গি সদস্যের কথা জানা যায়। এ তথ্যের ভিত্তিতে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
র‌্যাব-৪-এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি লুৎফুল কবির গতকাল মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, হাসানের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধানে তারা জানতে পারেন আকলিমা রহমান নামে জেএমবির এক নারী সদস্য রমজান মাসে ১২ হাজার টাকার তহবিল সংগ্রহ করে দিয়েছেন। এরপর তাকে গোয়েন্দা নজরদারিতে নেওয়া হয়।
‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি আকলিমা আরবি শিক্ষার কথা বলে বিভিন্ন এলাকায় জনসংযোগ করতেন। তার সঙ্গে অনেকেই সাক্ষাৎ করতেন। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে গাজীপুরের সাইনবোর্ড এলাকা থেকে সোমবার রাতে তাকে গ্রেফতার করা হয়।’ আকলিমার মোবাইল ফোন থেকে জঙ্গি কর্মকা-ের ‘অনেক তথ্য’ পাওয়া গেছে বলেও র‌্যাব জানায়।
লুৎফুল কবির বলেন, ‘আকলিমা প্রায় দেড় বছর ধরে কথিত ওই জিহাদি দলটির সঙ্গে সম্পৃক্ত। কথিত ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য দলকে বড় করা এবং সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তিনি তহবিল সংগ্রহ করে মাহমুদুল হাসানকে পৌঁছে দিতেন।’
আকলিমা রহমান
আকলিমা রহমানের প্রাথমিক শিক্ষা ঢাকার রেনেসাঁ প্রি-ক্যাডেট হাই স্কুল ও সাইনবোর্ড এলাকার হাজী আহাম্মদ আলী পাবলিক স্কুলে। উত্তরা হাই স্কুল থেকে ২০১০ সালে এসএসসি এবং হলি চাইল্ড কলেজ থেকে ২০১২ সালে এইচএসসি পাস করেন। ২০১৩ সালে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া এই তরুণী পড়ছিলেন ফার্মাসি বিভাগের চতুর্থ বর্ষে।
ঐশী
চিকিৎসক বাবা-মায়ের সন্তান ঐশী ২০১০ সালে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। চলতি বছর জানুয়ারিতে এমবিবিএস শেষ করে জুন মাসে তিনি ইন্টার্নশিপ শুরু করেন।
ঐশীর বাবা ডা. বিশ্বাস আক্তার হোসেন (৫৮) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক। আর মা ডা. নাসিমা সুলতানা (৪৮) আছেন সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগে।
মৌ
ডাক নাম মৌ। তার পুরো নাম জানা যায়নি। মিরপুর-২-এর ইসলামীয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালে এসএসসি ও মিরপুর চিড়িয়াখানা রোডের বিসিআইসি কলেজ থেকে ২০১২ সালে এইচএসসি পাস করেন মৌ। মেডিকেল ও ইউনিভার্সিটি ভর্তির জন্য তিনি ইউসিসির ফার্মগেট শাখায় কোচিং করেন। পরে ২০১৩ সালে ভর্তি হন মানারত ইউনিভার্সিটির ফার্মাসি বিভাগে।
মেঘনা
ঢাকার আহম্মদনগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১১ সালে এসএসসি ও ঢাকা ক্যামব্রিয়ান কলেজ থেকে ২০১৩ সালে এইচএসসি পাস করেন মেঘনা। ওই বছরই পারিবারিকভাবে তার বিয়ে হয়। মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী তিনি।
এদিকে র‌্যাব জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে আকলিমা র‌্যাবকে বলেছে, তার জোগানো ১২ হাজার টাকার মধ্যে আট হাজার টাকা দিয়েছেন ঐশী, যিনি প্রায় তিন বছর ধরে প্রত্যক্ষভাবে এ দলে জড়িত।
ওই তথ্যের ভিত্তিতে সোমবার রাতে মগবাজার এলাকা থেকে ঐশীকে গ্রেফতার করা হয় এবং তার ল্যাপটপে ‘উগ্র মতবাদসংক্রান্ত বিভিন্ন ফাইল, ম্যাগাজিন, লেকচার ও ভিডিও’ পাওয়া যায় বলে র‌্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, আকলিমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তারা মৌয়ের নাম জানতে পারেন, যিনি সাত মাস ধরে এ দলে যুক্ত। মৌকে আটক করা হয় মিরপুর-১-এর জনতা হাউজিং থেকে।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে র‌্যাব জানায়, মৌয়ের বাসায় অভিযান চালানোর সময় তিনি তার মোবাইল ফোনের মেমোরি কার্ড ‘ধ্বংস’ করে ফেলেন। তার ল্যাপটপে ‘জিহাদি কর্মকা-ের দলিল’ পাওয়া যায়; বাসায় পাওয়া যায় উগ্র মতবাদের বই। পরে মৌয়ের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জনতা হাউজিংয়ের একটি মেস থেকে মেঘনাকে আটক করা হয় বলে জানানো হয় ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
এর আগে গত জুলাই মাসে সিরাজগঞ্জ এবং টাঙ্গাইল থেকে জেএমবির সাত নারী সদস্যকে গ্রেফতারের কথা জানিয়েছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল অস্ত্র, বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জাম এবং উগ্র মতবাদের বই।
টাঙ্গাইলে গ্রেফতার তিনজন জেএমবির আত্মঘাতী দলের সদস্য বলেও সে সময় পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল।
গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলাসহ বাংলাদেশে সাম্প্রতিক উগ্রপন্থিদের বিভিন্ন নাশকতার ঘটনায় জেএমবিকেই দায়ী করে আসছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। ওই দুই ঘটনা এবং কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় নিহত জঙ্গিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলেন বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, যারা বাড়ি পালিয়ে জঙ্গিবাদে জড়ান বলে পরে তথ্য বেরিয়ে আসে। কয়েক মাস ধরে নিখোঁজদের তালিকায় যারা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন নারীও রয়েছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন