বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে ইলিশ আহরণে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা উঠে যাচ্ছে আজ মধ্য রাতে

নাছিম উল আলম | প্রকাশের সময় : ৪ নভেম্বর, ২০২০, ৪:১১ পিএম

নিরাপদ প্রজনন ও বংশ বিস্তার নির্বিঘ্ন করতে উপকূলীয় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে সব ধরনের মৎস্য আহরণ সহ সারাদেশে ইলিশ আহরণ, পরিবহন ও বিপণনে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা উঠে যাচ্ছে আজ মধ্যরাতে। বৃহস্পতিবার থেকে দক্ষিণাঞ্চল সহ উপকূলীয় এলাকায় মাছ ধরার প্রস্ততিনিচ্ছে জেলেরা। ইতোমধ্যে ঝিমিয়ে পড়া দক্ষিণাঞ্চলের মৎস্য পল্লীতে চাঞ্চল্য ফিরতে শুরু করেছে। এবার নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চল সহ উপক’লীয় এলাকায় জেলা প্রশাসন এবং আইনÑশৃংখলা বাহিনীর সহায়তায় মৎস্য অধিদপ্তর ব্যাপক অভিযান চালালেও জেলে ও মৎস্যজীবীদের মধ্যে আইন ভাঙার প্রবনতাও তুলনামূলকভাবে বেশী লক্ষ্য করা গেছে।

বাংলাদেশ নৌ বাহিনী ও কোষ্ট গার্ড ইলিশ আহরন বন্ধে মৎস্য অধিদপ্তর ও প্রশাসনের সাথে যথেষ্ঠ সহায়ক ভ’মিকা পালন করে। মৎস্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত ১৩ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত দক্ষিণাঞ্চল সহ উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ২০ হাজার অভিযান ছাড়াও আড়াই হাজার ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনায় বেআইনীভাবে আহরিত প্রায় ৪২ হাজার টন ইলিশ ছাড়াও আরো প্রায় ৮ হাজার টন অন্যান্য মাছ জব্দ করা হয়। জব্দকৃত মাছের বেশীরভাগই বিভিন্ন এতিমখানা সহ দাতব্য প্রতিষ্ঠানসমুহে বিতরন করে প্রশাসন।

এসময়ে সাড়ে ৫ হাজারের মত জেলেকে এক মাস থেকে ৩বছর পর্যন্ত করাদন্ডাদেশ প্রদান ছাড়াও প্রায় ৮২ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করেছে ভ্রাম্যমান আদালত। এসব অভিযানে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ মিটার করেন্ট জাল ও প্রায় ২ হাজার ২শ মিটার অন্যান্য ক্ষতিকর জাল সহ আহরন নিষিদ্ধ উপকরন বাজেয়াপ্ত করে ভ্রাম্যমান আদালত। যার দাম প্রায় ২.৪০ কোটি টাকার মত বলে জানা গেছে। এছাড়াও মৎস্য বিভাগ অভিযানকালে সাড়ে ৬ হাজারেরও বেশী মামলা দায়ের করেছে। অভিযানকালে আটককৃত নৌকা সহ বিভিন্ন মৎস্য আহরন উপকরনসমুহ বাজেয়াপ্ত করে নিলামে বিক্রী করেও সরকারের প্রায় ১৯ লাখ টাকা আয় হয়েছে বলে জানা গেছে। মৎস্য বিভাগের এসব অভিযান ও ভ্রাম্যমান আদালতের কার্যক্রমের বেশীরভাগই ছিল বরিশাল ভাগের উভ্যন্তরীন ও উপক’লীয় নদ-নদী সহ সাগর মোহনায়। দেশে উৎপাদিত ইলিশের প্রায় ৭০ ভাগই বরিশাল বিভাগে আহরিত হয়ে থাকে। গত দুই দশকে বরিশাল বিভাগে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ১৫০%-এরও বেশী।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের ইকাসিষ্টেমে সারা বছরই ৩০% ইলিশ ডিম বহন করে। এসব ইলিশ পরিপক্ক হয়ে ডিম ছাড়ে। যে ডিমগুলো পুরুষ ইলিশ দ্বারা নিষিক্ত হয়ে থাকে তা এ মাছের নতুন প্রজন্ম গঠন করে। আর আশ্বিনের পূর্ণিমার আগে পড়ের এ সময়ে ভোলার পশ্চিম আউলিয়া পয়েন্টÑতজুমদ্দিন, পটুয়াখালীর কলাপাড়ার লতাচাপলি পয়েন্ট-এর ধলচর দ্বীপ, মনপুরা দ্বীপ, মৌলভীরচর দ্বীপ ও কালিরচর দ্বীপ, মায়ানী পয়েন্টÑমীরসরাই ছাড়াও কুতুবদিয়া পয়েন্ট এলাকায় মা ইলিশের অত্যাধীক প্রচুর্য থাকায় ঐসব এলকার ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারে গত ২২ দিন সবধরনের মৎস্য আহরন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল।

উপকূলের ঐ ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে মূক্তভাবে ভাসমান ডিম থেকে ফুটে বের হবার পরে ইলিশের লার্ভা, স্বাদু পানি ও নোনা পানির নার্সারী ক্ষেত্র সমুহে বিচরন করে। খাবার খেয়ে বড় হবার পাশাপাশি পরিপক্কতা অর্জনের লক্ষ্যে নার্সারী ক্ষেত্রসমুহে ৭-১০ সপ্তাহ ভেসে বেড়াবার পরে জাটকা হিসেব সমুদ্রে চলে যায়। ঐসব জাটকা বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন এলাকায় ১২Ñ১৮ মাস অবস্থানের পরে পরিপক্কতা অর্জন করে আবার স্বাদু পানির নার্সারী ক্ষেত্রে ফিরে আসে।
এবার আহরন নিষিদ্ধকালীন ২২দিনে ইলিশ আহরনে বিরত জেলেদের জন্য খাদ্য সহায়তা হিসেবে সরকার দেশের উপক’লীয় ১৫২টি উপজেলার ৫ লাখ ২৮ হাজার ৩৮২ জেলে পরিবারের জন্য ২০ কেজি করে ১০ হাজার ৫৬৬ টন চাল বিতরন করেছে। এরমধ্যে বরিশাল বিভাগের ২ লাখ ৮২ হাজার ৫শ জেলে পরিবারের মধ্যে ৫ হাজার ৬৫০ টন চাল বিতরন করা হয়।

গত দুই দশকে নানামুখি পদক্ষেপ গ্রহনের ফলে দেশে ইলিশের উৎপাদন সোয়া দুলাখ টন থেকে গত বছর ৫ লাখ ৩৩ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে। যা চলতি অর্থ বছরে ৫.৪০ লাখ টনে ও আগামী অর্থবছরে সাড়ে ৫ লাখ টনে উন্নীত হবার সম্ভবনার কথা জানিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর।
‘হিলসা ফিসারিজ ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্লান’এর আওতায় ২০০৫ সালে প্রথম প্রধান প্রজনন মৌসুমে ১০ দিন ইলিশের আহরণ বন্ধ রাখা হয়। মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশেই ২০১১ সালে তা ১১ দিন এবং ২০১৫ সালে ১৫ দিনে ও ২০১৬ সালে থেকে ২২ দিনে উন্নীত করা হয়। আমাদের অর্থনীতিতে ইলিশের একক অবদান এখন ১%-এরও বেশী। আর মৎস্য খাতে অবদান প্রায় ১২%। বর্তমানে সারা বিশ্বে আহরিত ইলিশের প্রায় ৬০% বাংলাদেশে উৎপাদন ও আহরিত হচ্ছে।

২০১৮-এর ৭-২৮ অক্টোবর আহরন বন্ধ থাকায় উপকূলের প্রজননস্থল সহ অভ্যন্তরীন মূক্ত জলাশয়ে ৪৮% মা ইলিশ ডিম ছাড়ার সুযোগ পায় বলে জানিয়েছে মৎস গবেষনা ইনস্টিটিউট । ইনস্টিটিউট-এর মতে প্রজননক্ষম মা ইলিশের হার ২০১৭ সালে ৭৩% থেকে ’১৮ সালে ৯৩%-এ বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি এসময়ে প্রজনন সাফল্য ৮০%-উন্নীত হয়। ইলিশ আহরন নিষিদ্ধের ফলে ঐ সময়ে দেশে ৭ লাখ ৬ হাজার কেজি উৎপাদিত ডিমের ৫০%-এর সাফল্যজনক পরিস্ফুটন ও ১০% বেঁচে থাকলেও ইলিশ পরিবারে নতুন ৩ হাজার কোটি জাটকা যূক্ত হয়। এমনকি গতবছর প্রজনকালীন সময়ে দেশের প্রধান ইলিশ প্রজনন ক্ষেত্র সমুহে পরিক্ষামূলক নমুনায়নে ৮৩% ইলিশের রেনু পাওয়া গিয়েছিল। এসময়ে ঐসব এলাকায় ১৭% অন্যান্য মাছের রেনু পোনা পাওয়া যায়। ফলে ইলিশ আহরন নিষদ্ধকালীন ২২ দিনে উপক’লে অন্যান্য মাছেরও নিরাপদ প্রজনন স¤পন্ন হচ্ছে। যা দেশে অন্যান্য প্রজাতির মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলে জানিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন