বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ফ্রান্সে মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে বিশ্বাসের স্বাধীনতাহরণের পাঁয়তারা

মুনশী আবদুল মাননান | প্রকাশের সময় : ৫ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

বাকস্বাধীনতার নামে বিশ্বাসের স্বাধীনতাহরণের জোর পাঁয়তারা চলছে ফ্রান্সে। গত কিছুদিন ধরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ যে সব কথাবার্তা বলেছেন, তাতে সহজেই প্রতীয়মান হতে পারে, ফ্রান্স বিশ্বমুসলিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। ফ্রান্সের মুসলমানরা সুনির্দিষ্ট নিশানা হলেও যখন ইসলামের বিরুদ্ধে, ইসলামের নবী মুহম্মদ (সা.) এর বিরুদ্ধে লাগাতার বিষোদ্গার উত্থিত হয়, তখন কার্যত তা বিশ্বমুসলিমের ওপরই গিয়ে পড়ে। ফ্রান্সের জনগণের একটা বড় অংশের মধ্যে ইসলাম বা মুসলিমবিদ্বেষ বরাবরই ছিল। এই বিদ্বেষ দূর করে মুসলমানদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানমূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কার্যকর চেষ্টা অতীতে তেমন একটা হয়নি। উল্টোটিই বরং হয়েছে। ফরাসি সমাজের সঙ্গে, সমাজমানসের সঙ্গে মুসলমানদের একাত্ম করার উসিলায় তাদের ধর্মাদর্শ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি থেকে বিযুক্ত করা বা সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পিত অপচেষ্টা হয়েছে। মুসলমানরা তাদের স্বতন্ত্র পরিচয় মুছে ফেলতে সম্মত হয়নি। প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ যে এখন বলছেন, মুসলমানরা বিচ্ছিন্নতাবাদী, সেটা সম্ভাবত এদিকে লক্ষ্য করেই। ফরাসি সমাজের মুল স্রোতধারার সঙ্গে মুসলমানরা কখনই বিরোধে জড়ায়নি। বরং খাপ খাইয়ে চলার চেষ্টা করেছে। শুধুমাত্র তাদের ধর্মীয় পরিচয়, আদর্শ ও সংস্কৃতি রক্ষা করতে চেয়েছে। এই স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে চাওয়া তাদের মোটেই অন্যায় নয়। ফ্রান্সের সংবিধানে সকল ধর্মের মানুষের সমঅধিকার স্বীকার করা হয়েছে। ধর্মপালন ও ধর্মীয় সংস্কৃতি অনুসরণের অধিকার সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়কেই দেয়া হয়েছে। সেদিক দিয়ে মুসলমানরা সঠিক পথেই আছে।

ফ্রান্সে মুসলমানদের সংখ্যা ৬০ লাখের মতো। এর মধ্যে ফরাসি বংশোদ্ভূত মুসলমানের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। অবশিষ্ট ৫০ লাখ অভিবাসী। এদের বেশিরভাগই এসেছে ফ্রান্সের সাবেক উপনিবেশনগুলো থেকে। দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৯ শতাংশ খ্রিষ্টান, ৪০ শতাংশের মতো ধর্মহীন এবং ১০ শতাংশ মুসলমান। দেখা যাচ্ছে, ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে মুসলমানরা দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ। শুধু তাই নয়, অন্যান্য পশ্চিমা দেশের মতো ফ্রান্সেও ইসলাম দ্রুত বিকাশশীল ধর্ম। খ্রিষ্টান ও ধর্মহীন ফরাসিদের অনেকেই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম গ্রহণ করছে। এটা ফরাসি, বিশেষ করে খ্রিষ্টান ধর্মবিশ্বাসীদের কাছে একটা বড় রকমের ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতে কোনো এক সময় ফ্রান্সে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে শাসনের অধিকার লাভ করবে। অন্য আরেকটা দিক হলো, মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও অভিবাসীদের অব্যাহত আগমনে ফরাসিরা খুবই অসন্তুষ্ট। তারা মনে করে, এর ফলে তাদের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা সংকুচিত হচ্ছে। ফ্রান্সে শ্বেতঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী, প্রবল খ্রিষ্টবাদী ও উগ্র জাতীয়তাবাদীদের উত্থান ঘটছে দ্রুত। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তারা সবাই একাট্টা। ইসলাম ও মুসলমানভীতি এর প্রধান কারণ।

কিছুদিন আগে ফ্রান্সে সামুয়েল পাটি নামে একজন শিক্ষক নিহত হয়েছেন। তাকে শিরোচ্ছেদ করা হয়েছে। এটি করেছে চেচেন বংশোম্ভূত এক যুবক। তার নাম আবদুল্লাখ আনজোরভ। ইতোমধ্যে অনেকেই জানা হয়ে গেছে, ওই শিক্ষক ফ্রান্সে মহানবী (সা.) এর ব্যঙ্গাত্মক ছবি প্রদর্শন করেছিলেন। খবরে এরকমই উল্লেখ করা হয়েছে, ওই ব্যঙ্গাত্মক ছবি প্রদর্শনের কারণে বিক্ষুব্ধ হয়ে যুবক তাকে হত্যা করে। এ সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ বলেছেন : তিনি মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে ছাত্রদের শিক্ষা দান করছিলেন। তিনি শিক্ষা দান করছিলেন বিশ্বাস করা ও না করার স্বাধীনতা নিয়ে। প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ তার হত্যাকান্ডকে কাপুরুষোচিত বলে উল্লেখ করেছেন। পুরুষোচিত যে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ ধরনের হত্যাকান্ড মোটেই সমর্থনীয় নয়। এটা আদৌ মুসলমান ও ইসলামের পক্ষে যায় না। বরং দুর্নাম বাড়ায়, ভুল বার্তা দেয়। কিন্তু কেন হত্যাকান্ডের মতো নিন্দনীয় ও ঘৃণ্য অপরাধমূলক কাজটি করতে ওই যুবক প্ররোচিত বা বাধ্য হল, তা খতিয়ে দেখা হলো না। প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ মত প্রকাশের স্বাধীনতা কিংবা বিশ্বাস করা, না করার স্বাধীনতার সঙ্গে মহানবী (সা.)-এর ব্যঙ্গাত্মক ছবি প্রদর্শনের সম্পর্ক কোথায়, তার কোনো ব্যাখ্যা দেননি। ঘাতক যুবককে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে। ফলে জানা গেল না, কি কারণে সে শিক্ষককে হত্যা করেছে। পুলিশ যদি তাকে হত্যা না করতো, গ্রেফতার করে বিচারের সম্মুখীন করতো, তাহলে যা বলা হচ্ছে- তার চেয়ে বেশি অনেক কিছুই হয়তো জানা সম্ভবপর হতো। তাকে গুলি না করে আটকানো মোটেই অসম্ভব ছিল না। অনেকের মতে, পুলিশ তাকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে আসলে ‘প্রতিশোধ’ নিয়েছে।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা কিংবা বিশ্বাস করা, না করার স্বাধীনতার সঙ্গে মহানবী (সা.) এর ব্যঙ্গাত্মক ছবি প্রদর্শনের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। বুঝতে অসুবিধা হয় না, শিক্ষক বুঝে বা না বুঝে এই কাজটি করেছেন। এটি করা তার ঠিক হয়নি। ছাত্রদের অনেক অভিভাবকও নাকি এটা পছন্দ করেননি।

জানা গেছে, ইতিপূর্বে শার্লি এবদো’তে প্রকাশিত মহানবী (সা.)-এর ব্যঙ্গত্মক ছবিই শিক্ষক ক্লাসে প্রদর্শন করেছিলেন। শার্লি এবদো একটি স্যাটায়ারিকাল পত্রিকা। পত্রিকাটির মহানবী (সা.) বা ইসলামবিদ্বেষ সর্বজনবিদিত। পত্রিকাটিতে ২০১১ ও ২০১৫ সালে মহানবী (সা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশিত হয়। এ নিয়ে ফ্রান্সসহ গোটা বিশ্বে ব্যাপক তোলপাড় হয়। ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশের প্রতিক্রিয়া হিসাবে ২০১৫ সালে পত্রিকাটির প্যারিসঅফিস, একটি দোকান ও মতঁরোগ এলাকায় ৭ থেকে ৯ জানুয়ারি আলাদা আলাদা হামলার ঘটনা ঘটে, যাতে ১৭ জন নিহত হয়।

পূর্বাপর হামলা ও নিহত হওয়ার এই ঘটনায় বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। নিন্দা ও ক্ষোভ জানানো হয়। ফ্রান্সের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করা হয়। তার পাশে থাকার প্রতিশ্রæতি দেয়া হয়। ১২ জানুয়ারি ফ্রান্সের সঙ্গে সংহতি প্রকাশের জন্য ৪০টি দেশের শীর্ষ নেতারা প্যারিসে যান। একটি বিশাল সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অংশ নেয় প্রায় ৩৭ লাখ লোক। ফ্রান্সের ইতিহাসে এটা এক বেনজির ঘটনা। ওই সংহতি মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা হামলা ও হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে কথা বলে; কিন্তু শার্লি এবদোর অপকর্মের বিষয়টি মোটেই আমলে আনে না। বরং তারা অনেকেই ‘আমিই শার্লি এবদো’ বলে শার্লি এবদোর পক্ষাবলম্বন করে। এরপর ফ্রান্সের মুসলমানদের ওপর যে জুলুম-নির্যাতন নেমে আসে তার তুলনা মেলাভার। এত কিছুর পরও শার্লি এবদোতে প্রকাশিত মহানবী (সা.)-এর ব্যঙ্গাত্মক ছবি প্রদর্শন মুসলমানের পুরানো ঘায়ে নুনের ছিঁটা দেয়ার শামিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ মহানবী (সা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন শুধু সমর্থন করেননি, তা অব্যাহত রাখার ঘোষণাও দিয়েছেন। বলেছেন, প্রত্যাহার নয়, ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন অব্যাহত থাকবে। এই ঘোষণা দেয়ার আগে তিনি ফ্রান্সের মুসলমানসহ বিশ্বমুসলিমের কথা বিবেচনায় আনেননি। মত প্রকাশের স্বাধীনতার বরাতে বিশ্বমুসলিমের অনুভূতিতে আঘাত দেয়াকে তিনি সমর্থন করেছেন। মহানবী (সা.) বিদ্বেষ ও ইসলামবিদ্বেষে প্ররোচনা জুগিয়েছেন। ২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত সংহতি সম্মেলনে বক্তারা যেমন মত প্রকাশের স্বাধীনতাকেই একমাত্র গুরুত্ব দিয়েছিলেন, অন্য কিছুকে নয়, তেমনি প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁও তাই করেছেন। ধর্মীয় বিশ্বাস ও আদর্শকে তিনি একেবারেই গুরুত্ব দেননি। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান এ প্রসঙ্গে বলেছেন: একজন রাষ্ট্রনায়ককে এর চেয়ে বেশি কী বলা যায়, যিনি বিশ্বাসের স্বাধীনতার বিষয়টি বোঝেন না এবং তার দেশে বসবাসরত ভিন্ন বিশ্বাসের লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে এই ব্যবহার করেন। প্রেসিডেন্ট এরদোগান প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁর মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা উচিৎ বলে মন্তব্য করেছেন।

ইসলামে মহানবী (সা.)-এর অবয়ব কল্পনা করে ছবি আঁকা কিংবা তার ব্যঙ্গচিত্র অংকন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মুসলমানরা বিশ্বাস করে, ছবি আঁকা কিংবা ব্যঙ্গচিত্র অংকন নবীজি (সা.)-এর জন্য অসম্মানজনক, অপমানকর। এই কাজটিই যখন ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়, বারবার করা হয়, তখন সেটা যে তার সঙ্গে বড় রকমের দেয়াদবি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রধানত ইসলাম বা মুসলিমবিদ্বেষ থেকেই এটা করা হয়। বিশ্বের মুসলমানরা আশা করে, তাদের বিশ্বাসের স্বাধীনতার প্রতি সবাই শ্রদ্ধাশীল থাকবে, কেউ তাতে আঘাত হানবে না। মুসলমানরা অন্যান্য ধর্মাদর্শ ও বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ধর্মবিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা ও সব ধরনের উগ্রতার বিরুদ্ধে ইসলাম সদাসোচ্চার। অথচ সেই ইসলামকে, তার নবী (সা.) কে পরিকল্পিতভাবে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মহানবী (সা.) এর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ ও প্রদর্শনের পক্ষে অবস্থান ঘোষণার পরপরই সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন ভবনে মহানবী (সা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা রীতিমতো উসকানিমূলক। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ফ্রান্সসরকারের আরো যে বড় পরিকল্পনা রয়েছে, তার আভাস আছে প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁর এই বক্তব্যে, যেখানে তিনি বলেছেন: ধর্ম হিসাবে ইসলাম আজ বিশ্বজুড়ে সংকটে আছে। শুধুমাত্র আমাদের দেশেই যে এ ধরনের ঘটনা চোখে পড়ছে তা কিন্তু নয়। তবে আমরা কোনোভাবেই ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তিতে কাউকে আঘাত হানতে দেবো না। নতুন করে অভিযান চালিয়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও পাবলিক সেক্টর থেকে ধর্মকে সরিয়ে দেয়া হবে। নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি বজায় রাখার জন্য যে সব স্কুল ও মসজিদ বিদেশ থেকে টাকা পায়, তাদের ওপর কড়া নজরদারি চলবে।

ফ্রান্সের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি রক্ষার অজুহাতে প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ ফ্রান্স থেকে ইসলামী বিশ্বাস ও সংস্কৃতি উৎখাত করার তার ইচ্ছার কথাই এখানে বলেছেন। বিশ্বে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সংখ্যাই বেশি। ওইসব দেশে মুসলামানরা বেশি হোক বা কম হোক, বাস করে তাদের বিশ্বাস ও সংস্কৃতি নিয়েই। ইসলামী বিশ্বাস ও সংস্কৃতি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় ভাবমূর্তির জন্য মোটেই হুমকি নয়। এ প্রসঙ্গে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেছেন: ইসলাম সংকটে বলে ম্যাখোঁ শুধু যে ধর্মকে অবজ্ঞা করেছেন, তাই নয়, খোলাখুলি উসকানিও দিয়েছেন। ইসলামের কাঠামো নিয়ে কথা বলার তিনি কে? তিনি আরো বলেছেন, ম্যাখোঁ যেসব বিষয়ে কিছুই জানেন না, সেসব বিষয়ে কথা বলার আগে যেন বিষয়গুলো জেনে নেন। পাকিস্তানের প্রথমমন্ত্রী ইমরান খান ম্যাখোঁর বক্ত্যের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ পরিষ্কারভাবে কিছু না জেনেই ইসলাম ও আমাদের নবী মুহম্মদ (সা.) কে উদ্দেশ্য করে ধর্ম অবমাননা কার্টুন প্রদর্শনে উৎসাহ দিয়ে বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত করেছেন।

মুসমানরা যেখানেই বসতি স্থাপন করেছে বা বসবাসস্থল হিসাবে নির্বাচন করেছে, সেখানেই প্রথমে মসজিদ নির্মাণ করেছে এবং ধর্মীয় শিক্ষা বিস্তারের জন্য মাদরাসা বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। ফ্রান্সেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সেখানে এখন তিন হাজারের মতো মসজিদ আছে এবং প্যারিসেই আছে পাঁচশ’ বেশি। আর মাদরাসা, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় আছে, অন্তত তিন হাজার। এই মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিই ফ্রান্সের মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস, আদর্শ ও সংস্কৃতি লালন করছে, তাদের শিক্ষা দিচ্ছে, অনুপ্রাণিত করছে। মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এই ক্ষেত্রটিতে আঘাত হানার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে ফ্রান্স। সেখানকার মুসলমানরা সে আঘাত মেনে নেবে বলে মনে হয় না। মেনে নিলে তাদের স্বাতন্ত্র্য আর থাকবে না। সেটাই চাচ্ছে ম্যাখোঁর সরকার। খুব ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক পথেই হাঁটছে সরকার। মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্য মুছে ফেলার যে কোন পদক্ষেপ ফ্রান্সে জাতিগত ঐক্য ও সংহতিতে ফাটল সৃষ্টি করবে। জনগণের মধ্যে বিভেদ ও সংঘাত সৃষ্টি করবে। ৬০ লাখ মুসলমানকে তাদের বিশ্বাসের বাইরে নিয়ে যাওয়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনি তাদের মাইনাস করাও সম্ভব নয়। বৈচিত্র্যের মাঝে যে ঐক্য, সে ঐক্য প্রতিষ্ঠাই কাম্য হওয়া উচিৎ।

প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁর উত্থান মধ্যপন্থি নেতা হিসাবে। তাকে এক সময় ইউরোপের সবচেয়ে উদার মনোভাবসম্পন্ন নেতা বলে গণ্য করা হতো। সেই তিনিই এতটা মুসলিমবিদ্বেষী, একদেশদর্শি ও কট্টোর হলেন কিভাবে, অনেকের মনেই সে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। তাদের উদ্দেশ্য বলা যায়, এর পেছনে রাজনীতির একটা বড় ভ‚মিকা থাকতে পারে। মুসলিম ও অভিবাসনবিরোধী কট্টর পন্থার রাজনীতি সেখানে ভালো রকমেই কল্কে পাচ্ছে। ম্যারি লো পেনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি তার প্রমাণ। ধারণা করা হচ্ছে, আগামীতে তিনি ক্ষমতার প্রতিদ্ব›দ্বী হয়ে উঠতে পারেন। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এমন বিবেচনা সামনে রেখেই ম্যাখোঁ মুসলিমবিদ্বেষী ও অভিবাসন বিরোধী রাজনীতিতে হাত পাকাতে উঠে পড়ে লেগেছেন। কিন্তু এতে যে, দেশ বড় আকারে বিপাকে পড়বে, জাতীয় সংহতি বিপন্ন হবে, সেটা তিনি উপলব্ধি করতে পারছেন না।

মহানবী (সা.) এর ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন ও ইসলাম বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ ও তার সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি, বক্তব্য ও আচরণ মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক নিন্দা ও ক্ষোভের জন্ম্য দিয়েছে। দেশে দেশে এর বিরুদ্ধে মিছিল-সমাবেশ হচ্ছে এবং মানুষ অধিক সংখ্যায় তাতে শামিল হচ্ছে। ইতোমধ্যে ফরাসি পণ্য বর্জনের ডাক দেয়া হয়েছে বিভিন্ন দেশ থেকে। এতে সব মুসলিম দেশেরই জনগণপর্যায় ব্যাপক সাড়া ও সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে। এটা ফ্রান্সের জন্য বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। ভবিষ্যতে এ ধরনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও বয়কট দেখা দিতে পারে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে, অন্যের মত ও বিশ্বাসের প্রতি কোনো তোয়াক্কা করা হবে না। অন্যের মত ও মতাদর্শের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে ফ্রান্স এটা এড়িয়ে দেতে পারে না কিংবা পরস্পরবিরোধী আবস্থান নিতে পারে না। মহানবী (সা.) এর ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে জায়েজ করার চেষ্টা হলেও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের ব্যঙ্গচিত্র অংকনের ঘটনায় দারুণ ক্ষুব্ধ হয়েছে ফ্রান্স। মৌরতানিয়ার বিখ্যাত কার্টুনিষ্ট খালিদ ওলেদ মওলা এই ব্যঙ্গচিত্রটি অংকন করেছেন। এতে বিরাগ হয়ে তার সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি বাতিল করেছে ফরাসি দূতাবাস। মত প্রকাশের স্বাধীনতা এখন গেল কোথায়? আরও প্রশ্ন আছে। ফ্রান্সে নাৎসিবাদের পক্ষে কি কোনো মত প্রকাশ করা যাবে? যাবে কি হলোকাস্ট সম্পর্কে বিরূপ কিছু বলা? না, ফ্রান্সে নাৎসিবাদের পক্ষে এবং হলোকাস্টের বিপক্ষে কিছু বলা যাবে না। এই হলো মত প্রকাশের স্বাধীনতা নমুনা বা স্বরূপ।

অনুরূপভাবে ধর্মনিপেক্ষতাবাদের অর্থ ধর্মহীনতা নয়। স্ব স্ব ধর্মের অনুশাসন অনুসরণ ও পালনের অধিকার স্বীকার করে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। এহেন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের নামে মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতি উৎসাদন করার অপচেষ্টা কোনোমতেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় দেশগুলোতে, মহানবী (সা.) বা ইসলামবিদ্বেষ এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে যেভাবে লাগাতার অপপ্রচার, বিষেদ্গার ও অসদাচরণ করা হচ্ছে, জুলুম-অত্যাচার চালানো হচ্ছে, তাতে অনেকেই বলছেন, ইসলামভীতি পশ্চিমা বিশ্বকে রীতিমত দিশেহারা করে তুলেছে। তারা সুচিন্তিতভাবে যেন আর একটি ক্রুসেডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ক্রুসেড কি তাদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে? মোটেই না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন