শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

নিম্নমধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস

করোনায় ঢাকা ছাড়ল ২২ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছে ১ কোটি মানুষ : বিলস নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা : ক্যাব সভাপতি

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ৭ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০২ এএম

শহিদুল ইসলাম একটি প্রতিষ্ঠিত ডেভেলপার কোম্পানির সুপারভাইজার পদে চাকরি করতেন। বেতন পেতেন ১৮ হাজার টাকা। রামপুরায় ১০ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিয়ে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে থাকতেন। একমাত্র সন্তানকে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে নার্সারিতে ভর্তি করেছিলেন। কিন্তু করোনা মহামারি তার সব কিছু তছনছ করে দিয়েছে। গত জুলাই মাসে কোরবানি ঈদের আগে অফিস তাকেসহ আরো কয়েকজনকে ছাঁটাই করে। এরপর থেকে সে বেকার। তার ওপর লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তার জীবনকে আরো কঠিন করে তোলে। একটা চাকরি জোগাড় করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেননি। জুলাই থেকে অক্টোবর এই চার মাস সামান্য যা কিছু সঞ্চয় ছিল তা ভেঙে খেয়েছে। স্ত্রীর কিছু অলঙ্কার ছিল তাও বিক্রি করে সংসার চালিয়েছেন। আত্মীয়-পরিচিতদের কাছ থেকে কিছু ধার-দেনাও করেছেন। এখন আর চলতে পারছেন না। তাই বাধ্য হয়েই এ মাসের শেষে বাসা ছেড়ে সে গ্রামে চলে যাচ্ছে। 

শহিদুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, করোনা শুরুর পর অর্থাৎ গত মার্চ থেকে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে, তা কমার কোনো লক্ষণ নেই। বরং এখন প্রায় সব জিনিসের দামই বাড়ছে। আলুর দাম একটু কম ছিল তাও ৫০ টাকা বিক্রি হয়েছে। এখন ৪৫ টাকা কেজি হয়েছে। দাম বৃদ্ধির কারণে আমার মতো ছোট সংসারেরও মাসে দেড়-দুই হাজার টাকা খরচ বেড়ে গেছে। অথচ এক টাকাও আয় নেই। ধার-দেনা করেও চলতে পারছি না। তাই গ্রামে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
শুধু শহিদুল ইসলামই নন, করোনা মহামারি ও দীর্ঘস্থাায়ী বন্যা আঘাত হেনেছে অসংখ্য মানুষের জীবন-জীবিকায়। বেকারত্ব ও দারিদ্র্য যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েই চলছে নিত্যপণ্যের দাম। আয় কমা ও ব্যয় বাড়ার এ ফাঁদে পড়ে নাভিশ্বাস উঠেছে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের জীবনে।
করোনা সঙ্কটে দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ পরিবারই কোনো না কোনোভাবে আর্থিক টানাপড়েনে পড়েছে। মার্চে করোনা শুরুর প্রথম তিন-চার মাসে লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়েছে। তখন বেকারত্ব ১০ গুণ বেড়ে যায়। এই হিসাব খোদ সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)। এ সংস্থাটি স¤প্রতি ‘কোভিড-১৯ বাংলাদেশ : জীবিকার ওপর অভিঘাত ধারণা জরিপ’ প্রকাশ করেছে। এই জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, করোনার সময়ে আর্থিক সঙ্কটে পড়া ৪৬ দশমিক ২২ শতাংশ পরিবার জমানো টাকা খরচ করে সংসার চালিয়েছে। আর ৪৩ শতাংশের বেশি পরিবার আত্মীয়স্বজনের সাহায্য-সহায়তায় টিকে ছিলেন। মাত্র ২১ শতাংশ পরিবার সরকারি ত্রাণ বা অনুদান পেয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) পরিচালক (প্রোগ্রাম ও ইনফরমেশন) কোহিনূর মাহমুদ ইনকিলাবকে বলেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত সারা দেশের প্রায় এক কোটি লোক কাজ হারিয়েছেন। আর তৈরী পোশাক খাতে কাজ হারিয়েছেন এক লাখেরও বেশি লোক।
সিপিডি ও ব্র্যাকের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩৬ শতাংশ লোক চাকরি বা কাজের সুযোগ হারিয়েছেন। ৩ শতাংশ লোকের চাকরি থাকলেও বেতন পাননি। আর দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে যারা কাজ করেন, তাদের ৬২ ভাগই কাজের সুযোগ হারিয়েছেন। করোনার কারণে ঢাকা জেলার মানুষের আয় কমেছে ৬০ ভাগ। এরই মধ্যে সারা দেশে কম করে হলেও আরো নতুন করে পাঁচ কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে নেমে গেছে। যারা আগে নিম্নমধ্যবিত্ত ছিলেন, ছোট চাকরি বা ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন তাদের একটি বড় অংশের বসবাস ঢাকা শহরে। করোনা মহামারির কারণে চাকরি হারিয়ে, ব্যবসা হারিয়ে তাদের অনেকেই ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। দেশের ১০ কোটি ২২ লাখ মানুষ অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত দুর্বলতার ঝুঁকিতে পড়েছে। ১৪ লাখেরও বেশি প্রবাসী শ্রমিক চাকরি হারিয়ে গ্রামে ফিরে গেছেন। ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন পরিচালক কে এ এম মোরশেদ বলেন, শহর ছেড়ে গ্রামে যাওয়া মানুষের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে।
ভাড়াটিয়া পরিষদের হিসাব অনুযায়ী, গত মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকার সাড়ে ৫ লাখ ভাড়াটিয়া বাসা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। এই সাড়ে পাঁচ লাখ পরিবারের গড়ে ৪ জন করে সদস্য হলেও ঢাকা ছেড়েছে ২২ লাখ মানুষ। এছাড়া আরো অনেক মানুষ আগের বাসা ছেড়ে দিয়ে কম ভাড়ার বাসায় উঠেছেন বা ওঠার চেষ্টা করছেন। যারা ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকায় ভাড়া থাকতেন তারা এখন নয়-দশ হাজার টাকার ভাড়া বাসা খুঁজছেন। যাদের মাসে আয় ২৫-৩০ হাজার টাকা তাদের এখন এই শহরে টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ সমস্যা সমাধানে এখন সবচেয়ে যেটা জরুরি তা হলো- বাজারে পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি ও সরকারিভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। এছাড়া করোনা সঙ্কট মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন ও সহায়তা কর্মসূচিগুলো অব্যাহত রাখা জরুরি।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান ইনকিলাবকে বলেন, ‘বৃষ্টি, বন্যা ও ফেরি বন্ধ হওয়াসহ নানা কারণে সবজির দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। দাম অস্বাভাবিক হওয়াতে সবার নাভিশ্বাস উঠেছে। করোনার কারণে যখন সবার আয় কমেছে, তখন সব জিনিসের দাম বেড়েছে। এটা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। অতি মুনাফাখোরদের নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ব্যবস্থা না থাকার কারণে সীমিত আয়ের মানুষ কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন