বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

তিস্তা এখন ধুধু মরুভূমি

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৭ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০২ এএম

‘ত্রাণ চাই না তিস্তার খনন চাই’ গত পহেলা নভেম্বর তিস্তা নদীর দুই পাড়ে প্রায় ২৩০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। বন্যার সময় নদীভাঙন আর শুস্ক মৌসুমে পানির অভাবে তিস্তাপাড়ের মানুষের দুর্ভোগের শেষ থাকে না। সে লক্ষ্যেই নদীপাড়ের মানুষের দাবি ত্রাণের বদলে নদী খনন করে স্থায়ীভাবে কোটি মানুষের দুর্ভোগের লাঘব। ওই মনবন্ধনের এক সাপ্তাহ না যেতেই পানির অভাবে সর্বগ্রাসী তিস্তার বিভিন্ন পয়েন্ট এখন ধুধু মরুভূমিতে পরিণত হয়ে গেছে।
মূলত এক মাস আগেও তিস্তায় ভেসেছে জনপদ। নদী ভাঙনে গ্রাস করেছে গ্রামের পর গ্রাম। বন্যা আর নদীভাঙনে কেড়েছে কৃষকের স্বপ্ন। কিন্তু মাস ঘুরতেই পানির অভাবে সেই সর্বনাশী তিস্তা এখন শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে। পলি ভরাট হয়ে ধু-ধু বালুচরের তিস্তার কয়েকটি পয়েন্টে এখন হেঁটেই পার হওয়া যায়।
তিস্তা ব্যারাজের মোট ৫২টি গেটের মধ্যে ৪৫টি বন্ধ করে উজানের পানি আটকানোর চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ। এতে করে যেটুকু পানি উজানে জমছে তাতেই ব্যারাজটির বাকি ৭টি গেটের মাধ্যমে সেচ কার্যক্রম পরিচালিত হবে। সরেজমিনে তিস্তা অববাহিকা এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, রংপুর, লালমনির হাটের কয়েকটি পয়েন্টে তিস্তার বুক জুড়ে ধু-ধু বালুচর। বন্যার ক্ষত না মুছতেই তিস্তার এই পরিণতি দেখে হতাশ নদীপাড়ের লাখো কৃষক-ক্ষেতমজুর। তিস্তার নাব্যতা এতটাই হ্রাস পেয়েছে যে আসন্ন রবি মৌসুমে তিস্তা ব্যারাজের সেচ কার্যক্রম চালানো কঠিন হয়ে পড়বে।
এখন কার্তিক মাস। চৈত্র মাসের আরো প্রায় ৫ মাস বাকি। এখনই প্রতিদিনই নদীতে পানি কমছে। কোথাও সামান্য পানি আবার কোথাও দিগন্তজোড়া বালুচর। পায়ে হেঁটে পার হওয়া যাচ্ছে নদী। তিস্তা ব্যারাজ থেকে শুরু করে তিস্তার ১৬৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পানি না থাকায় শঙ্কায় পড়েছেন হাজারও কৃষক।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া ডিভিশনের কৃষি স¤প্রসারণ কর্মকর্তা রাফিউল বারী জানান, তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের আওতায় আগামী ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সেচ কার্যক্রম শুরু হবে। তবে পানি প্রবাহ দেখে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হবে।
লালমনিরহাটের দোয়ানীতে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তিস্তা সেচ প্রকল্প চালু হয় ১৯৯৮ সালে। নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ১২টি উপজেলার ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়ার কথা এই প্রকল্পের মাদ্যমে। কিন্তু উজানে ভারত পানি প্রবাহ অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ায় সেটা সম্ভব হয় না।
জানা গেছে, ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ২০১১ সালে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার কারণে স্থগিত হয়ে যায়। তবে গত বছর ভারত ঠিকই চুক্তির মাধ্যমে ফেনী নদীর পানি ত্রিপুরায় নিয়ে যায়। ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় একদিকে বর্ষা মৌসুমে ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে; ভাঙছে কৃষকের কষ্টে গড়া ফসলের ক্ষেত; কষ্টে দিনাতিপাত করা দিনমজুরের তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নের বসতবাড়ী। অপরদিকে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা ব্যারাজের ভাটিতে ভারত তাদের গোজলডোবা বাঁধের সাহায্যে একতরফাভাবে পানি আটকে বাংলাদেশের উত্তর জনপদের লাখ লাখ কৃষকের চাষাবাদ ব্যাহত করছে। ফলে দিন দিন প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে দেশের বৃহত্তম তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পটি।
এতে করে এ অঞ্চলের কৃষকের চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার রেখা দেখা দিয়েছে স্পষ্টতই। এই অবস্থায় পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করে তিস্তা নদী বাঁচানোর আকুতি জানিয়েছে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজাপুরসহ সেচ নির্ভর মানুষজন।
মূলত হিমালয়ের পূর্বাঞ্চলে জন্ম নিয়ে তিস্তা প্রথমে ভারতের সিকিম রাজ্যের ভিতর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে এসে মিশেছে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে। ৩১৫ কিলোমিটার তিস্তার বাংলাদেশে প্রায় ১১৫ কিলোমিটার। প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ তাদের জীবনজীবিকা ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য নির্ভর করেন তিস্তার ওপর। ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রিস্টোরেশন প্রজেক্ট’ বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এ জন্য ৯৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার ঋণ চেয়েছে চীনের কাছে। এই প্রকল্পের জন্য ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বরে একটি বাধ্যতামূলক নয় এমন একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়না (পাওয়ার চায়না)।
এরপর এ প্রকল্পের একটি মাস্টারপ্লান এবং উপযোগিতা বিষয়ক পর্যবেক্ষণ জমা দিয়েছে পাওয়ার চায়না। প্রাইমারি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোপোজালে বলা হয়, তিস্তা নদীর উভয় পাশে পুরো ১০০ কিলোমিটারে তীর মেরামত বা বাঁধ দেয়া হবে। সীমান্তে ভারতের কাছে যেখানে বাংলাদেশে এই নদী প্রবেশ করেছে সেখান থেকে শুরু করে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত এই বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে নদীর তীররক্ষা প্রকল্প। গ্রোয়েন নির্মাণ করে নদীভাঙন রক্ষা। তবে সবার আগে এই প্রকল্পে ড্রেজিং করা হবে এবং পুরো ১১০ কিলোমিটার তিস্তা নদীকে আরো গভীর করা হবে। ভারত এই প্রকল্পের বিরোধিতা করলেও চীনের সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবিতেই তিস্তা পাড়ের মানুষ মানববন্ধন করে।
তিস্তাপারের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ধুধু বালুচর দেখা যায়। জেগে ওঠা শতাধিক ধুধু বালুচরে বাধ্য হয়েই কৃষকরা ভুট্টা, পিঁয়াজ, শাকসবজি, আলু, চিনাবাদাম, মিষ্টিকুমড়া ও তরমুজ চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিস্তা নদীতে পানি কম থাকায় জেলেরা বেকার হয়ে পড়েছেন। তিস্তায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা লালমনিরহাট জেলার গড্ডিমারী ইউনিয়নের সীমান্ত বাজারে আকবার হোসেন বলেন, গত মাস থেকে নদীর পানি কমতে থাকায় নদীতে আর মাছের দেখা মেলে না। তাই কয়েক মাস পরিবার নিয়ে কষ্টে কাটাতে হবে।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান জানান, চায়না পাওয়ার কোম্পানি দুই বছর ধরে তিস্তা পাড়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহাপরিকল্পনায় নির্মাণকৃত প্রকল্প বাস্তবায়নে নকশা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করছে। তারা সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে চৌচির হয়ে পড়ে তিস্তা নদী। জেগে ওঠে অসংখ্য চর। বর্ষায় পানির ঢল নামায় নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে বন্যার সৃষ্টি হয়। এখন দাবি একটাই তিস্তার শাসন ও বাঁধ নির্মাণ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (4)
parvez ৭ নভেম্বর, ২০২০, ৬:১৯ এএম says : 0
" ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ২০১১ সালে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার কারণে স্থগিত হয়ে যায়। তবে গত বছর ভারত ঠিকই চুক্তির মাধ্যমে ফেনী নদীর পানি ত্রিপুরায় নিয়ে যায়। ......." সাব্বাশ ! আমাদের বর্তমান সরকার।
Total Reply(0)
Jack Ali ৭ নভেম্বর, ২০২০, ৮:৪৩ পিএম says : 0
Because they are our best friend but Allah says Musrik's are one of the greatest enemy of Muslim.. After Jew and Christian.
Total Reply(0)
Md Farhad Ahmed ৭ নভেম্বর, ২০২০, ৯:০৪ পিএম says : 0
আমাদের তিস্তা পাড়ের মানুষের একটাই দাবি দ্রুত তিস্তার কাজ হোক....
Total Reply(0)
Faruk ৮ নভেম্বর, ২০২০, ৬:১০ পিএম says : 0
দ্রুত মহাপিকল্পনার বাস্তবায়ন চাই
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন