মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

নদ-নদীর পানি ধরে রাখার প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৮ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

মাসখানেক আগেও নদ-নদীর পানি ছাপিয়ে দেশ ভয়াবহ বন্যার কবলে ছিল। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরপরই দেখা যাচ্ছে নদ-নদী স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে। পুরোপুরি শুষ্ক মৌসুম শুরু না হতেই পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের নদ-নদী শুকিয়ে এমনই অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, কোনো কোনো নদীর মধ্যভাগ পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া যায়। উত্তরবঙ্গের প্রাণ হিসেবে পরিচিত তিস্তা বন্যার সময় যে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল, তা এখন শুকিয়ে ধুধু বালুচরে পরিণত হয়েছে। বন্যায় এই তিস্তা কিনা করেছে! ভাঙ্গনে গ্রামের পর গ্রাম গ্রাস করেছে, ফসলি জমি থেকে শুরু করে বসতভিটা বিলীন করে দিয়েছে। একমাস আগে তিস্তার এমন তান্ডব ছিল, তা এখন দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই। নদীটি মরে এখন খা খা করছে। এর জয়াগায় জয়াগায় ধুধু বালুচর। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রংপুর ও লালমনিরহাটের কয়েকটি পয়েন্টে তিস্তার বুক জুড়ে বালুচর জেগেছে। এর নাব্য এতটাই হ্রাস পেয়েছে যে আসন্ন রবি মৌসুমে ব্যারেজের সেচ কার্যক্রম চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই পানিপ্রবাহ কমছে। পায়ে হেঁটে নদীটি পার হওয়া যাচ্ছে। ব্যারেজ থেকে শুরু করে ১৬৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পানি না থাকায় হাজার হাজার কৃষক শঙ্কায় পড়েছে। তিস্তার পানির জন্য গত ১ নভেম্বর তিস্তাপাড়ের মানুষ ২৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ‘ত্রাণ চাই না, তিস্তার খনন চাই’ স্লােগান নিয়ে মানববন্ধন করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড তিস্তা ব্যারেজের ৫২টি গোটের মধ্যে ৪৫টি বন্ধ করে উজানের পানি আটকানোর চেষ্টা করছে। তাতে খুব একটা কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। এর মূল কারণ হচ্ছে, উজান থেকে একতরফাভাবে ভারতের পানি প্রত্যাহার করে নেয়া।

বহু বছর ধরেই দেশের উত্তরাঞ্চলে তিস্তা জীবন-মরণ সমস্যা হয়ে রয়েছে। বর্ষায় বন্যা কবলিত হওয়া ও ভাঙ্গনের শিকার হওয়া এবং শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে খাক হয়ে যাওয়ার কারণে মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এতে লালমনিরহাট, নীলফামারি, রংপুর ও দিনাজপুরের ২ কোটি ১০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ব্যাহত হচ্ছে। এ সমস্যা উত্তরণে ভারতের সাথে ২০১১ সালে তিস্তা চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে তা আজও আলোর মুখ দেখেনি। ভারত সরকারও বিভিন্ন সময়ে করব, করছি করে কেবল আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে। অথচ এ চুক্তি বাস্তবায়ন না করে এর মধ্যেই ভারত বাংলাদেশের সাথে চুক্তির মাধ্যমে ফেনী নদী থেকে ত্রিপুরায় পানি নিয়ে যাচ্ছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, তিস্তা হিমালয়ের পূর্বাঞ্চলে জন্ম নিয়ে ভারতের সিকিম রাজ্যের ভেতর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশেছে। ৩১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে নদীটির ১১৫ কিলোমিটার বাংলাদেশে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, অভিন্ন নদীর পানি উভয় দেশ সমান হারে পাওয়ার কথা থাকলেও ভারত এ আইনের কোনো তোয়াক্কা করছে না। যে ৫৪টি অভিন্ন নদ-নদী রয়েছে তার কোনো না কোনোটিতে বাঁধ, গ্রোয়েন নির্মাণ করে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশকে ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করছে। উত্তরবঙ্গের জন্য তিস্তার পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে পর্যাপ্ত পানি না থাকলে পুরো অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা অচল হয়ে পড়ে। ভারত তার অংশে গজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশকে বছরের পর বছর ধরে বঞ্চিত করে চলেছে। বর্ষায় বাঁধের পানি ছেড়ে বন্যায় ডুবিয়ে দিচ্ছে, শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকে শুকিয়ে মারছে। অথচ এই তিস্তা চুক্তি সামনে ঝুলিয়ে রেখে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে তার সব দাবি-দাওয়াই আদায় করে নিয়েছে এবং নিচ্ছে। বাংলাদেশের প্রাপ্তির খাতা শূন্যই থেকে যাচ্ছে। আবার বাংলাদেশ যে নিজ উদ্যোগে তিস্তার পানি ধরে রাখার প্রকল্প হাতে নেবে তাতেও বাধ সেধে বসছে ভারত। ২০১৬ সালে ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেন্সিভ ম্যানেজম্যান্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট’ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এতে চীনের কাছ থেকে ৯৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার ঋণ চাওয়া হয়। এ প্রকল্পের আওতায় সীমান্তে ভারতের কাছে যেখান দিয়ে তিস্তা প্রবেশ করেছে সেখান থেকে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত তিস্তা নদীর উভয় পাশে ১০০ কিলোমিটার তীর মেরামত বা বাঁধ দেয়া, গ্রোয়েন নির্মাণ করে নদীভাঙ্গন ঠেকানো এবং নদীর গভীরতার বৃদ্ধিতে ড্রেজিং করার প্রস্তাব রয়েছে। এ প্রকল্পেও ভারত বিরোধিতা করেছে। ফলে প্রকল্পটি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। চীনের সঙ্গে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবীতে তিস্তা পাড়ের মানুষ মানববন্ধন করে। উল্লেখ্য, এর আগে রাজবাড়ি পাংশায় ৩২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বিকল্প গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের উদ্যোগও ভারতের আপত্তিতে স্থগিত হয়ে যায়।

ভারত অভিন্ন নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে যেমন আমাদের বঞ্চিত করছে, তেমনি নদীর পানি ধরে রাখার ক্ষেত্রে আমাদের নেয়া প্রকল্প বাস্তবায়নেও বাধা দিচ্ছে। ভারতের এ আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সে একদিকে বন্ধুত্বের সোনালী অধ্যায়ের কথা বলছে, অন্যদিকে আমাদের ন্যায্য দাবী থেকে বঞ্চিত করার পাশাপাশি তার সব দাবী আদায় করে নিচ্ছে। আমরা কেবল দিয়েই যাব, বিনিময়ে কিছুই পাব না, তা কাম্য হতে পারে না। এমন অসম সম্পর্ক বিশ্বের আর কোথাও আছে কিনা আমাদের জানা নেই। আমাদের কথা হচ্ছে, দেনা-পাওনার হিসাবটি ন্যায্য ও সমতাভিত্তিক হওয়া উচিৎ। আমাদের ন্যায্য পাওনা ভারত পূরণ করবে না, এটা হতে পারে না। ভারত যেহেতু তা পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে, তাই নদ-নদীর পানি ধরে রাখার ক্ষেত্রে আমাদের উদ্যোগ আমাদেরই নিতে হবে। বাঁধ, গ্রোয়েন ও রিজার্ভার তৈরির প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে জোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে ভারতের ওজর-আপত্তি আমলে নিলে এসব প্রকল্প কোনো দিনই বাস্তবায়িত হবে না। ভুটানের মতো দেশ যদি তার অংশের নদীর পানি বন্ধ করে ভারতকে জবাব দিতে পারে, আমাদেরও উচিৎ তিস্তাসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি ধরে রাখার প্রকল্প বাস্তাবায়নের উদ্যোগী হওয়া।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন