শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার দায় রয়েছে

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ১২ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দেশের সাধারণ মানুষ এখন দিশাহারা। বিগত কয়েক মাস ধরে দ্রব্যমূল্যের বোঝায় তারা পিষ্ট। দেশের কোটি কোটি মানুষ কোনো রকমে দিনযাপন করছেন। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ সরকার অনেকটা নীরব ভূমিকা পালন করছে। মানুষের এই সীমাহীন দুঃখ, দুর্দশা ও কষ্টের জীবন তাদের যেন স্পর্শ করছে না। সাধারণ মানুষের এই কষ্টের জীবন সহনীয় করার যেন কেউ নেই। অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, সরকারের কিছু করার নেই এবং মানুষের নাভিশ্বাস উঠা জীবন সে চেয়ে চেয়ে দেখছে, উপভোগ করছে। কোনো দেশে নিয়ন্ত্রণহীন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মাসের পর মাস চলে কিনা আমাদের জানা নেই। দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় সাধারণ মানুষের এমন দুর্বিষহ জীবন নিয়ে একটি দেশ চলে কিনা, তাও জানা নেই।

দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এতটাই নিয়ন্ত্রহীন যে সকালে একরকম, বিকেলে আরেক রকম। আর একবার মূল্য বৃদ্ধি পেলে তা কমার কোনো লক্ষণ থাকে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে তা একটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। যে আলু গরিব মানুষের নিত্যদিনের খাবারের উপাদান এবং যা বারমাস কেজি প্রতি ২০ থেকে ২৫ টাকায় কেনা যায়, সেই আলুর দাম বিগত কয়েক মাস ধরে দ্বিগুণ হয়ে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কমার কোনো লক্ষণ নেই। এর ফলে খেটে খাওয়া অত্যন্ত সাধারণ মানুষ যে আলুর ভর্তা দিয়ে ভাত খাবে, তার পথও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অন্যান্য সবজির দাম গড়ে ৬০ থেকে ৭০ বা তারও উপরে। চালের দাম বৃদ্ধির তো হিসাবই নেই। এক পেঁয়াজের দাম নিয়ে মাসের পর মাস তুলকালাম কান্ড ঘটে চলেছে। এক কেজি পেঁয়াজ ১০০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। উল্টো বানিজ্যমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, ৫৫ টাকার নিচে পেঁয়াজের দাম নামানো সম্ভব নয়। তার কথা মতো পেঁয়াজের দাম কি ৫৫ টাকায় নেমেছে? নামেনি। তাহলে তার কথার মূল্য রইল কোথায়? আর যেখানে স্বয়ং বাণিজ্যমন্ত্রীই দাম নির্ধারণ করে দিয়ে বলেন, আর কমানো সম্ভব নয়, তখন সাধারণ মানুষের আফসোস করা ছাড়া আর কি উপায় থাকতে পারে? পেঁয়াজের কথা বাদ দিয়েও বলা যায়, চাল, ডাল, তেল, লবন, শাক-সবজি, কাঁচা মরিচ থেকে শুরু করে শিশুখাদ্যসহ হেন কোনো জিনিস নেই যার মূল্য নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। বাজারে গিয়ে মানুষ দিশাহারা হয়ে পড়ছে। অনেকে মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র না কিনেই বাড়ি ফিরেন। কিনলেও চাহিদার তুলনায় অর্ধেকেরও কম জিনিস কিনেন। সংসারে স্ত্রী-সন্তানদের কাছে কোনো জবাব দিতে পারেন না। কারণ, তার আয়ের সাথে ব্যয়ের হিসাব মিলাতে পারছেন না। দেখা যাচ্ছে, সংবিধানে মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রধানতম বিষয় খাদ্য সংস্থানের বিষয়টি এখন ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। সরকারের পক্ষ থেকে কেউ না খেয়ে মরছে না বললে বলা হলেও, কষ্টে পড়া মানুষের এই খাওয়া কি মানসম্পন্ন এবং তাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি জোগাতে সক্ষম হচ্ছে? মাছ-ভাত- গোশত দিয়ে খাওয়া আর আলুর ভর্তা-ডাল দিয়ে প্রতিদিন খাওয়া কি এক কথা? দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের এখন এমন পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ডাল-ভাত-আলুর ভর্তা দিয়েও খাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে।

সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, খাদ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। যদি তাই হয়, তাহলে তো বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কম কিংবা নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা। এই দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কেন? সরকার কেন তা কমাতে পারছে না? এর রহস্য কি? এর রহস্য বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকার খবরে প্রকাশিত হয় এবং হচ্ছে। এসব খবর থেকে যে মূল বিষয়টি জানা যায় তা হচ্ছে, প্রত্যেকটি ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির পেছনে ভয়ংকর সিন্ডিকেট কাজ করছে। এ সিন্ডিকেটের সাথে ক্ষমতাসীন দলের ব্যবসায়ী এবং প্রভাবশালী লোকজন জড়িত। তারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে, বন্যা ও করোনার মহামারিকে। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হয়, খাদ্যের যথেষ্ট মজুদ রয়েছে। তাহলে পণ্যের দাম কমছে না কেন? এর জবাব হচ্ছে, সিন্ডিকেট যারা ক্ষমতাসীন দলের সাথে জড়িত। সরকার এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না বা চায় না। এদের কাছে যেন সরকার অসহায় ও দুর্বল। অনেকে মনে করেন, সরকার সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত তার লোকজনকে মানুষের পকেট কাটার সুযোগ করে দিচ্ছে। যে আলুর দাম এখন ৫০ টাকা অথচ বিভিন্ন গোডাউনে আলুর পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। এই মজুদ যদি যথাযথভাবে বাজারজাত করা হয়, তাহলে আলুর দাম মানুষের সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসা সম্ভব। সরকার কেন এ কাজটি করছে না? কারণ, সরকার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে আগ্রহী নয়। সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার চেয়ে সিন্ডিকেটের অর্থ কামাই করার বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যদিও সরকার টিসিবির মাধ্যমে রাজধানীহ বিভিন্ন শহরে নামকাওয়াস্তে বা লোক দেখানো কিছু ট্রাকের মাধ্যমে কম দামে পণ্য বিক্রি করছে, তবে তাতে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির ওপর কোনো প্রভাবই ফেলছে না। অথচ সরকারের উচিৎ বাজারের পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট ও মজুদদারদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ এবং এদের সাথে জড়িতদের গ্রেফতার করে আইনানুগ শাস্তির ব্যবস্থা করা। আমরা দেখেছি, মাঝে মাঝে বাজারে ভ্রম্যমান আদালত ও র‌্যাব অভিযান চালিয়ে কিছু দোকানদারদের জরিমানা করতে। এতে যে কাজ হচ্ছে না, তা দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি থেকে বোঝা যায়। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং ভোক্তাদের কাছে সহনীয় করতে হলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মূল হোতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অভিযান চালিয়ে সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিতে হবে এবং এমন শাস্তি দিতে হবে যাতে তারা সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাহস না পায়। এক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন। জনগণের সরকার হয়ে জনগণের জন্য এ কাজ করা সরকারেরই দায়িত্ব। প্রত্যেক দেশের সরকারই এ ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। পার্শ্ববর্তী দেশে কোনো জিনিসের দাম পঁচিশ পয়সা বৃদ্ধি পেলেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থা ও রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলনে নামে। ফলে ব্যবসায়ীদের পক্ষে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করার সাহস থাকে না। বৃদ্ধি করলেও তার যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য কারণ দেখাতে হয়। দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। তারা না পারছে কিছু বলতে, না পারছে সইতে। মুখ বুঁজে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সহ্য করে যাচ্ছে। তারা যে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে কথা বলবে, সেরকম কোনো প্ল্যাটফর্মও নেই। কোথায় তারা তাদের এই দুঃখ-কষ্টের কথা বলবে? ছোট ছোট কিছু রাজনৈতিক দল দুই-চার-পাঁচজন নিয়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং করলেও সংসদ থেকে শুরু করে মাঠে যেসব বড় বড় রাজনৈতিক দল রয়েছে, তারা নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করে চলেছে। সরকার যে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং হচ্ছে এ নিয়েও কোনো মিছিল-মিটিং করতে দেখা যায় না। এসব দল তাদের গণবিচ্ছিন্ন কর্মসূচি পালনে যতটা তৎপর, জনসম্পৃক্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে একেবারেই নিশ্চুপ। অথচ তাদের রাজনীতি হওয়া উচিৎ জনগণের দুঃখ-দুর্দশার সাথে সম্পৃক্ত বিষয় নিয়ে। দুঃখের বিষয়, সরকার যেমন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে, তেমনি বৃহৎ বিরোধী দলও তা নিয়ে আন্দোলন করতে চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। তাহলে, জনগণ যাবে কোথায়? জনগণের সমস্যা নিরসনের অভিভাবক কে?

করোনা এসে পুরো বিশ্বের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিকেও বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। করোনার শুরুতে সরকার ১৯ খাতে এক লাখ ১৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকার যে প্রণোদনামূলক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য নগদ অর্থ সহায়তাও রয়েছে। এ প্রণোদনার পুরো অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহারেও প্রতিবন্ধকতার কথা পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। এতে বড় শিল্পগুলো উপকৃত হলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত তেমন উপকৃত হয়নি। যেসব প্রতিষ্ঠান প্রণোদনার টাকা পেয়েছে তাতে মোট কর্মসংস্থানের ৮ শতাংশ কর্মজীবী উপকৃত হয়েছে। করোনার কারণে কর্মসংস্থান ঝুঁকিতে থাকা ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো প্রণোদনার কথা বলা নেই। প্যাকেজগুলোর অর্ধেকের বেশিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয় উল্লেখ নেই। অর্থাৎ করোনার কারণে বেকারত্ব ঠেকাতে প্রণোদনার অর্থ তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। অন্যদিকে করোনার ধাক্কায় কোটি কোটি মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। হিসাব অনুযায়ী, দারিদ্র্যের হার দ্বিগুণ হয়ে গেছে। কোটি কোটি মানুষ দরিদ্র থেকে অতিদরিদ্রে পরিণত হয়েছে। এছাড়া গার্মেন্টসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মচারি ছাঁটাই ও বেতন কমিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, দেশে অভাবী মানুষের সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশি হয়ে গেছে। বেকারত্ব, আয় কমে যাওয়া এসব মানুষ অনেকটা মানবেতর জীবনযাপন করছে। এর মধ্যে ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে উঠেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। এতে কোটি কোটি মানুষের একবেলা বা দুই বেলা খাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এসব মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখার দায়িত্ব যার, সেই সরকা কি তা পালন করতে পারছে? সরকার তো অন্তত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যের দাম সাধ্যের মধ্যে রেখে মানুষের দুবেলা খাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারে! আমরা দেখছি, সরকার পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে অনেকটা উদাসীন হয়ে রয়েছে। তার মধ্যে কোনো বিকার নেই। যদি থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে সাধারণ মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দিতে পারত। সরকারের কি অবিলম্বে এ কাজটি করার উদ্যোগ নেয়া উচিৎ নয়?
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন