শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

নারীর পৃথিবী নিরাপদ হবে কবে?

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১৫ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

বর্তমান সময়ে ধর্ষণকান্ড সমাজের সকল স্তরে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে। নারী, যাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক, শুধু তাঁরাই নয়, আজকাল অতি অল্প বয়সের শিশুকন্যাদেরও যৌন অত্যাচারের শিকার হতে হচ্ছে। শিশু ও নারীদের গ্রাম-শহর সর্বত্র প্রতিদিন নানাভাবে এই রকমের যৌন লাঞ্ছনার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। এ নিয়ে গোটা দেশের মানুষ আজ উদ্বিগ্ন। প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে রাজধানী ঢাকাতেই শুধু নয়, দেশের আনাচে-কানাচেও। কিন্তু তাতে লাগাম টানা যাচ্ছে না। একটা ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রতিবাদী আন্দোলন জোরদারভাবে চলাকালীন সময়ে অন্য নতুন ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে আসছে। মানুষ তাতে নিশ্চিতভাবে নিশ্চুপ বসে থাকতে পারছে না। পারা সম্ভবও নয়। উচিতও নয়।

মাঝে মধ্যে কিছু পন্ডিত প্রবরের বিরূপ-বেসুরো মন্তব্যও আসছে সংবাদ মাধ্যমে, যদিও বা এদের সংখ্যা নিতান্তই কম, তথাপি ভাববার বিষয় হলো- এরা যা বলতে চান বা চাইছেন সেই বক্তব্য ধর্ষণকে সমর্থন জোগাবে। প্রকারান্তরে সহায়কও হতে পারে এ কথা বললে উত্যুক্তি করা হবে না। এটা বলাই বাহুল্য যে কোনও কাজের পিছনে সমাজের কোনও না কোনও অংশের সমর্থন না থাকলে তা বেশিদিন বা বার বার ঘটতে পারে না। তাই বাস্তবতা হলো, এ অংশ এখনও মোটামুটি শক্তি নিয়েই সমাজে বিদ্যমান রয়েছে।

এরা কারা হতে পারে? এরা কোন দর্শনে বিশ্বাসী হতে পারে? প্রথমত, যে যুগে নারী জাতিকে শুধুমাত্র ভোগের বিষয় হিসেবে গণ্য করা হতো, যেখানে নারী জাতি কেবল সন্তান উৎপাদন প্রক্রিয়ার যন্ত্র এবং যে যুগে নারীরা বাজারের অন্য পণ্যসামগ্রীর ন্যায় আরেকটি লাভজনক পণ্য, দৃঢ়ভাবে এই নীতির যারা ধারক ও বাহক ওই লোকগুলো এই নীতির প্রতিনিধি। মূলত সামন্তবাদী চিন্তাধারার বাহক। সাজে-পোশাকে অত্যন্ত আধুনিক এবং শিক্ষিত ব্যক্তিরাও এর মধ্যে রয়েছেন। সুতরাং, ধর্ষণের মতো সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে সংগ্রাম এদেরও বিরুদ্ধে সচেতন প্রচার অভিযান না করে সফল হবে না। দ্বিতীয়ত, জনগণের দাবি, মহিলাদের নিরাপত্তাসহ ধর্ষণ রোধে ধর্ষণকারীদের কঠোরতম শাস্তিদানের ব্যবস্থা করতে হবে। একটা কথা উল্লেখ করা উচিত যে বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ, অন্যান্য আমলা বাহিনী ও সর্বোপরি রাজনৈতিক নেতা-জনপ্রতিনিধি কেউ আজ বাদ নেই এই ধর্ষণ তালিকা থেকে। কর্কট রোগের ন্যায় দ্রুত বিস্তার লাভ ঘটছে সমাজের সকল ক্ষেত্রে। নির্যাতিত মহিলার বয়ান থানায় নথিভুক্ত হয় না। অপরদিকে, থানার ভিতরেই ধর্ষণ হয় এইরূপ অজস্র উদাহারণ পাওয়া যায়। তৃতীয়ত, গণধর্ষণ এবং তার বীভৎস রূপ সংবাদ মাধ্যমে যখন দেখতে বা পড়তে পাওয়া যায় তখন গা শিউরে উঠে। ঘটনা ঘটার পরে রাজনৈতিক নেতাদের সংকীর্ণ স্বার্থে সেটা আড়াল করার চেষ্টা অত্যন্ত ঘৃণ্যভাবে সামনে আসছে।

মেয়েরা যেন চির উদ্বাস্তু। তাদের নিজস্ব কোনও ঠিকানা সাধারণত থাকে না। শৈশব থেকে যৌবনে তারা থাকে বাবা বা ভাইয়ের ঠিকানায়, পরে ঠিকানা বদলে স্বামী বা পুত্রের ঠিকানায়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নিজের নামে বাড়ির ঠিকানাধারী মেয়ের সংখ্যা খুবই স্বল্প। বহু বছর কেটে গেছে। বহু রক্ত ঝরানো পথ অতিক্রম করেতে হয়েছে এ ২০২০ সাল পর্যন্ত পথ আসতে নারীদের। আরও কত দিন যাবে নারীদের স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলনে, কে জানে! নারীদের অধিকার আর নারীবাদ এই দুটো অবশ্যই এক নয়। নারীর অধিকার বলতে বুঝি নারীকে তার উপযুক্ত মর্যাদাদান আর তার স্বাতন্ত্র্যকে যথাযোগ্য সম্মানদান। কতদিন আর মেয়েদের শৈশব, কৈশোর, যৌবন, এমন কি প্রৌঢ়ত্বের গোধূলি বেলাও লুণ্ঠিত হতে থাকবে নরপশুদের হাতে? শৈশবের সারল্য ধর্ষিত হওয়ার ঘটনা আমাদের চারিদিকে ক্রমে বেড়েই চলেছে। শত শত বছর ধরে সভ্যতার আলোকিত পথ বেয়ে এ কোন অন্ধকার বিপন্নতার মুখে আমরা দাঁড়িয়ে? এই বিপন্নতায় মেয়েদের একা অথবা স্বতন্ত্র পথে চলতে দিতে আমরা এখনও রাজি নই। আজকাল খবরের কাগজে মেয়েদের ক্রমাগত অত্যাচার এবং অবমাননা নিত্যদিনের খবর হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি নয় বছরের নিষ্পাপ মেয়ে দশ-বারো বছর ধরে মানসিক যুদ্ধ চালিয়ে গেছে তার আপনজন বাবা, চাচাদের আপন করে নিতে। আর সঙ্গে সঙ্গে তার মননে সাবালিকা হতে। কিন্তু হায় অদৃষ্টের পরিহাস, তাকে কিনা পাড়ার গুরুজনের ভয়ানক আদরের ফল বহন করতে হল তার শৈশবেই। এ রকম কত শত ফুলের মতো শিশু বিশেষ করে মেয়ে শিশু নিষ্পেষিত হচ্ছে ঘরে ঘরে, বেশির ভাগই লোকলজ্জার ভয়ে মুখ খোলে না। এই জন্য সব দোষ মেয়েদের পোশাক-আশাকের তা তো হতে পারে না। ছেলেদেরও অবশ্যই দায় আছে নিজের বিবেককে পরিষ্কার রাখার। কত অনায়াসেই এই সমাজে একজন কৃতবিদ্য, প্রতিষ্ঠিত মানুষ তার শিক্ষিত স্ত্রীকে মতের অমিল হলে বলতে পারে, না পোষালে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও। মেয়েদের তো নিজস্ব ঘরই নেই। এই কথাগুলো তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হজম করে নিতে পারে। হয়ত এই মানিয়ে নেওয়াটা অনায়াসসাধ্য নয়। বুকের ভেতরটা জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাক, তবুও নারীকুলকে স্বতই আপস করতে হয়। রক্তের মধ্যে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাটা বেশির ভাগ মেয়েদেরই আমাদের সমাজে আজও আছে। তাই তারা মানিয়ে নেয়। এমন কি প্রথম সন্তান মেয়ে হওয়ার পর দ্বিতীয়টিও মেয়ে হলে আজও এই নারীরা হীনমন্যতা, নিরাপত্তাহীনতা ও অপরাধবোধে ভোগে। এই আধুনিক শতাব্দীতে মেয়েরা মহাকাশচারী হচ্ছে, হিমালয় পর্বতের চূড়া জয় করছে। এই নারীই ট্রেন চালানোর মতো গুরুভার দায়িত্ব ঠিকঠাক সম্পন্ন করছে, ইলেকট্রিক লাইনের বিচ্যুতি সারানো, রক্ষণাবেক্ষণের মতো ঝুঁকিসম্পন্ন কাজ যোগ্যভাবে পালন করে শতকরা বিশ ভাগ রাজস্ব বাড়িয়েছে। তাহলে কেন নারীকে সে স্বল্পশিক্ষিত/উচ্চশিক্ষিত যাই হোক না কেন হীনমন্যতায় ভুগতে হবে? সেই হীনমন্যতাবোধও আসছে পরিবার-পরিজনদের কাছ থেকেই। একটি বিবাহিত পুরুষ যখন এই সমাজে অন্য নারীর সঙ্গে দ্বিচারী, তখনও এই অন্য নারীকেই অপরাধের দায়ভার বহন করতে হয়। পুরুষটি অনায়াসে বুক ফুলিয়ে প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়ায়।

বর্তমান সময়ে মানবসম্পদ উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সরকারি সমীক্ষা নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্যের ব্যাপকতা নির্ণয়ে সাহায্য করছে প্রভূতভাবে। এই সুবাদেই উপযুক্ত পলিসি নেওয়া হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে হয়ত আরও হবে। খানা আয়, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে উন্নতির পরিমাপের সূচক হিসাবে ধরা হয়। অবশ্যই এই ক্ষেত্রগুলোর বাইরেও যে সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয় মেয়েরা, সেই হিসাবে এখানে আসছে না। স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রের তথ্য অনুযায়ী, এ দেশের মেয়েরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে বেশি মাত্রায়। রক্তাপ্লতায় ভোগার হার শহরের চেয়ে গ্রামেই বেশি। শতকরা সত্তর ভাগ নারীই কোনও না কোনও ধরনের রক্তাপ্লতায় ভুগছে। তথ্য মতে, সামগ্রিকভাবে দেশের মধ্যে শিশু উৎপীড়নে শহরের স্থান প্রথম। দ্য টেলিগ্রাফ কাগজের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে যৌন বিকৃতির শতকরা হারে বাংলাদেশ শীর্ষে এবং উদ্বেগজনকভাবে মেয়ে শিশুদের উৎপীড়নের মাত্রাটাও এ দেশে তুলনামূলকভাবে বেশি।

২০২০ সালে এসেও আমরা আশাবাদী। সেইদিন অবশ্যই আসবে, যে দিন মানুষ তার অন্তরের আলোয় উদ্ভাসিত হবে। অবশ্যই এখানে নারীদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। অবশ্যই তাদের শুধুই মেয়ে মানুষ না ভেবে পূর্ণ মানুষ ভাবার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে আমাদের। আশান্বিত হই, যখন দেখি সিলেটের এক কিশোরী বিয়ের বয়স না হওয়ায় প্রতিবাদ করে বিয়ের মজলিস থেকে উঠে গেছে। সেই দিন অবশ্যই আসবে, যে দিন মেয়েদের জন্যে কোনও সংরক্ষণের প্রয়োজন হবে না। সেই আশাতেই বলি, ‘আয়রে নতুন আয়/সঙ্গে করে নিয়ে আয়/তোর সুখ তোর হাসি গান।’ পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি ব্যাধির শিকার নারীরা। গলব্লাডারে স্টোন, ওভারিয়ান স্টিট, টিউমার, অ্যাপেনডিক্স, বেস্ট ক্যানসার কত যে রোগ আর অপারেশন নারীর ললাট লিখন এই সমস্ত ড্যাম্প এরিয়ায়। এর উপর আবার যদি সন্তান জন্মদানও অযথা অপারেশনের মাধ্যমে হয় তবে আমরা নারীরা শুধু বলব ‘একটু চেষ্টা করুন না, যদি নর্মাল হয়। কারণ এর পরবর্তী দীর্ঘ সময় মাকে স্তনদান ও শিশুপালনের অপরিসীম কষ্ট এবং চাকুরির বৃহত্তম কর্তব্যকে আজকাল যৌথভাবে সামলাতে হয়।

সরকারি সুবিধায় ‘আদরিণী’, ‘মা-মণি’, কন্যাসন্তান জন্মদানে আর্থিক সহায়তা কত কী মায়েরা পেয়ে থাকেন। কিন্তু সন্তান জন্মদানের ব্যয়ভার এখন অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। সন্তান যদি নিজ শক্তিতে জন্ম নেয় তবে মায়ের শরীর থেকে অণুজীবাণু পায় যা তার রোগ প্রতিরোধে সহায়ক। আর মধ্যখানে আরেক কথা, সন্তান জন্মাবার আগে অজস্র টেস্ট করানো, সনোগ্রাফি এসবেই ব্যস্ততর হয়ে থাকতে হয়। আচ্ছা, মাছ তো হাজারটা ডিম দেয়, সি-হর্স তিনটা বাচ্চা দেয়। বিড়াল গর্ভবতী হলে ক্যালশিয়াম খায় না, তার আয়রন টেবলেটের প্রয়োজন হয় না। এ কি আজগুবি কথা? মোটেই না! উপজাতীয় নারীরা সন্তান জন্মদানের পর চাষবাসের কাজও করে বলে শোনা যায়। আমার পরিচিত এক বাড়ির কাজের মহিলা তো ঘরে পাঁচটি সন্তান প্রসব করেছেন। প্রসবকালে ধাইরা মায়ের শরীরে হাত পর্যন্ত ছোঁয়াতেন না। এত চিকিৎসা, টীকাকরণ, তবুও নবজাতক ও শিশুমৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে কি?
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Jack Ali ১৫ নভেম্বর, ২০২০, ১১:৩৩ এএম says : 0
No body talked about root cause.. root cause is that man made law encourage to commits every kind of heinous crime. Where as Allah law prohibit all kind of heinous crime, so we must rule our country by the Law of our Creator only then all the crime will stop.
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন