শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

উপকূলে আরেক বিভীষিকার সাক্ষী হয়ে ভয়াল সিডরের কালো রাত্রি আজ

নাছিম উল আলম | প্রকাশের সময় : ১৫ নভেম্বর, ২০২০, ৯:২২ এএম

ইতিহাসের ভয়াবহ প্রাকৃতিক ধ্বংসলীলা ‘সিডর’এর কালো রাত্রি আজ। ২০০৭-এর ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যার পরে বঙ্গোপসাগরের জোয়ারে ভর করে প্রায় পৌনে ৩শ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ দেশের উপকূল ভাগের ১০টি জেলাকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল। সে ঘূর্ণিঝড়ে প্রাক-প্রস্তুতি ও আগাম সতর্কতা থাকায় প্রানহানীর সংখ্যা যথেষ্ঠ হ্রাস পেলেও সম্পদের ক্ষতির পরিমান ছিল প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। সরকারী হিসবে যা ১৬হাজার কোটি বলে সেনা সমর্থিত তৎকালীন কথিত তত্ববধায়ক সরকার জানিয়েছিল। সরকারী হিসেবে মৃতের সংখ্যা ৩ সহশ্রাধীক হলেও আরো প্রায় দুহাজার নিখোজের আর সন্ধান মেলেনি। প্রায় ২৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছাসে তাদের ঠাই হয়েছিল না ফেরার দেশে।
আবহাওয়া দপ্তর ২০০৭-এর ১১ নভম্বর দুপুর ১২টায় দক্ষিন বঙ্গোপসাগরের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রায় ২শ কিলোমিটার ভাটিতে একটি লঘুচাপ সনাক্তের পরে তা ক্রমশ উত্তরÑপশ্চিমে অগ্রসর হয়। ১৩নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় লঘুচাপটি আন্দামান থেকে প্রায় ৫শ কিলোটিার পূর্ব দিক দিয়ে সোজা উত্তরে অগ্রসর হয়। লঘুচাপটি নিম্নচাপ থেকে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নিয়ে ক্রমশ উত্তর দিকে বাংলাদেশÑভারত সীমান্ত উপক’ল বরাবর অগ্রসর হয়। ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশ উপক’লের ৫শ কিলোমিটার দক্ষিন দিয়ে ক্রমশ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মাঝ বরাবর রায়মঙ্গলÑহাড়িয়াভাঙ্গা উপক’ল সোজা অগ্রসর হচ্ছিল। ১৫নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় ঘূর্ণিঝড় সিডর বাংলাদেশের দক্ষিনÑপশ্চিম উপক’লের ১শ কিলোমিটারের মধ্যে চলে আসে। ঝড়টি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের উপক’লীয় সুন্দরবন এলাকা অতিক্রম করবে বলে মনে করা হলেও আকষ্মিকভাবে তার গতিপথ উত্তরমুখি থেকে উত্তরÑপূর্বমুখি হতে শুরু করে।
সন্ধ্যা ৬টার পরেই ঝড়টি সাগরের জোয়ারে ভর করে আরো দ্রুত গতিতে উত্তরÑপূর্বমুখি হয়ে ভারতÑবাংলাদেশের দক্ষিন-পশ্চিম সীমান্ত থেকে প্রায় ৩শ কিলোমিটার পূর্বে বরগুনা এবং বাগেরহাটের মধ্যবর্তি হরিণঘাটা-বুড়িশ্বর ও বিশখালী নদীর বঙ্গোপসাগর মোহনা দিয়ে মূল ভূখন্ডে অগ্রসর হতে শুরু করে। এসময় সিডরের গতি ছিল প্রায় পৌনে ৩শ কিলোমিটার। ঝড়টির ব্যাপ্তি মাত্র দেড়শ কিলোমিটারে সীমাবদ্ধ থাকলেও তার দৈর্ঘ ছিল অনেক দীর্ঘ। সাগরপাড়ের হরিণঘাটাÑপাথরঘাটা থেকে প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার উত্তরে বরিশাল পর্যন্ত একই সাথে প্রায় সমান তীব্রতায় সিডর নারকীয় তান্ডব চালায়। এমনকি খোদ বরিশাল মহানগরীতেও ঝড়টির তীব্রতা ছিল ২২৪ কিলোমিটার। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত পশ্চিমে বাগেরহটের মোড়েলগঞ্জ, শরনখোলা, রামপাল থেকে বরিশাল হয়ে মাদারীপুর, শরিয়তপুর ও গোপালগঞ্জ পর্যন্ত সিডরের বিভিষিকা অব্যাহত ছিল। পৌনে ৩শ কিলোমিটার বেগের ঝড়ের সাথে ২০Ñ২৫ফুট উচ্চতার জলোচ্ছাস উপক’লের বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরিশাল, ঝালকাঠী ও পিরোজপুরের বিশাল জনপদ সহ ফসলী জমি লন্ডভন্ড হয়ে যায়।
সেদিনের ঐ ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় দেশের উপক’লীয় ও দক্ষিনাঞ্চলের ৩০টি জেলায় কম-বেশী আঘাত হানলেও ৭টি জেলার ২শ উপজেলার প্রায় সাড়ে ১৭শ ইউনিয়ন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সরকারী হিসেবেই ক্ষতিগস্থ পরিবারের সংখ্যা ১৭ লাখ ৭৩ হাজার বলা হলেও বাস্তবে তা ছিল ২০ লাখেরও বেশী। আর ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সংখ্যাও ছিল প্রায় পৌনে ১ কোটি। সরকারীভাবে ৩ হাজার ১৯৯ জনের মৃত্যু ও ১ হাজার ৭২৬ জনের নিখোজের কথা বলা হলেও নিখোজের সংখ্যাও ছিল অনেক বেশী। বেশীরভাগ নিখোজদের আর কোন সন্ধান না মেলায় স্বজনেরা নিকটজনের লাশটিও আর দেখতে পায়নি।
২০০৭-এর সিডরের তান্ডবে দক্ষিন উপক’লের বিশাল জনপদের প্রায় ৪ লাখ ঘরবাড়ী সম্পূর্ণ ও আরো প্রায় ১০ লাখ আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। একই সাথে প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমির আমন ফসল সম্পূর্ণ ও আরো ৫ লাখ হেক্টর আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। প্রায় ৫০ লাখ গবাদী পশু ও হাঁস-মুরগীর মৃত্যু ঘটে সিডরের রাতে প্রকৃতির কালো থাবায়।
পরিবেশবীদদের মতে, প্রকৃতির ঐ তান্ডব সেদিন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রুখে দাড়িয়েছিল প্রকৃতিই। সেদিন সিডরের তান্ডবে ক্ষয়ক্ষতি আরো ভয়াবহ হতে পারত, যদি উপক’লীয় সোয়া দু লাখ হেক্টরের বিশাল সবুজ বেষ্টনী ও পারিকল্পিত বনায়ন না থাকত। পাশাপাশি প্রকৃতির অপার দান আমাদের সুন্দরবন সে রাতে সিডরকে বুক পেতে মোকাবেলা করে। প্রকৃতির ঐ তান্ডব সামাল দিতে সে রাত উপক’লীয় বনায়ন কর্মসূচী ও সবুজ বেষ্টনীর লক্ষ লক্ষ গাছ ছাড়াও সাধারন মানুষের প্রায় ১ কোটি গাছ মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল। সুন্দরবনের ক্ষতিও ছিল ব্যাপক।
এছাড়াও উপক’লীয় এলাকার প্রায় পৌনে ৭শ কিলোমিটার আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়ক সহ পল্ল¬ী যোগাযোগ অবকাঠামো সম্পূর্ণ এবং প্রায় ৯০ হাজার কিলোমিটার গ্রামীন সড়ক আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বিধ্বস্ত এলাকার প্রায় ১৮শ সরকারীÑবেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ও প্রায় সাড় ৬ হাজার আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের ১,৬৫৪টি সেতু এবং কালভার্ট সম্পূর্ণ ও প্রায় ৯শটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
সিডরের পরদিন সকাল থেকেই স্থানীয় প্রশাসন ছাড়াও বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর জওয়ানরা উদ্ধারর তৎপড়তা শুরু করেন। রেড ক্রিসেন্ট-এর ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচী-সিপিপি‘র সেসময়ের ৪০ সহশ্রাধীক সেচ্ছাসেবক সিডরের দিন সকাল থেকে উপক’লের কয়েকলাখ মানুষকে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে স্থানন্তর সহ দূর্যোগ পরবর্তি উদ্ধার তৎপড়তায়ও অংশ নেয়। ১৭ নভেম্বরের মধ্যে দূর্যোগ কবলিত বেশীরভাগ এলাকায় সেনাবাহিনী ও রেড ক্রিসেন্টের সেচ্ছাসেবকগন পৌছতে সক্ষম হন। তারা দূর্গত এলাকায় উদ্ধার তৎপড়তার পাশাপাশি কিছু ত্রান বিতরনও শুরু করেন। ১৬ নভেম্বর রাতের মধ্যে বরিশালÑফরিদপুরÑঢাকা জাতীয় মহাসড়কটি যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা সম্ভব হয়। ১৮ নভেম্বর বরিশালÑপটুয়াখালীÑকুয়াকাটা ও বরিশালÑবরগুনা মহাসড়কে ফেরি বিহীনভাবে যানবাহন চলাচল শুরু হলেও পরিপূর্ণ সড়ক পরিবহন পুণর্বহাল করতে আরো দিন পনের পেরিয়ে যায়। বিদ্যুৎ ব্যবস্থার পূণর্বাশনে প্রায় আড়াই মাস সময় লেগেছিল।
প্রথমদিকে আকাশপথেই ত্রান কার্যক্রম শুরু করে সেনা ও বিমান বাহিনী। সাথে বাংলাদেশ নৌবাহিনীও উপকূলের দূর্গম ও বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোতে ত্রান তৎপড়তায় অংশ নেয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহায়তায় স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসন প্রথমে ত্রান তৎপড়তা শুরু করলেও পরবর্তিতে দেশীÑবিদেশী বিভিন্ন পর্যায় থেকেও ত্রান ও পূণর্বাশন কার্যক্রম শুরু হয়।
তবে সিডর উত্তরকালে প্রায় ৪০টি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা সাহায্যÑসহযোগীতার আশ্বাস দিলেও পরবর্তিতে ৩২টি দেশ আর কোন সারা দেয়নি। এমনকি ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও পরবর্তি প্রেসিডেন্ট প্রনব মুখার্জীও বরিশাল বিমান বন্দর হয়ে শরনখোলার ঘূর্ণি উপদ্রƒত এলাকা সফর করে সেখানের কয়েকটি গ্রামের দূর্গতদের ঘরবাড়ী নির্মান করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তার বাস্তবায়ন হয় ২০০৯-এ নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহনেরও প্রায় দেড় বছর পরে। পাাকিস্তান সেদিন বাংলাদেশের ঘূর্ণি উপদ্রুত এলাকায় তার বিমান বাহিনী ও সেনা বাহিনীর সদস্যদের পাঠিয়ে বিশুদ্ধ পানি সরবারহ এবং চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম গ্রহণ করছিল। পাক বিমান বাহিনীর ৪টি ‘সি-১১০’ পরিবহন বিমান দুদিনে বরিশাল বিমান বন্দরে ত্রান ও উদ্ধারকারী দল নিয়ে অবতরন করে। দুটি ভ্রাম্যমান হাসপাতাল সহ পাক সম্মিলিত বাহিনী পিরোজপুরে চিকিৎসা সহায়তা কার্যক্রম সহ বিশুদ্ধ পানি সরবারহেও অংশ নেয়।
একই সাথে মার্কিন মেরিন সেনারাও ঘূর্ণি উপদ্রুত উপক’লীয় এলাকাতে পানি সরবারহ ও চিকিৎসা সেবা কার্যক্রমে অংশ গ্রহন করেছিল। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তি কৃষি পূণর্বাশন ও কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে ইউএসএইড মাঠ পর্যায়ে গুটি ইউরিয়া উৎপাদন ও প্রয়োগে সহায়তা করে। ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যায় হ্রাস সহ অধীক ফসল উৎপাদনে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে।
তৎকালীর তত্বধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল(অবঃ) এম এ মতিনের নেতৃত্বে বরিশাল বিমান বন্দরে সমন্বয় সেল স্থাপন করে ঘূর্ণি উপদ্রুত উপক’লীয় এলাকায় ত্রান ও উদ্ধার তৎপড়তা পরিচালিত হয়।
সিডরে কালো রাত্রির সে ভয়াল দূর্যোগ গোটা উপক’লবাশীকে আজো তাড়া করে ফিরছে। স্বজন হারাদের আর্তনাদে উপক’লের বাতাস এখনো ভারি হয়ে ওঠে। জীবনমানে পিছিয়ে পড়া স্বজনহারা সাগর উপক’লের অনেক মানুষের চোখে আজো চরম হতাশার সাথে অবশিষ্ট আছে শুধু সাগরের গর্জন। তারপরেও প্রকৃতির একের পর এক রুদ্র রোষ থেকে বেঁচে যাওয়া উপক’লের মানুষেরা ঝড়-জলোচ্ছাসের সাথে লড়াই করেই টিকে আছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন