বাইচের সাথে (দলবদ্ধ হয়ে) মাছ শিকারের যে আনন্দ তা অন্য কিছুতে পাই না। তাইতো প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এভাবেই মাছ শিকার করে যাচ্ছি। যতোদিন গায়ে বল (শরীরে শক্তি) থাকবে ততোদিন এভাবে মাছ ধরার ইচ্ছা রয়েছে। কথা গুলো বলছিলেন পলো (মাছ ধরার বিশেষ ধরণের ফাঁদ) দিয়ে মাছ শিকার করতে আসা টাঙ্গাইল সদর উপজেলার করটিয়া ইউনিয়নের হাতিলা গ্রামের পাঞ্চাশোর্ধ ধীরেন।
সম্প্রতি দরুন বীলে মাছ শিকার করতে আসেন বিভিন্ন এলাকার অন্তত দুই শতাধিক সৌখিন ও পেশাদার মৎস্য শিকারী। কারো হাতে পলো, কেউবা জাল হাতে, কেউ এসেছেন টেটা বা ফস্কা হাতে মাছ ধরতে। সেখানেই কথা হয় ধীরেনসহ ঘারিন্দা ইউনিয়নের রফিকুল, পৌর এলাকা আশেকপুরের বাদশা, জালফৈ এলাকার রহিজসহ কয়েকজনের সাথে।
তারা জানান, বর্ষার মওসুম শেষ হয়েছে। প্রতিটি বীল, ডোবা, জলাশয়গুলোর পানি প্রায় শুকিয়ে এসেছে। এসব উন্মুক্ত জলাশয়ের মাছগুলো নিচুঁ জমিতে আশ্রয় নেয়। এসময় মাছ শিকার করা খুবই সহজতর হয়। তাই আমরা দলবদ্ধ হয়ে মাছ ধরতে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ছুটে যাই। যেখানেই খবর পাই সেখানেই উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে মাছ ধরতে যাই। আমাদের হাতে ধরা পড়ে বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় অসংখ্য মাছ। সপ্তাহে দুদিন চলে আমাদের এই মাছ ধরার প্রয়াস।
ধরাট গ্রামের তোফাজ্জল হোসেন ও মৈশখোলা গ্রামের সোলায়মান বলেন, প্রতি বছর এই মওসুমে সপ্তাহের শনিবার ও মঙ্গলবার আমরা বাইচের সাথে মাছ ধরতে বের হই। যেখানেই জলাশয় পাই সেখানেই দলবদ্ধ হয়ে মাছ শিকারে নেমে পড়ি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে আমাদের এই মাছ ধরার সম্মিলিত অভিযান।
সারুটিয়া গ্রামের হিকমত ও দেলোয়ার বলেন, রুই, কাতলা, বোয়াল, শৈল, গজার মাছসহ নানা প্রজাতির ছোট-বড় মাছ ধরা পড়ে আমাদের পলো ও জালে। তবে সবাই সব সময় মাছ শিকার করতে পারে না। কোন কোন দিন কারো ভাগ্যে মাছ মেলে কারো ভাগ্যে মেলে না। তবে মাছ ধরার আনন্দ ভাগাভাগি করি সবাই মিলে।
টাঙ্গাইল সংগ্রহশালার মহাসচিব মির্জা মাসুদ রুবল বলেন, যুগ যুগ ধরেই নদী, বিলে পালা বাইচ ছিল গ্রাম-বাংলার আদি সংস্কৃতির উৎস। যা ক্রমাগত সংকোচিত হয়ে যাচ্ছে। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে মাছের অভয়ারন্য। মাছে-ভাতে বাঙালীর পাতে উঠছে চাষ করা হাইব্রিড মাছ। আমাদের সুপ্রাচীন কালের মৎস্য শিকারের কিছু নিদর্শন সংগ্রহ করে রাখার পরিকল্পনা রয়েছে
নদী-খাল-বীল, জলাশয়, বন ও পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আহমেদুল হক সিদ্দিকী বলেন, নগরায়নের যুগে এসে ক্রমাগত নদী, খাল, জলাশয়গুলো ভরাট করে আবাস গড়া হচ্ছে। এতে যেমন প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে অপরদিকে পরিবেশ তার ভারসাম্য হারাচ্ছে। আমরা হারাচ্ছি মাছ ধরাসহ আমাদের নানা রকম প্রাচীন ঐহিত্য। এসব সম্পদ রক্ষার্থে আমাদের পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন অব্যাহত আছে এবং থাকবে।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, নিঃসন্দেহে এটি গ্রামবাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে এ ধরণের আনন্দ উৎসব চলে আসছে। তবে উন্মুক্ত জলাশয় কমে যাওয়ায় মাছ ধরার এমন উৎসব খুব একটা চোখে পড়ে না। সরকারের নির্দেশে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি পরিবেশ রক্ষায় নদী, খাল, পুকুর, ডোবা, জলাশয় গুলো সংরক্ষন করতে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন