শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বাকস্বাধীনতার নামে ধর্মকে অবমাননা নয়

জালাল উদ্দিন ওমর | প্রকাশের সময় : ২২ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০২ এএম

কিছু ব্যক্তি ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করে বক্তৃতা আর লেখালেখি করছে। এরা নিজেদেরকে আধুনিক, প্রগতিশীল এবং মুক্তমনা বলে পরিচয় দেয়। তারা এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা, পালন কর্তা, নিয়ন্ত্রণকর্তা আল্লাহ এবং তার প্রেরিত মানবতার মুক্তিরদূত, সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে কটাক্ষ, অবজ্ঞা এবং অপমানিত করে। একই সাথে তারা কোরান-হাদিস এবং ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মিথ্যা এবং তাচ্ছিল্যপূর্ণ মন্তব্য করে। এই সব ব্যক্তির ধর্ম অবমাননায় ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ব্যথিত। দুঃখজনক হলেও সত্য, গণতন্ত্র, সভ্যতা ও মানবাধিকারের প্রবক্তা বলে দাবিদার একটি গোষ্ঠী এসব অপকর্মকে মুক্তচিন্তা এবং বাকস্বাধীনতা হিসাবে অভিহিত করে এবং তাদেরকে সমর্থন করে। কিন্তু কোনো ধর্ম, ধর্মের প্রবর্তক কিংবা ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের অপমান এবং অবজ্ঞা কখনো মুক্তচিন্তা, বাকস্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা হতে পারে না। বরং এটা হচ্ছে চরম অন্যায়, অভদ্রতা, অসভ্যতা এবং বিকৃত রুচির পরিচায়ক। 

এ পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় সাতশ আশি কোটি মানুষের বসবাস। এর বেশিরভাগ মানুষই কোনো না কোনো ধর্মের অনুসারী। হতে পারে কারো মাঝে ধর্মের প্রভাব কম আর কারো মাঝে বেশি। কিন্তু এক কথায় তারা ধর্মে বিশ্বাসী। এ ধারাবাহিকতা সৃষ্টির আদি কাল থেকে চলে আসছে, বর্তমানেও চলছে এবং ভবিষ্যতেও চলবে। ধর্মই নিয়ন্ত্রণ করছে মানুষের সভ্যতা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং জীবনধারা। ধর্মই গঠন করেছে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং দেশ। একজন মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবকিছুই ধর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কেউ যদি না মানে সেটা হচ্ছে ধর্ম থেকে বিচ্যুতি। তাই একজন ব্যক্তি সেক্যুলার হলেও তার বিয়ে এবং অন্তষ্টিক্রিয়া ধর্মীয় রীতিতেই সম্পন্ন হয়। সমাজের যা কিছু সত্য, সুন্দর, মহৎ এবং চির কল্যাণকর, তার সবই ধর্ম হতে উৎপন্ন। আর ভিন্ন ধর্মের রীতিনীতি ভিন্ন হলেও, ধার্মিকরা সবাই বিশ্বাস করে এই সৃষ্টিজগতের একজন স্রষ্টা আছেন। তিনিই সবকিছুর সৃষ্টিকারী, লালনকারী এবং পালনকারী।

প্রত্যেক ধর্মেই একজন প্রধান ব্যক্তি রয়েছেন, যারা এই ধর্মকে ধারণ করেছেন, অনুসরণ করেছেন এবং প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই সব ব্যক্তি নিজ নিজ ধর্মের অনুসারীদের কাছে অত্যন্ত সম্মানিত এবং মর্যাদাবান। তাই এই সব ব্যক্তিদের অপমান তাদের অনুসারীদের কেউই সহ্য করতে পারে না। হযরত ঈসা (আ.) যেমন খ্রিস্টানদের কাছে অত্যন্ত সম্মানিত, গৌতম বুদ্ধ যেমন বৌদ্ধদের কাছে অত্যন্ত সম্মানিত, শ্রীকৃষ্ণ যেমন হিন্দুদের কাছে অত্যন্ত সম্মানিত, ঠিক তেমনি হযরত মুহাম্মদ (সা.)ও মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত সম্মানিত। আর হযরত ঈসা (সা.) এর অপমান যেমন কোনো খ্রিস্টান সহ্য করতে পারে না, গৌতম বুদ্ধের অপমান যেমন কোনো বৌদ্ধ সহ্য করতে পারে না, শ্রীকৃষ্ণের অপমান যেমন কোনো হিন্দু সহ্য করতে পারে না, ঠিক তেমনি হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর অপমানও কোনো মুসলমান সহ্য করতে পারে না। সুতরাং প্রত্যেক মানুষের উচিত তার নিজ ধর্ম এবং ধর্মের সম্মানিত ব্যক্তিদের সম্মান ও শ্রদ্ধা করার পাশাপাশি অপরের ধর্ম এবং ধর্মের সম্মানিত ব্যক্তিদেরও সম্মান করা। আর শ্রদ্ধা এবং সম্মান না করলেও কখনোই এবং কিছুতেই অপরের ধর্ম এবং ধর্মের সম্মানিত ব্যক্তিদের অসম্মান, অবজ্ঞা এবং অপমান করা যাবে না। কারণ এতে সমাজের শান্তি, সম্প্রীতি এবং ভালবাসা নষ্ট হয়। সৃষ্টি হয় অশান্তি, অরাজকতা, হিংস্রতা ও বর্বরতা।

বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় দেড়শত কোটি মুসলমানের বসবাস। সুতরাং ইসলাম এবং মুসলমানরা বিশ্বশক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ। অথচ, কিছু ব্যক্তি মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস, রীতিনীতি এবং এর প্রধান ব্যক্তি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে অবজ্ঞা এবং হেয় প্রতিপন্ন করছে। ইসলামকে অবমাননার এ ঘটনা নতুন এবং বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, বরং এটা যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে। ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত হয় ‘ইনোসেন্স অব মুসলিম’ নামক একটি চলচ্ছিত্র যেখানে নাকুলা বাসিলে অত্যন্ত সুকৌশলে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে অপমানিত এবং হেয়প্রতিপন্ন করেছেন। পশ্চিমারা এটাকে বাকস্বাধীনতা বলে নাকুলা বাসিলেকে সমর্থন করে। এর কিছুদিন পর ফ্র্রান্সের একটি ম্যাগাজিন শারলি এবদো হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে ব্যঙ্গ করে কার্টুন প্রকাশ করে। শারলি এবদোর এই ঘটনা এখনো চলমান এবং এটাকেও কিছু ব্যক্তি, এমনকি ফ্র্রান্সের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইমামুয়েল ম্যাখোঁ মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলে সমর্থন করেন। সালমান রুশদি ১৯৮৮ সালে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে অবমাননা করে লিখেছিল স্যাটানিক ভার্সেস নামক উপন্যাস। তখনো পশ্চিমারা মুক্তচিন্তা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলে সালমান রুশদিকে সমর্থন করেছিল। এমনকি ব্রিটিশ সরকার সালমান রুশদিকে নাইট উপাদিতে ভূষিত করেছিল। এভাবে কিছু ব্যক্তি দেশে দেশে ধারাবাহিকভাবেই ইসলাম ধর্ম এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে অবজ্ঞা, অসম্মান এবং হেয় প্রতিপন্ন করে চলেছে। কিন্তু শান্তি, সম্প্রীতি এবং মানবতার স্বার্থেই এসব কাজ চিরতরে বন্ধ করতে হবে।

যেসব ব্যক্তি ইসলাম এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে অবজ্ঞা এবং অসম্মান করছে আর এসবকে মুক্তচিন্তা, বাকস্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলে সমর্থন করছে, তাদের জানা উচিত, এসব কারো জন্যই কোনো ধরনের কল্যাণ বয়ে আনে না, বরং ক্ষতিই বৃদ্ধি করে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) হচ্ছেন স্বমহিমায় উদ্ভাসিত একজন ব্যক্তি, যার খ্যাতি, সুনাম এবং প্রভাব শত শত বছর ধরে পৃথিবীকে যেমন আলোকিত এবং প্রভাবিত করেছে, ঠিক তেমনি তা অনন্তকাল কাল ধরে অব্যাহত থাকবে। কিছু ব্যক্তি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে অবজ্ঞা করলেও, যুগে যুগে এই পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ তাকে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালবেসেছে, যা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। শুধু যে মুসলমানরা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সম্মান করে তাই নয়, বরং অনেক অমুসলিম শিক্ষাবিদও যুগে যুগে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সম্মান করে বক্তব্য দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের খ্যতনামা অধ্যাপক এবং বুদ্ধিজীবী মাইকেল এইচ হার্ট পৃথিবীর শুরু থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সেরা একশ জন মানুষ নিয়ে ১৯৭৮ সালে লিখেছেন ‘দি হানড্রেড’, যেখানে তিনি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে এক নম্বর পজিশনে স্থান দিয়েছেন। তিনি বলেন Muhammad (saw) is the only man in history who was supremely successful on both the religious and secular level. রুশ সাহিত্যিক লিও টলস্টয় বলেন, Muhammad (saw) has always standing higher than Christianity. খ্যাতনামা ব্রিটিশ দার্শনিক জর্জ বানার্ডশ বলেন, As a father, As a Teacher, As a law giver, As a law maker, As a reformer of the Society, As a Messenger, As a commander Muhammad (saw) is the superman of the world. প্রফেসর রামাকৃষ্ণ রাও বলেন, In all the departments of human activities Muhammad(saw) is alike a hero. শুধু তাই নয়, Muhammad (saw) honored by United State Supreme court as one of the greatest law givers of the world in 1935.

ইসলাম এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে অবমাননার কারণে মুসলমানদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হলেও তাদেরকে ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে এবং কখনো সহিংস হওয়া যাবে না। মুসলমানদের হতে হবে ধৈর্য্যশীল, সহনশীল এবং ক্ষমাশীল। আবেগের বশবর্তী হয়ে কখনো ধ্বংসাত্বক কাজে লিপ্ত হওয়া যাবে না। কখনোই আইনকে নিজের হাতে তুলে নেয়া যাবে না। শুধু তাই নয়, অমুসলমানদের ধর্ম, ধর্মীয় রীতিনীতি এবং তাদের ধর্মের সম্মানিত ব্যক্তিদেরকে কখনোই অবজ্ঞা এবং অসম্মান করা যাবে না। বরং সম্মান করতে হবে। এ বিষয়ে স্বয়ং আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসংগে আল্লাহ পবিত্র কোরানে বলেন, ‘আল্লাহকে ছেড়ে তারা যাকে ডাকে, তাদেরকে তোমরা গালি দিও না, কেন না তারা সীমালংঘন করে অজ্ঞানতাবশত আল্লাহকেও গালি দেবে’ (সুরা আনয়াম: ১০৮)। আর মন্দের প্রতিবাদ কখনো মন্দ দিয়ে হয় না। ভালো কাজ দিয়েই মন্দ কাজের প্রতিবাদ করতে হবে। ইসলাম সেটাই শিক্ষা দিয়েছে। আল্লাহ তায়লা বলেন, ‘মন্দের মোকাবেলা কর যা উত্তম তা দ্বারা’ (সুরা মুমিনুন: ৯৬ )। সুতরাং যে কোনোমূল্যে মুসলমানদেরকে ধৈর্য্যশীল হতে হবে।
লেখক: প্রকৌশলী এবং উন্নয়ন গবেষক
omar_ctg123@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন