করোনা মহামারীর মধ্যেই রাজধানীর মানুষের কাছে নতুন করে ভয়ের কারণ হয়ে উঠছে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। গত শুক্র-শনিবারও ৩২ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনায় এডিস মশার লার্ভার উৎপত্তিস্থল শনাক্তে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। এ অভিযানে ভাটা পড়ায় আবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেছেন, এডিস মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করতে হবে। শুধু মৌসুমে তৎপর হলে হবে না; সারা বছর ধরেই এডিস মশা নিধনে কাজ করতে হবে। মশা নিধনের কার্যক্রম চলমান রাখতে হবে সিটি কর্পোরেশনকে। সেই সাথে নাগরিকদের নিজেদেরও সতর্ক থাকতে হবে; ঘরের আনাচে-কানাচ পরিস্কার রাখতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিস মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আফসানা আলমগীর খান জানান, চলতি বছরের শুরু থেকে এখন (এ রিপোর্ট লেখা) পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯৫৪ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৮৫৬ জন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৮৫ জন রোগী। তবে প্রথম দিকের তুলনায় চলতি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
সরকারের রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) বলছে, গত শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৩২ জনের ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে শুধু রাজধানীতেই ভর্তি হয়েছেন ২৬ জন। ঢাকার বাইরে ভর্তি হয়েছেন ছয়জন। গতকালও ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত আইইডিসিআরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৬ জনের মৃত্যুর খবর এসেছে।
রাজধানীতে এডিস নির্মূলে পরিচালিত অভিযানে কোনো কারণে ভাটা পড়তে দেখা গেলেও মশাটির প্রকোপ বাড়তে দেখা গিয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য বলছে, এডিস মশা নির্মূলে গত ১০ মে থেকে ৫ জুন পর্যন্ত চিরুনি অভিযান পরিচালিত হয়। সে সময় ঢাকা উত্তরে ১ দশমিক ৯৮ শতাংশ স্থানে এডিস মশার লার্ভা ও ৬২ দশমিক ৩০ শতাংশ এলাকায় এডিসের বংশবিস্তার উপযোগী স্থান পাওয়া গেছে। ৬ থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত পরিচালিত দ্বিতীয় দফার অভিযানে এডিসের লার্ভা পাওয়া যায় ১ দশমিক ১৯ শতাংশ বাড়িতে। এভাবে পর্যায়ক্রমে অভিযান চালানোর পর আগস্টের মধ্যে তা নেমে আসে দশমিক ৫৩ শতাংশে। এরপর বিরতি দিয়ে ২-১৪ নভেম্বর পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে দেখা যায়, এডিসের লার্ভা জন্ম নেয়ার স্থান শনাক্তের হার বেড়েছে। ওই সময়ে এডিসের লার্ভা শনাক্ত হয়েছে দশমিক ৬৬ শতাংশ স্থানে।
এডিস মশা নির্মূলে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ দুই সিটি কর্পোরেশন জুড়ে বিশেষ চিরুনি অভিযান পরিচালনা করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) ও ডিএনসিসি। দুই সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে লার্ভিসাইড স্প্রে করা হলেও স্থায়ীভাবে এডিস মশার লার্ভা বা প্রজনন সহায়ক পরিবেশ ধ্বংস করা যাচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে কর্মকর্তারা বলছেন, যত্রতত্র ডাবের খোসা, চিপসের প্যাকেট ও গাড়ির ব্যবহৃত টায়ার ফেলে রাখার কারণে সেখানে স্বচ্ছ পানি জমে এডিস মশার লার্ভা ও প্রজনন সহায়ক পরিবেশ তৈরি করছে। এ স্থানগুলো একবার ধ্বংস করে এলেও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নতুন করে ডাবের খোসা, চিপসের প্যাকেট এবং পরিত্যক্ত টায়ারে পানি জমে ফের একই পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। অভিযানে ভাটা পড়লে এডিস মশার উৎপত্তিস্থল বেড়ে যাচ্ছে।
চলতি মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে ডিএনসিসি পরিচালিত অভিযানে ৪২টি স্থানে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গিয়েছে। পাশাপাশি এডিস মশার প্রজননবান্ধব পরিবেশ পাওয়া গেছে ৫ হাজার ৭৯টি স্থানে। জানা যায়, ৫৪টি ওয়ার্ডকে ১০টি অঞ্চলে অন্তর্ভুক্ত করে এ অভিযান শুরু করে ডিএনসিসি। সংস্থাটির স্বাস্থ্য বিভাগের হিসাব মতে, মিরপুর ২ নম্বর ও এর আশপাশের এলাকা নিয়ে গঠিত ডিএনসিসির অঞ্চল-২-এর ২ হাজার ৯০টি বাড়ি ও স্থাপনা পরিদর্শন করে ছয়টি স্থানে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গিয়েছে। প্রজনন উপযোগী পরিবেশ পাওয়া গিয়েছে ২৯৩টি স্থানে। মহাখালী ও এর আশপাশের ১০টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত অঞ্চল-৩-এ ১ হাজার ৩১৬টি বাড়ি ও স্থাপনায় অভিযান চালিয়ে ১৯টি স্থান থেকে লার্ভা পাওয়া গিয়েছে।
ডিএনসিসির মতো ডিএসসিসির ওয়ার্ডগুলোতেও এডিস নির্মূলে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। ডিএসসিসির অন্তর্ভুক্ত ২, ৪, ৮, ৯, ১২, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৮, ২৫, ৩৪, ৪০, ৪১, ৪৫ ও ৫১ নম্বর ওয়ার্ডে এডিস মশার লার্ভা ও প্রজনন সহায়ক পরিবেশ চিহ্নিত করে লার্ভিসাইড স্প্রে করা হয়েছে। ডিএসসিসির স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের দাবি, এলাকা ও স্থাপনার সংখ্যা ডিএসসিসিতে তুলনামূলক বেশি হওয়ায় সেখানে এডিস মশার লার্ভা ও প্রজনন সহায়ক পরিবেশও চিহ্নিত হয়েছে বেশি। তবে ডিএসসিসির কয়েকটি এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এডিস মশা নিধনে ডিএসসিসির অভিযানে ঢিলেমি চলছে।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, করোনার মতো ডেঙ্গুও একটি ভাইরাসজনিত রোগ। দুটি রোগের লক্ষণও অনেকটা একই। এজন্য একই সময়ে যদি দুই ধরনের ভাইরাসের প্রকোপ চলতে থাকে, সেক্ষেত্রে কিছুটা ভয়ের কারণ রয়েছে। এজন্য আগে থেকেই আমাদের ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমকে আরো শক্তিশালী করে তুলতে হবে। পাশাপাশি রোগীদের মনিটরিং ব্যবস্থাও বাড়াতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন