শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

যেভাবে গোল্ডেন মনির

সেলসম্যান থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক : রাজউকের সিল নকল করে কব্জায় ২০০ প্লট : বাসা থেকে আট কেজি স্বর্ণ, ১০টি দেশের মুদ্রা, এক কোটি ৯ লাখ নগদ টাকা, অবৈধ বিদেশি পিস্তলসহ কয়েক রাউন্ড

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২২ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০০ এএম

নব্বইর দশকে রাজধানীর গাউছিয়ায় একটি কাপড়ের দোকানে সেলসম্যান হিসেবে কাজ করতেন মো. মনির হোসেন। এরপর শুরু করেন ক্রোকারিজের ব্যবসা। তারপর লাগেজ ব্যবসা অর্থাৎ ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে তিনি বিভিন্ন দেশ থেকে মালামাল আনতেন। একপর্যায়ে জড়িয়ে পড়েন স্বর্ণ চোরাকারবারে। এরপর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। অবৈধভাবে মাদক ব্যবসা, স্বর্ণ চোরাচালান, জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ভ‚মি দখল করে এখন তিনি হাজার কোটি টাকার মালিক। অবৈধ অস্ত্র ও মাদকসহ রাজধানীর মেরুল বাড্ডা থেকে মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরকে গ্রেফতারের পর এ সব তথ্য জানিয়েছে র‌্যাব।

র‌্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গোল্ডেন মনির দুবাইতে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। এজন্য তার সব প্রস্তুতিসম্পন্ন ছিল। শনিবার গ্রেফতার এড়াতে পারলেই তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতেন। শনিবার বেলা ১১টার দিকে আমিরাত এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে মনিরের দুবাই যাওয়ার কথা ছিল। রাতভর অভিযানের পর গতকাল সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব সদর দফতরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ অবৈধপথে বিদেশ থেকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছেন গোল্ডেন মনির। আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে তার স্বর্ণ চোরাকারবারের রুট ছিল ঢাকা-সিঙ্গাপুর-ভারত। এসবই তিনি করেছেন ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে। যেখানে তার নাম হয়ে যায় গোল্ডেন মনির।

অভিযান সম্পর্কে আশিক বিল্লাহ বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব-৩ এর একটি দল গত শুক্রবার দিবাগত রাত ১১টায় মেরুল বাড্ডা ডিআইটি প্রজেক্ট এলাকায় অবস্থান নেয়। অভিযানের মূল কারণ ছিল অবৈধ অস্ত্র ও মাদক। মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরকে গ্রেফতারের পর তার হেফাজত থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, কয়েক রাউন্ড গুলি, বিদেশি মদ এবং প্রায় ৯ লাখ টাকার বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়া যায়। তার বাসা থেকে আট কেজি স্বর্ণ ও নগদ এক কোটি ৯ লাখ টাকা নগদ জব্দ করা হয়েছে। তিনি মূলত একজন হুন্ডি ব্যবসায়ী, স্বর্ণ চোরাকারবারি এবং ভ‚মির দালাল। তার একটি অটোকার সিলেকশন শোরুম আছে। পাশাপাশি রাজধানীর গাউছিয়ায় একটি স্বর্ণের দোকানের সাথে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে। আমরা তার বাসা থেকে অনুমোদনবিহীন বিলাসবহুল দুটি বিদেশি গাড়ি জব্দ করেছি, যার প্রত্যেকটি দাম প্রায় তিন কোটি টাকা। এর পাশাপাশি কার সিলেকশন শোরুম থেকেও আমরা তিনটি বিলাসবহুল অনুমোদনবিহীন গাড়ি জব্দ করেছি।

তিনি আরো বলেন, গ্রেফতার মনির নব্বইর দশকে রাজধানীর গাউছিয়ায় একটি কাপড়ের দোকানের কর্মচারী ছিলেন। সেটা ছেড়ে তিনি ক্রোকারিজের ব্যবসা শুরু করেন। এরপর লাগেজ ব্যবসা অর্থাৎ ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে তিনি বিভিন্ন মালামাল দেশে আনতেন। একপর্যায়ে তিনি স্বর্ণ চোরাকারবারিতে জড়িয়ে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ অবৈধপথে বিদেশ থেকে বাংলাদেশে আনেন। তার নাম হয়ে যায় গোল্ডেন মনির। স্বর্ণ চোরাকারবারে জড়ানোয় ২০০৭ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। গোল্ডেন মনিরের আরেকটি পরিচয় তিনি ভ‚মিদস্যু। রাজউকের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। ঢাকা শহরে ডিআইটি প্রজেক্টের পাশাপাশি বাড্ডা, নিকুঞ্জ, উত্তরা ও কেরানীগঞ্জ এলাকায় তার দুই শতাধিক প্লট আছে। ইতোমধ্যে তিনি তার ৩০টি প্লটের কথা র‌্যাবের কাছে স্বীকার করেছেন।

তিনি বলেন, রাজউকের কাগজপত্র জাল-জালিয়াতি করে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ করেছেন এবং স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমে তার সম্পদের পরিমাণ প্রায় এক হাজার ৫০ কোটি টাকা। আমরা প্রাথমিকভাবে তার বিরুদ্ধে আরও কিছু অভিযোগ পেয়েছি। তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন, বিআরটিএ, মানি লন্ডারিংয়ের জন্য সিআইডি এবং ট্যাক্স ফাঁকি ও এ-সংক্রান্ত বিষয়ে এনবিআরকে অনুরোধ জানাব। মূলত তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধ অর্থাৎ অনুমোদনবিহীন বিদেশি মুদ্রা রাখায় বাড্ডা থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা দায়ের করবে র‌্যাব। পাশাপাশি অস্ত্র ও মাদক আইনে পৃথক দুটি মামলা করা হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে আশিক বিল্লাহ বলেন, মূলত ফৌজদারি অপরাধের কারণে অর্থাৎ অনুমোদনবিহীন বিদেশি অস্ত্র ও মাদক রাখার অপরাধে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার এই আইনবহির্ভূত আয়-উপার্জন অর্থসম্পদ গড়াসহ কারা জড়িত, যোগসাজশ এবং সহযোগিতা করেছে সেটি তদন্ত করতে সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানাবে র‌্যাব। তার অর্থ-সম্পদ গড়ার পেছনে এনবিআর, বিআরটিএ, রাজউকের কোন কোন কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা বা যোগসাজশ রয়েছে তা খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে অনুরোধ জানাব।

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গোল্ডেন মনিরের সাথে প্রাথমিকভাবে আমরা একটি রাজনৈতিক দল ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে জানতে পেরেছি। সেই দলটিতে তিনি অর্থের জোগান দিতেন। মো. মনিরের বিরুদ্ধে দুটি মামলা ইতোমধ্যে চলমান-একটি মামলা হচ্ছে রাজউক সংক্রান্ত। রাজউকের ভুয়া সিল-স্বাক্ষর জালিয়াতি ভ‚মিদস্যুতা এবং আরেকটি হচ্ছে দুদকের একটি মামলা চলমান। গোল্ডেন মনিরকে এখন র‌্যাব-৩ কার্যালয়ে নেয়া হচ্ছে। সেখানে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা জানান, দীর্ঘ ২০ বছরের অধিক সময় ধরে অবৈধভাবে স্বর্ণ আমদানি এবং রাজউকের ভূমি দখল করে হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পত্তির মালিক হয়েছেন মো. মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনির। রাজধানী ঢাকায় তার দখলে রয়েছে দুই শতাধিক প্লট। তিন কোটি টাকা মূল্যের বিলাসবহুল দুটো গাড়িও ব্যবহার করেন তিনি। অথচ তিনি এক সময় ছিলেন রাজধানীর গাউসুল আজম মার্কেটে কাপড়ের দোকানের কর্মচারী। গোয়েন্দা সংস্থার দীর্ঘ অনুসন্ধানে মনিরের বিরুদ্ধে উঠে আসে এসব অনিয়ম।

তিনি আরো বলেন, গোল্ডেন মনির দুবাইতে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। এজন্য তার সব প্রস্তুতিসম্পন্ন ছিল। শনিবার গ্রেফতার এড়াতে পারলেই তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতেন। এদিন বেলা ১১টার দিকে আমিরাত এয়ারলাইন্সের (ঊক-৫৮৫) ফ্লাইটে মনিরের দুবাই যাওয়ার কথা ছিল। গোল্ডেন মনির নিজের নিরাপত্তায় লাইসেন্সকৃত দু’টি আগ্নেয়াস্ত্র সঙ্গে রাখতেন। এর মধ্যে একটি পিস্তল ও একটি শর্টগান। তবে বৈধ দু’টি অস্ত্রের পাশাপাশি একটি অবৈধ পিস্তলও তার দখলে ছিল। যেটি তাকে আটকের সময় তার বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়। বিদেশ যাওয়ার জন্য নিজের লাইসেন্সকৃত দু’টি অস্ত্র বাড্ডা থানায় জমাও দিয়েছিলেন তিনি।
গোল্ডেন মনিরের ছেলে মোহাম্মদ রাফি হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, বাবা প্রায়ই চিকিৎসার জন্য দুবাই যান। এবারো চিকিৎসার জন্য যাচ্ছিলেন, এজন্য তার ফ্লাইট কনফার্ম ছিল। এর আগেই র‌্যাব তাকে আটক করে ফেলে। তবে মনিরের শারীরিক সমস্যা বা চিকিৎসার বিষয়ে জানতে চাইলে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি রাফি হোসেন। বাবার অভিযোগের বিষয়ে রাফি বলেন, আমার বাবা নির্দোষ। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। বাবার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে সব ভিত্তিহীন। তিনি একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী। আমরা আইনিভাবে সব মোকাবিলা করব। সেখানেই প্রমাণ হবে বাবা দোষী কি না।

র‌্যাবের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গোল্ডেন মনির হুন্ডি ব্যবসা, স্বর্ণ চোরাচালানের অবৈধ টাকা ঢাকতে আয়ের উৎস হিসেবে রাজধানীর বারিধারায় ‘অটো কার সিলেকশন’ নামে একটি গাড়ির শোরুম চালু করেন। সেখানেও তিনি অবৈধপথে বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করতেন। তার নিজের ব্যবহৃত ৫টি বিলাসবহুল গাড়ি জব্দ করা হয়েছে। দুটি তার নিজ বাসা থেকে এবং ৩টি তার গাড়ির শোরুম থেকে। ৫টি গাড়িই অনুমোদন ছাড়া তিনি দেশে এনেছিলেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (8)
বয়ড়া খাল পাড় ২২ নভেম্বর, ২০২০, ১:২৭ এএম says : 0
লাভ হলো কি? এখনতো মান সম্মান সবই গেল। একটু মরণের চিন্তা করলে না।
Total Reply(0)
Najmul Hasan ২২ নভেম্বর, ২০২০, ২:৫১ এএম says : 0
রাজউকের যেসব কর্মকর্তা জড়িত তাদেরও ধরা হোক।
Total Reply(0)
Akash Chowdhury ২২ নভেম্বর, ২০২০, ২:৫১ এএম says : 0
কঠোর শাস্তি হোক।
Total Reply(0)
Mohammad Mannan ২২ নভেম্বর, ২০২০, ২:৫১ এএম says : 0
সরকারকে অনুরোধ ওর সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হোক
Total Reply(0)
Lokman ২২ নভেম্বর, ২০২০, ২:৫১ এএম says : 0
লক্ষকোটি অবৈধ "গোল্ডেন মনির" দেশের মধ্যে বিরাজমান। দেশটাকে শেষ করিতেছে এরাই।
Total Reply(0)
Mannan Runu ২২ নভেম্বর, ২০২০, ২:৫২ এএম says : 0
খারাপ কি ভালই তো। উনার এই সম্পদের উপর দেশের অনেক মানুষ কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে।
Total Reply(0)
Imran ২২ নভেম্বর, ২০২০, ২:৫৩ এএম says : 0
একজনের দখলে যদি এতো সম্পদ থাকে তাহলে বাংলাদেশের মানুষ গরিব হবে না কেন ?
Total Reply(0)
Abdullah Al Naiwan Tanvir ২২ নভেম্বর, ২০২০, ২:৫৪ এএম says : 0
Golden monir what a name hahhaha
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন