ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা ১১টা। স্মৃতির ভেলায় চেপে মতিঝিলের ক্লাবপাড়া তখন ফিরে গেল যেন সেই আশির দশকে। অলিতে-গলিতে ঘুরে ফিরছে ফুটবলের চেনা মুখগুলো। তবে মলিন। নেই আগের সেই হাঁক-ডাক, নেই সেই প্রাণ-উচ্ছ্বাস। যেমনটা দেখা যেতো শিরোপা মিছিলে। সামনেই যে নিথর-নিশ্চুপ অনেক শিরোপার কারিগর বাদল রায়ের নিথর দেহ। ৩৬ ঘণ্টা আগেও যিনি ছিলেন, সবাইকে কাঁদিয়ে সেই প্রিয় ‘বাদল দা’ আজ নেই। গতপরশু সন্ধ্যায় লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরলোক গমন করেন ঐতিহ্যবাহী ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ও জাতীয় দলের সাবেক তারকা ফুটবলার, রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্রীড়াবিদ।
জীবনের ৬৩ বছরের সিংহভাগই ছিল ক্রীড়াঙ্গণে সীমাবদ্ধ। যার শুরু আর শেষটাও হয়েছে সাদা-কালো শিবিরে। নিজের বর্ণাঢ্য ফুটবল ক্যারিয়ারে মোহামেডানের জার্সি গায়ে খেলেছেন টানা ১২ বছর। দু’হাত ভরে এনে দিয়েছেন সাফল্যের মালা। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা প্রিয় এই প্রাঙ্গণে ছিল কিংবদন্তী এই ফুটবলারের নিথর দেহ। ফুটবলাঙ্গণের অগণিত মানুষ, সাদাকালো ভক্ত-সমর্থকরা শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানান মাত্র ১৭ বছর বয়সে এই ক্লাবের প্রতিনিধিত্ব করতে আসা বাদল রায়কে। এসময় নিজের বাবার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে কন্যা বৃষ্টি রায় সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তা ভালো মানুষদের আগে নিয়ে যান। আমার বাবা ফুটবলকে অনেক ভালোবাসতেন। তিনি চলে গেলেন। বাবা নেই, এখানে যারা আছেন তারা আমাদের মাথার ওপর ছায়া হয়ে থাকবেন। আমি চাই দেশের ফুটবল ভালো থাকুক, ফুটবল এগিয়ে যাক। ফুটবল ভালো থাকলে ফুটবলের মাঝেই বেঁচে থাকবেন আমার বাবা।’ বৃষ্টি রায়ের কথায় আবেগ ছড়িয়ে যায় উপস্থিত সবার মাঝে। তখন বাদল রায়ের মরদেহের পাশে বসে অঝোরে কাঁদছিলেন স্ত্রী মাধুরী রায় ও ছেলে বর্ণ রায়। তবে তারা কিছু বলতে পারেননি।
লাল-সবুজ জার্সি গায়ে জাতীয় দলের হয়ে খেলেন পাঁচ বছর। দিয়েছেন নেতৃত্বও। মোহামেডানের প্রিয় প্রাঙ্গণ থেকে বাদল রায়ের লাশ নেয়া হয় অসংখ্য কীর্তির সাক্ষী বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। যেখানকার সবুজ ঘাসকে ক্যানভাস বানিয়ে নিজের দু’পায়ের তুলিতে বছরের পর বছর তিনি এঁকেছেন ফুটবলের নানান ছবি। এই স্টেডিয়ামে শেষবারের মতো এলেন বাদল রায়। তবে নিথর দেহে। যে মাঠে বাদলের পায়ের যাদু দেখে স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে হাজার হাজার ফুটবলপ্রেমী করতালিতে মুখোরিত করতো সবুজ সেই গালিচায় বাদল রায়কে শেষবারের মতো দেখতে এসে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি তার অগ্রজ, সতীর্থ ও অনুজ ফুটবলারসহ অসংখ্য মানুষ।
খেলোয়াড় ও সংগঠক ছাড়াও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন ছাত্র জীবন থেকেই। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের ক্রীড়া সম্পাদকও। তাই তো বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে বাদল রায়কে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন ক্রীড়াঙ্গনের মানুষ ছাড়াও রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেকে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে বাদল রায়ের মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান দপ্তর সম্পাদক এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ূয়া। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন কিংবদন্তী এই ফুটবলারকে।
এছাড়া ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম, মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি এমপি, সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল এমপি, সদস্য অ্যাডভোকেট রিয়াজুল কবীর কাওসার, ত্রাণ বিষয়ক সম্পাদক সুদিব রায় নন্দী, যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক হারুনুর রশীদ ও উপ-দপ্তর সম্পাদক সায়েম খান। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিব মো. মাসুদ করিম, বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব সৈয়দ শাহেদ রেজা, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সহ-সভাপতি কাজী নাবিল আহমেদ, মহিউদ্দিন মহি, সাধারণ সম্পাদক মো. আবু নাইম সোহাগ, সদস্য জাকির হোসেন চৌধুরী, ও হকি ফেডারেশনের সহ-সভাপতি আবদুর রশিদ শিকদারসহ বিভিন্ন ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের কর্তারা। বাদ যায়নি ক্রীড়া সাংবাদিকদের সংগঠন বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন (বিএসপিএ), বাংলাদেশ স্পোর্টস জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশন (বিএসজেএ) ছাড়াও বিভিন্ন ক্লাব ও সংস্থা।
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম থেকে তার লাশ শেষ শ্রদ্ধার জন্য নেয়া হয় জাতীয় শহীদ মিনারে। সেখান থেকে ফুলেল শ্রদ্ধা শেষে বাদল রায়ের লাশবাহী গাড়িটি নেয়া হয় সবুজবাগের কালিমন্দিরে। বেলা ৩টার দিকে এখানেই শেষকৃত্য হয় দেশসেরা সাবেক এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের।
এদিকে বাদল রায়ের মৃত্যুতে বড় ধরনের একটা ধাক্কা খেয়েছে কাতারে অবস্থানরত জাতীয় দল। তাকে হারিয়ে শোকাহত মামনুল ইসলাম, জামাল ভূঁইয়ারা। দোহায় বসেই বাদল রায়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গতকাল অনুশীলন শুরুর আগে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন জাতীয় দলের সবাই। দলের পক্ষে এক ভিডিও বার্তায় মামুনুল জানান, তাদের হৃদয়ের কতটা কাছে ছিলেন বাদল, ‘রোববার এই খবর শোনার পর থেকে আমাদের সব খেলোয়াড় শোকাহত। আমরা এমন একজনকে হারিয়েছি যিনি আমাদের বড় ভাইয়ের মতো, আমাদের অভিভাবক। আমরা সবাই শোকাহত। আমরা দেশের বাইরে এসেছি, এখানে তাকে আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।’
বাদল রায়- দেশের ক্রীড়াঙ্গনে এক কিংবদন্তীর নাম। শুধু খেলোয়াড়-ই কেন, ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও রেখেছেন দক্ষতার স্মারক। খেলা ছেড়ে প্রথমে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) যুগ্ম সম্পাদক ও পরে টানা তিনবার সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের (বিওএ) উপ-মহাসচিব ও সহ-সভাপতি ছাড়া বাদল রায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোষাধক্ষ্যের দায়িত্বও পালন করেছেন। দুর্দান্ত ফুটবলার, তুখোড় ক্রীড়া সংগঠকের পাশাপাশি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন বাদল রায়। নির্বাচনও করেছিলেন দলটির হয়ে। তার মৃত্যুতে বর্ণিল এক অধ্যায়েরও পরিসমাপ্তি ঘটলো। মৃত্যুই বাদল রায়কে বিচ্ছিন্ন করলো প্রিয় ক্লাব মোহামেডান ও চিরচেনা বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম থেকে!
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন