শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

গ্রিন সিগন্যালের অপেক্ষা

আবুধাবি ফেরার অনিশ্চয়তায় ১০ হাজার প্রবাসী আবুধাবি ও এলাইন ইমিগ্রেশনে রেড সিগন্যাল কূটনৈতিক উদ্যোগ জরুরি

শামসুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২৫ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০০ এএম

‘রেড সিগন্যাল’ এর কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ আবুধাবিতে ফিরে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না হাজার হাজার প্রবাসী শ্রমিকের। বৈশ্বিক করোনা মহামারির মধ্যে ধার দেনা করে খাচ্ছেন তারা। অথচ কাজে ফিরে যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবির ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ রেড সিগন্যালের বেড়াজালে আটকে দিয়েছেন। ছুটিতে দেশে এসে হাজার হাজার প্রবাসী কর্মী করোনা মহামারিতে কর্মস্থলে ফিরে যেতে পারেনি। তবে দেশটির কফিলরা চাচ্ছেন যাতে আটকে পড়া প্রবাসী কর্মীরা ফিরে যান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রিন সিগন্যালের আশায় অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন আটকে পড়া প্রবাসী কর্মীরা। কূটনৈতিক পর্যায়ে উদ্যোগ নিলেই আটকেপড়া এসব প্রবাসীদের ভাগ্যের চাকা ঘুরতে পাড়ে। অন্যথায় রেড সিগন্যালধারী প্রবাসী কর্মীদের ওপর স্থায়ীভাবে নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। এমন আশঙ্কায় চরম উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন প্রবাসীরা। একাধিক ভুক্তভোগী এসব অভিমত ব্যক্ত করেছেন। যথাসময়ে এসব প্রবাসী কর্মী স্বস্ব কর্মস্থলে ফিরতে না পারলে জনশক্তি রফতানিতে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশি কর্মীরা যেন চাকরিচ্যূত হয়ে দেশে ফেরত না আসে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গত জুন মাসের প্রথম দিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতি বিশেষ অনুরোধ জানিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন। আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল্লাহ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের সাথে ফোনালাপকালে তিনি এ অনুরোধ করেন। আমিরাতের উন্নয়নে প্রবাসী বাংলাদেশিরা গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে উল্লেখ করে ড. মোমেন বলেন, কেউ চাকরিচ্যূত হলেও যেন কমপক্ষে ৬ মাসের সমপরিমাণ ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা পায়। তিনি সেদেশে অবস্থানরত প্রবাসী কর্মীদের খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার জন্য ইউএইর পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। জবাবে এ সব বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে মন্ত্রী নাহিয়ান আশ্বস্ত করেন।
বায়রার নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ছুটিতে দেশে আটকে পড়া প্রবাসীদের ইকামা গত এক মাস যাবত রেড সিগন্যাল করে রেখেছে আবুধাবি ইমিগ্রেশন ও এলাইন ইমিগ্রেশন। ফলে এ দু’টি শহরের কর্মস্থলে যেতে পারছে না প্রবাসীরা। এতে আটকে পড়া প্রবাসী কর্মীরা চরম হতাশায় ভুগছেন। দেশটির ইমিগ্রেশন থেকে ইকামা গ্রিন সিগন্যাল না করা পর্যন্ত তারা কর্মস্থলে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। অনেকের ভিসা ও ইকামার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে ছুটিতে দেশে এসে আটকে পড়া প্রবাসী কর্মীরা করোনা মহামারিতে চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন। কোনো এয়ারলাইন্সই রেড সিগন্যালধারী প্রবাসী কর্মীদের দেশটির টিকিট দিচ্ছে না। আবুধাবি ইমিগ্রেশন অধিদপ্তর রেড সিগন্যালধারী প্রবাসীদের ইকামা যে দিন গ্রিন সিগন্যাল করে দেবে সেদিন থেকেই আটকে পড়া এসব কর্মী দেশটিতে প্রবেশের সুযোগ পাবে।
আটকে পড়া প্রবাসী কর্মীরা রাজধানীর বিভিন্ন ট্রাভেলস এজেন্সি ও বিমান অফিসে ধরনা দিয়েও কোন সুরাহা পাচ্ছে না। আবুধাবি ও এলাইন শহরের প্রবাসী কর্মীদের রেড সিগন্যালধারী ইকামা গ্রিন সিগন্যালে পরিণত করার দাবিতে কূটনৈতিক উদ্যোগ নেয়ার লক্ষ্যে দূতাবাসের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পেশ করেছে আবুধাবিস্থ বঙ্গবন্ধু পরিষদ। করোনা মহামারির আগে তেলসমৃদ্ধ দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিতে কর্মরত লাখ লাখ প্রবাসী কর্মীর দিনকাল ভালোই যাচ্ছিল। দেশটির বিভিন্ন কফিলের সম্মতি নিয়ে হাজার হাজার প্রবাসী কর্মী ছুটিতে দেশে এলে শুরু হয় করোনার সংক্রমণ।
ছুটিতে এসে আটকে পড়া ফেনীর দাগুনভ‚ঁয়ার প্রবাসী জাফর রাজধানীর দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। বৈশ্বিক করোনা মহামারিতে আবুধাবি থেকে দেশে ছুটিতে এসে আটকে পড়েন তিনি। তার ইকামা রেড সিগন্যাল হয়ে আছে। ইকামার মেয়াদ থাকার পরেও গ্রিন সিগন্যাল না আসায় এয়ারলাইন্সগুলো তাকে আবুধাবির টিকিট দিচ্ছে না। স্বপ্নের দেশ আবুধাবির কর্মস্থলে কবে যেতে পারবেন সে চিন্তায় রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে তার। যথাসময়ে কর্মস্থলে যোগদান করতে না পারলে চাকরিসহ দীর্ঘ তের বছরের সার্ভিস বেনিফিটসহ অন্যান্য সুবিধাদিও হাত ছাড়া হবে তার।
নগরীর ট্রাভেলস এজেন্সিগুলোতে ধরনা দিয়েও কোনো সুরাহা পাচ্ছেন না প্রবাসী জাফর। কবে ভাগ্যে যুটবে আবুধাবির গ্রিন সিগন্যাল তা’ কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। ছুটিতে আটকে পড়া বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশিরা একই শঙ্কায় ভুগছেন। তবে চড়া দামে টিকিট কিনে বেশ কিছু আটকে পড়া প্রবাসী কর্মী ইতোমধ্যেই স্ব স্ব কর্মস্থলে ফিরে গেছে। যারা টিকিটের চড়া মূল্য যোগাতে পারেনি তারা কর্মস্থলে যেতে পারেনি। প্রবাসী জাফর কান্না জড়িত কন্ঠে ইনকিলাবকে বলে, দীর্ঘ ১৩ বছর আবুধাবির ডেলটা ডিজাইন কোম্পানীতে তার দিনকাল ভালোই কাটছিল। করোনা সংক্রমণে ছুটিতে দেশে এসে তিনি এখন দেশটির কর্মস্থলে ফিরতে পারছেন না। করোনা সংক্রমণের দরুণ হাজার হাজার প্রবাসী কর্মী একই সমস্যায় পড়েছেন। দেশটির কফিল মি. হাদি প্রবাসী জাফরকে বার বার তাগিদ দিচ্ছে তুই তাড়াতাড়ি চলে আয়। প্রবাসী জাফরের ইকামার মেয়াদ ২০২১ সালের ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত রয়েছে। প্রবাসী জাফর আটকে পড়া রেড সিগন্যালধারী বাংলাদেশি কর্মীদের ইকামা গ্রিন সিগন্যাল করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন। দাগুনভূঁইয়ার হানিফও ছুটিতে দেশে এসে আটকা পড়ে বিপাকে পড়েছেন। তার ইকামাও রেড সিগন্যাল দেখাচ্ছে।
ভ্রাতৃ-প্রতীম সংযুক্ত আরব আমিরাতে লাখ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছে। মহামারি করোনাভাইরাসের চলমান সঙ্কটের মধ্যেও প্রবাসী আয়ে ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত রয়েছে। চলতি মাসের ১৫ দিনে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এসেছে ১২১ কোটি মার্কিন ডলার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এতথ্য জানানো হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশের ইতিহাসে একক মাসের মাত্র ১৫ দিনে এর আগে কখনো এত পরিমাণ রেমিট্যান্স আসেনি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি বিরল ঘটনা। চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরে জুলাই থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত মোট রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার (১০ দশমিক ১৬ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৪২ শতাংশ বেশি। গত ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এ একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ৭০৭ কোটি ৩০ লাখ (৭ দশমিক ৩০ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার। প্রবাসী আয়ের এ উর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত থাকার জন্য সরকারের ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে।
এদিকে বিএমইটি’র সূত্র জানায়, বিভিন্ন দেশে কাজ না থাকায় এবং নানা কারণে গত ১ এপ্রিল থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বিদেশ থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার ৫৭৩ জন প্রবাসী কর্মী দেশে ফিরেছে। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকেই দেশে ফিরেছে ৪৬ হাজার ৪৩ জন প্রবাসী কর্মী।
আটাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ জুম্মন চৌধুরী গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, করোনা সংক্রমণ রোধে সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকার ছুটিতে বাইরের দেশে আটকে পড়া আবুধাবি ও এলাইন শহরের অভিবাসী কর্মীদের ইকামা গত এক মাস ধরে রেড সিগন্যাল করে রেখেছে। এতে রেড সিগন্যালধারী প্রায় দশ হাজার প্রবাসী কর্মী ছুটিতে দেশে এসে আটকা পড়েছেন। এদের অনেকেরই ভিসা ও ইকামার মেয়াদও শেষ হয়ে যাচ্ছে। করোনা সংক্রমণ কিছুটা শিথিল হওয়ায় গত জুলাই মাস থেকে।
এ যাবত দেশটিতে চড়া দামে টিকিট কিনে অনেকেই চলে গেছে। যারা চড়া দামে টিকিট কিনতে পারেনি তারা দেশটিতে যেতে পারেনি।
বায়রার ইসির অন্যতম সদস্য মোহাম্মদ আলী ইনকিলাবকে বলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে বাংলাদেশের সুসর্ম্পক রয়েছে। দেশটি মাত্র দু’টি রাজ্যে প্রবাসী কর্মীদের ইকামা রেড সিগন্যাল দিয়ে রাখা হয়েছে। এতে ছুটিতে আটকে পড়া কর্মীরা চরম হতাশায় ভুগছেন। তিনি বলেন, দেশটিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত যদি কূটনৈতিক উদ্যোগ নেন তা হলে আটকে পড়া কর্মীদের ইকামা গ্রিন সিগন্যাল করার বিষয়টি দ্রæত সুরাহ সম্ভব। তিনি এ ব্যাপারে অবিলম্বে কূটনৈতিক পর্যায়ে বাস্তবমুখী উদ্যোগ নেয়ার আহবান জানান। অন্যথায় জনশক্তি রফতানি খাতে আরো ব্যাপক ধস নামার আশঙ্কা রয়েছে বলেও বায়রা নেতা উল্লেখ করেন।
এ ব্যাপারে সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত আবু জাফর ও দেশটির সিজি ইকবাল হাসান খানের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তারা ফোন ধরেননি।
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় প্রবাসীদের লাশ দেশে প্রেরণ, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দরে ভিজিট ভিসায় আগতদের হয়রানি বন্ধ, বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সের বিমাতাসূলভ আচরণ ও করোনাকালীন সময়ে আমিরাত প্রবাসীদের ইমিগ্রেশন (রেড সিগন্যাল) জটিলতার কারণে বাংলাদেশে আটকা পড়া সবাইকে আমিরাতে আসার অনুমতির ব্যাপারে কূটনৈতিক উদ্যোগসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে বঙ্গবন্ধু পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি আবুধাবীর উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে তার কার্যালয়ে প্রেরণের লক্ষ্যে আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আবু জাফরের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। সম্প্রতি রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আবু জাফরের কাছে এ স্মারকলিপি প্রদান করেন নেতৃবৃন্দ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি আবুধাবীর সভাপতি আলহাজ ইফতেখার হোসেন বাবুল, সহ-সভাপতি আবদুস সামাদ, সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন তালুকদার।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন