শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

অপকর্ম ঢাকতে পোস্টার-ব্যানার!

অগ্রণী ব্যাংকের জমি ফের দখল হাজী সেলিমের

খলিলুর রহমান | প্রকাশের সময় : ২৬ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

পুরান ঢাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিমের। দখল, চাঁদাবাজি থেকে হেন কোনো অপকর্ম নেই যা করেননি তিনি। তবে যখনই তার অপকর্মগুলো প্রকাশ হতো তখনই নতুন রূপ ধারণ করতেন হাজী সেলিম। পরিকল্পনা অনুযায়ী নিজস্ব ক্যাডার বাহিনীর মাধ্যমে অপকর্মগুলো লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়ে যান তিনি। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সম্প্রতি ছেলে ইরফান সেলিম গ্রেফতারের পর তিনি গা ঢাকা দিলেও বর্তমানে তিনি ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। অগ্রণী ব্যাংককে হটিয়ে সেই জমি ফের দখল করেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, ছেলে ও নিজের অপকর্ম ঢাকার জন্য এলাকায় ব্যানার ও পোস্টার সাটানো হচ্ছে। নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী দিয়ে এমন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তিনি। গতকাল সরেজমিন ঘুরে ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, ছেলে ইরফান সেলিম গ্রেফতারের পর পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারস্থ একটি জমি উদ্ধার করেছিল অগ্রণী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু মাস না গড়াতেই এই সংসদ সদস্য সেই জমি পুনর্দখল নিয়েছেন হাজী সেলিম। জমিটি পুনরায় দখলে নেয়ার পর এখন ভয়ে আছেন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার কর্পোরেট শাখার কর্মীরা। মারামারি এড়াতে ওই জমির দখল নিতে যাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন শাখার দায়িত্বে থাকা সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) বৈষ্ণব দাস মন্ডল।
সূত্রমতে, সম্প্রতি হাজী মো. সেলিমকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মনোনীত করা হয়েছে। আর ওই সুযোগকেও কাজে লাগিয়ে সেলিম পরিবারের অপকর্ম ঢাকার চেষ্টা চলছে। শুধু তাই নয়, সেলিম বাহিনীর সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে ব্যানার ও পোস্টার সাটিয়েছেন। অবৈধভাবে দখল করে গড়ে তোলা মদিনা আশিক টাওয়ারের মেইন গেটেও একটি ব্যানার সাটানো হয়েছে। মদিনা আশিক টাওয়ার দোকান মালিক সমিতির পক্ষ থেকে সাটানো ওই ব্যানারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জাননো হয়েছে। ওই ব্যানারে লেখা আছে, ‘ঢাকা-৭ আসনের বার বার নির্বাচিত সফল সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিমকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মনোনীত করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ম জননেত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।’ এছাড়া চকবাজার মোড়ে একটি বিদ্যুতের খুটিতেও পোস্টার সাটানো হয়েছে। এতেও হাজী সেলিমকে ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মনোনীত করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানানো হয়েছে। ওই পোস্টারের নিচে লালবাগ থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সাগর আহমেদ শাহীনের নাম লেখা আছে।
এমন দৃশ্য শুধু মদিনা আশিক টাওয়ার বা চক বাজার মোড়েই নয়, পুরো পুরান ঢাকার অলিগলিতে ব্যানার ও পোস্টার দেখা যাচ্ছে। শুভেচ্ছা ব্যানার ও পোস্টারগুলোতে প্রচারে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীর নাম ব্যবহার করা হয়েছে। এতে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। হাজী সেলিম ও তার ছেলে অপকর্ম ঢাকতেই দলীয় পদ ব্যবহার করছেন; এমন মন্তব্য পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের।
এদিকে, হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিম কারাগারে থাকলেও তার ক্যাডার বাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন সক্রিয়। তার মুক্তির দাবিতে পুরান ঢাকার অলিতে গলিতে বিভিন্ন নামে বেনামে ব্যানার পোস্টার সাটিয়েছেন ক্যাডার বাহিনীর সদস্যরা। ব্যানারগুলোতে লেখা আছে, ‘৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. ইরফান সেলিমের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সকল ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারসহ অবিলম্বে নিঃমুক্তি চাই’। দাবি একই হলেও সংগঠনের নাম রয়েছে আলাদা। গতকাল সরেজমিন ঘুরে এমন দৃশ্য দেখা গেছে।
মুক্তির দাবি জানানো সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে- চক বাজারের নোয়াখালী ব্যবস্যয়ী ঐক্য ফোরাম, রহমতগঞ্জ সম্মিলিত ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ পণ্য পরিবহন মালিক সমিতি, ইমামগঞ্জ পঞ্চায়েত ও মক্তব ঘর, বাংলাদেশ ক্রোকারিজ মার্চেন্টাস অ্যাসোসিয়েশন, রজনীবোস লেন বাড়ী মালিক কল্যাণ সমিতি, বাংলাদেশ পেইন্টস, ডাইজ অ্যান্ড কেমিক্যালস মার্চেন্টাস অ্যাসোসিয়েশন, নলগোলা-মিটফোর্ড তরুণ সংঘ, ঢাকা ব্যাগ প্রস্তুতকারক মালিক সমিতি, চক বাজার ব্যবসায়ী সমিতি, বাংলাদেশ জড়ি দোকান ও প্রস্তুতকারক ব্যবসায়ী সমিতি, বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, ঢাকা রহমতগঞ্জ ফাউন্ডেশন, চাম্পাতলী প্রতীভা সংঘ। এছাড়া আরো অনেক সংগঠনের পক্ষ থেকে ইরফানের মুক্তির দাবি জাননো হয়েছে।
এছাড়াও বিভিন্ন ওয়ার্ডবাসীর নাম ব্যবহার করে ব্যানার সাটানো হয়েছে। চক বাজার কৃষি ব্যাংকের শাখার পাশে গিয়ে দেখা গেছে, ইরফান সেলিমের মুক্তির দাবিতে একটি ব্যানার সাটনো হয়েছে। এতে ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের সর্বস্তরের জনগণের পক্ষ থেকে ইরফানের মুক্তির দাবি করা হয়েছে। এছাড়াও ৩০, ২৮ নম্বর ওয়ার্ডসহ পুরান ঢাকার একাধিক ওয়ার্ডে ইরফানের মুক্তির দাবিতে ব্যানার সাটানো হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, ওইসব সংগঠনের আড়ালে হাজী সেলিম ও তার ছেলে ইরফান সেলিম নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী গড়ে তুলেছেন। তাই ওই সংগঠনগুলোর মাধ্যমেই তাদের অপকর্ম ঢাকার চেষ্টা চলছে। শুধু তাই নয়, এলাকার পঞ্চায়েত কমিটিগুলোতেও সেলিম বাহিনীর ক্যাডাররা পদপদবী ভাগিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয়দের এমন তথ্যের কিছু প্রমাণও পাওয়া গেছে।
ইমামগঞ্জ পঞ্চায়েত ও মক্তব ভবনের সামনে গিয়ে দেখা গেছে, ইমামগঞ্জ পঞ্চায়েত ও মক্তবঘরের কমিটির একটি তালিকা সাটানো রয়েছে। এতে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে হাজী মো. সেলিমের নাম লেখা আছে। এছাড়া ওই সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা হলেন হাজী সেলিমের ছেলে একাধিক মামলার আসামি মোহাম্মদ ইরফান সেলিম। তিনি ছাড়াও ওই কমিটিতে উপদেষ্টা হিসেবে আরো সাতজনের নাম রয়েছে।
সূত্রমতে, পুরান ঢাকার চকবাজারে অন্তত ২০টি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সমিতি রয়েছে। এগুলোর নেতৃত্বে রয়েছেন হাজী সেলিম ও তার ছেলে ইরফান সেলিমের ঘনিষ্ঠজন এবং রাজনৈতিক অনুসারীরা। তাদের অনেকেই সেলিম পরিবারের নানা অপকর্মের ‘ক্যাডার বাহিনীর’ সদস্য হিসেবে স্থানীয়দের কাছে পরিচিত। নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় সেলিমপুত্র ইরফান গ্রেফতারের পরও থেমে নেই এসব সংগঠন ও সমিতির নেতারা। এখনো তাদের কড়া নজরদাড়িতে রয়েছে পুরো পুরান ঢাকা। ‘চাঁন সরদার দাদা বাড়ী’সহ বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করছেন তারা। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এসব ক্যাডার অধরাই থেকে যাচ্ছেন। ফলে বিভিন্ন সময়ে হয়রানি, নির্যাতন ও প্রতারণার শিকার হলেও হাজী সেলিম পরিবারের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস করছেন না কেউ।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে পুরান ঢাকার এক বাসিন্দা দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ছেলে গ্রেফতার হওয়ার পর গা ঢাকা দিয়েছিলেন হাজী সেলিম। কিন্তু কয়েক দিন পর ফের এলাকায় চলে আসেন। এলাকা এসে ছেলের মুক্তির জন্য ও তার বিভিন্ন অপকর্ম ঢাকতে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনীকে চাঙ্গা করেন। এরই মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা নির্বাচিত হওয়াতে বাড়তি সুবিধা নিচ্ছেন হাজী সেলিম। তার ওই পদ ব্যবহার করেই অপকর্ম ঢাকতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তার ক্যাডার বাহিনীর সদস্যরা।
উল্লেখ্য, গত ২৫ অক্টোবর রাতে স্ত্রীকে নিয়ে মোটরসাইকেলে বাসায় ফিরছিলেন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহমেদ খান। রাজধানীর কলাবাগান ট্রাফিক সিগন্যালে সংসদ সদস্যের স্টিকারযুক্ত একটি গাড়ি তার মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়। ওই গাড়িতে ছিলেন হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান ও তার লোকজন। ওয়াসিফ নিজের পরিচয় দিয়ে গাড়িটিকে থামতে ইশারা করেন ও কথা বলতে চান। তখন তাকে মারধর করে রক্তাক্ত করেন ইরফান ও তার লোকেরা।
এ ঘটনার পরদিন ধানমন্ডি মডেল থানায় হাজী সেলিমের ছেলে, দেহরক্ষী, গাড়িচালকসহ অজ্ঞাতদের নামে মারধর ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন ওয়াসিফ। এরপর পুরান ঢাকার চকবাজারে হাজী সেলিমের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ইরফান সেলিম ও জাহিদকে গ্রেফতার করে। অভিযানকালে বাড়িতে অবৈধ মদ, অস্ত্র ও ওয়াকিটকি পাওয়ায় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত তাদের এক বছর করে কারাদন্ড দেয়। পরে তাদের নামে মাদক ও অস্ত্র আইনে দুটি করে চারটি মামলা দেয় র‌্যাব। এরপর দখলবাজিসহ নানা অপকর্মের তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু হয়। এসব ঘটনায় চকবাজার থানায় একাধিক মামলাও দায়ের করা হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (8)
আজিজ ২৬ নভেম্বর, ২০২০, ২:৩৯ এএম says : 0
দেশে কি প্রশাসন নেই?
Total Reply(0)
গোলাম ফারুক ২৬ নভেম্বর, ২০২০, ৩:১২ এএম says : 0
হাজী সেলিমের কাছে পুরো পুরান ঢাকাবাসী জিম্মি হয়ে আছে
Total Reply(0)
তানভীর আলম ২৬ নভেম্বর, ২০২০, ৩:১৩ এএম says : 0
বিভিন্ন সময়ে হয়রানি, নির্যাতন ও প্রতারণার শিকার হলেও হাজী সেলিম পরিবারের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস করছেন না কেউ।
Total Reply(0)
habib ২৬ নভেম্বর, ২০২০, ৯:২৫ এএম says : 0
Awamlegue parena emon kono kaz nai...
Total Reply(0)
H.M Arzue ২৬ নভেম্বর, ২০২০, ১০:০২ এএম says : 0
দেশে কি প্রশাসন নেই? আছে!!!
Total Reply(0)
খোন্দকার মোস্তাবুল হক ২৬ নভেম্বর, ২০২০, ১১:২৪ এএম says : 0
হাজী সেলিম সাহেব কি প্রশাসনের প্রতিদ্বন্দী ? সরকারী জায়গা দখল করে ! ব্যাঙ্কের স্থাপনা দখল করে ! সাধারণ পাবলিক তো একেবারেই অসহায় । ক্ষতিগ্রস্থ পাবলিকদের তো বিচার চাওয়ারও সাহস নাই। এত বড় ক্ষমতাধর সাংসদ তিনি ? কিছুই পরোয়া করেন না! তবে আশার কথা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রশাসনযন্ত্র, ব্যাঙ্ক কত্তৃপক্ষ বেশ সাহস সঞ্চার করেছেন এবং তৎপর হয়েছেন । আমরা এতকাল শুনে এসেছি আইনের উর্দ্ধে কেউ নয় । আশাকরি এবার এ বাক্যের যথার্থতা দেখতে পাব।
Total Reply(0)
fastboy ২৬ নভেম্বর, ২০২০, ১:১৫ পিএম says : 0
সুযোগকেও কাজে লাগিয়ে সেলিম পরিবারের অপকর্ম ঢাকার চেষ্টা চলছে। ........ দেশে কি প্রশাসন নেই?
Total Reply(0)
Julfiker Hossain ২৬ নভেম্বর, ২০২০, ১:৩৭ পিএম says : 0
রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাথে দুর্বৃত্তের চাটুকারিতা, মষির দুর্বলতা অসির দাপটে আইন অজ্ঞতার ভান, আইন অস্বীকার, মারমুখী রক্তচক্ষু পেশীশক্তির ভয়ে অপরাধ সংঘটনে নির্ভিকতা পাচ্ছে দুর্বৃত্ত এসব পোষ্টার সাটিয়ে অসৎ রাজনীতিকে ঘুষখোর, ভ্যবিচারী ও ভূমি জবর দখলকারীরা পিশাচের অভিভাবক হচ্ছে।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন