বিশ্বব্যাপী ভক্তদের কাছে ফুটবলের সোনার ছেলে, যাদুকর, মহারাজা, কিংবদন্তি, ঈশ্বর ইত্যাদি খেতাবে ভূষিত বিশ্বকাপ বিজয়ী অধিনায়ক আর্জেন্টাইন ফুটবলার দিয়েগো ম্যারাডোনা মৃত্যুবরণ করেছেন। গত বুধবার আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আইরেসে নিজের বাড়িতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বিশ্বফুটবলের এই বরপুত্র। তাঁর মৃত্যু সারাবিশ্বে কোটি কোটি ফুটবলভক্ত ও ক্রীড়ামোদী মানুষের অন্তরকে নাড়া দিয়েছে। করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেড়ে চলার পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনোত্তর ট্রানজিশন এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক ঘটনার গুরুত্ব ছাপিয়ে ম্যারাডোনার মৃত্যু সংবাদটি বিশ্বের এক নম্বর সংবাদ শিরোনামে পরিণত হয়েছে। দিয়েগো ম্যারাডোনা ক্রীড়াবিশ্বের এযাবৎকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী ব্যক্তিত্ব হিসেবে ইতিহাসে চিরস্থায়ী আসন নিশ্চিত করছেন। আশির দশকে ফুটবলবিশ্বে ম্যারাডোনার উত্থানের আগে বিশ্ববাসী সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে ব্রাজিলের ব্ল্যাক পার্ল বা কালামানিক খ্যাত ফুটবলের যাদুকর পেলের নামই বিশেষভাবে জানতো। ম্যারাডোনা এসে ফুটবলভক্তদের সব মনোযোগ কেড়ে নেন। সেই ১৯৭৭ সালে আর্জেন্টিনার অনূর্ধ্ব ২০ ফুটবলে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে আর্জেন্তিনোস জুনিয়র থেকে বোকা জুনিয়র্স ক্লাবে স্বীয় প্রতিভা ও দক্ষতার ঝলকানি তাকে বিশ্বের শীর্ষ ফুটবল ক্লাবগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে বেশি সময় লাগেনি। বিশ্বরেকর্ড মূল্যে শীর্ষ অভিজাত ইতালীয় ক্লাব বার্সেলোনা ও নাপোলিতে স্থানান্তরের ঘটনা ছিল ফুটবল বিশ্বের কাছে ম্যারাডোনার অনন্য দক্ষতা ও সম্ভাবনার স্বীকৃতি। খেলার মাঠের জনপ্রিয়তার গন্ডি পেরিয়ে তিনি তাঁর জাতির পরিচয়ের পতাকা হয়ে উঠেছিলেন। তার কারণে বিশ্বে আর্জেন্টিনার পরিচিতির পাশাপাশি ফুটবলের জনপ্রিয়তা নতুন মাত্রা লাভ করেছিল।
ফুটবল ও ক্রিকেটের মত দলভিত্তিক খেলাগুলো দলের সব ভাগের খেলোয়াড়দের দক্ষতা, নৈপুণ্য ও সমন্বয়ের উপর শিরোপা জয়ের সাফল্য নির্ভর করে। কিন্তু ম্যারাডোনা সেই ধারণাকে ম্লান করে দিয়ে একাই বার বার দলের কান্ডারী হয়ে উঠার অসামান্য, অবিশ্বাস্য ম্যাজিক দেখিয়েছেন। আর্জেন্টিনার হয়ে ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত ৪টি ফিফা বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেছিলেন ম্যারাডোনা। ১৯৮৬ সালের ফিফাবিশ্বকাপের টুর্নামেন্টে আর্জেন্টিনার পক্ষে দেয়া ১৪ গোলের মধ্যে ১০টিতেই ম্যারাডোনার অবদান ছিল। আর্জেন্টিনার শিরোপা জয় ম্যারাডোনার একক কৃতিত্ব বলে দাবি করেন ফুটবল বোদ্ধারা। কোয়ার্টার ফাইনালে যুক্তরাজ্যের বিপক্ষে করা ম্যারাডোনার দু’টি গোলই ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। প্রথমটি ম্যারাডোনার হাত লেগে প্রতিপক্ষের গোলপোস্টের জালে জড়ালেও তা রেফারিদের নজর এড়িয়েছিল। এ কারণে এই গোলটিকে ‘হ্যান্ড অব গড’ গোল বলে অভিহিত করা হয়। সে ম্যাচের দ্বিতীয় গোলটি ফুটবল দশর্ক ও পর্যবেক্ষকদের জরিপে শতাব্দীর সেরা গোল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বিশ্বকাপের গুরুত্বপূর্ণ খেলায় ৬০ ফুট দূর থেকে ড্রিবলিং করে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের ৫ জন ডিফেন্ডারকে পরাস্ত করে গোল দেয়ার অনন্য নজির ম্যারাডোনাকে ওয়ান ম্যান আর্মির মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। ম্যারাডোনার ১০ নম্বর জার্সি ফুটবল মাঠে মর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠেছে। আর্জেন্টিনা, ইতালি ও স্পেনিশ ফুটবলের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে বিশ্ব ফুটবলের একটি বর্ণাঢ্য ও বৈচিত্র্যময় অধ্যায় রচনা করেছেন ম্যারাডোনা।
যে কোনো সুপারস্টারের জীবনে উত্থান-পতনের নানা অনুসঙ্গ যুক্ত হয়। আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নেয়ার পর ম্যারাডোনার জীবনেও ডোপটেস্টে মাদক গ্রহণের অভিযোগ, কোচের দায়িত্ব থেকে বহিষ্কারের মতো ঘটনা ঘটেছে। তবে এসব ঘটনা ম্যারাডোনার জনপ্রিয়তা বা তারকার প্রজ্জ্বোল দ্যুতিময়তাকে এতটুকু ম্লান করতে পারেনি। ম্যারাডোনার চেয়ে ২০ বছরের সিনিয়র ফুটবল লিজেন্ড পেলে ম্যারাডোনার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে তাকে তাঁর বন্ধু এবং ফুটবলের অসামান্য লিজেন্ড বলে অভিহিত করেছেন। তিনি পরলোকে একদিন ম্যারাডোনার সাথে ফুটবল খেলার প্রত্যাশাসহ তার পারলৌকিক শান্তির প্রার্থনা করেছেন। ফুটবলের কিংবদন্তি ম্যারাডোনার মৃত্যুতে বাংলাদেশের ফুটবল দর্শকরা এক অসাধারণ প্রেরণার উৎস হারালো। ফুটবলকে ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতার বাইরে একটি বৈশ্বিক সম্প্রীতির মেলবন্ধনে যুক্ত করতে অসামান্য অবদান রয়েছে ম্যারাডোনার। খেলার মাঠে ম্যারাডোনা না থাকলেও বাংলাদেশের ৭০ ভাগ দর্শক আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করেন। ম্যারাডোনার জনপ্রিয়তাই আর্জেন্টিনাকে বিশ্বের সামনে এ উচ্চ আসন দিয়েছে। আমরা জানি ম্যারাডোনার মৃত্যু আমাদের বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের ফুটবলারদের মনে এক ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি করবে। তবে বস্তির ছেলে থেকে ফুটবলের কিংবদন্তি হয়ে ওঠা ম্যারাডোনার বেড়ে ওঠার ইতিহাস যদি তাদের মধ্যে প্রেরণার স্ফুলিঙ্গ ছড়ায়, আমাদের ফুটবলকে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে প্রতিষ্ঠিত করতে তারা সক্ষম হয়, তবেই ম্যারাডোনাপ্রীতি স্বার্থক ও ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠবে। বিশ্বরাজনীতি, অর্থনীতি, আঞ্চলিক বিরোধ-বিসম্বাদের বিতর্ক এড়িয়ে একটি জাতিকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করার অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে ম্যারাডোনা। বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক ফুটবল দর্শকরা আরো দীর্ঘদিন ধরে ম্যারাডোনাকে মিস করতে থাকবেন। তবে ফুটবল যতদিন জনপ্রিয় খেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকবে, ততদিন বা তার পরেও ম্যারাডোনাকে মনে রাখবে বিশ্ববাসী। আমরা এই ফুটবল সম্রাটের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন