গতপরশু রাতে তার জীবন প্রদীপ যখন নিভে যাওয়ার খবর চাউর হলো। তাবৎ দুনিয়া যেন একটা ছোট্ট গ্রাম হয়ে গেল। শত শত কোটি মানুষ ভাসল একই আবেগে! আর কারো জন্য কখনো এমন হয়েছে কি!
শৈশবে দারিদ্র্য, ফুটবল প্রেম। কৈশোরে নাম কুড়ানো, তারুণ্যে দুনিয়া মাত। বাকি জীবনটাও তার তারুণ্যই। ম্যারাডোনা চেনা পথে হেঁটে একটাই জীবন পার করেননি। জীবনকে নিয়ে খেলেছেন বিস্তর। এক জীবনে পেয়েছেন বহু জীবনের স্বাদ।
‘আই অ্যাম ব্লাক অর হোয়াইট, আই উইল নেভার বি গ্রে ইন মাই লাইফ’- মোহনীয় ফুটবল শৈলী, খ্যাপাটে চরিত্র, পরোয়া না করা মানসিকতা, মাদক, একের পর এক বিতর্ক, এসবের মধ্যেই আবার জীবনকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করার উন্মাদনা। নাহ! ডিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা ৬০ বছরের জীবনে এক মুহ‚র্তের জন্যও ধ‚সর হননি। প্রস্থানে যেন হয়ে উঠলেন আরও বর্ণিল।
বাংলাদেশে এমন কোনো মানুষ নেই যে জীবনে একবার হলেও ফুটবলে লাথি মারেননি। কিন্তু ফুটবলে লাথি মারা আর ফুটবল প্রেম তো এক কথা নয়! একেকটা বিশ্বকাপ আসে, বাংলাদেশের কত বাড়ির ছাদে কত পতাকা উড়তে দেখা যায়। কেউ ব্রাজিলের সমর্থক, তার ছাদে বা জানালার গ্রিলে ওড়ে ব্রাজিলের পতাকা। কেউ আবার আর্জেন্টিনার পতাকা ওড়ান গর্ব নিয়ে। জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ইংল্যান্ড- আরও কত কত রঙের পতাকা যে ওড়ে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে! কিন্তু ফুটবলপ্রেমী মাত্রই একটা ব্যাপারে একমত হবেন- বাংলাদেশের মানুষের মনে ফুটবলপ্রেমের বীজ রোপন করে দিয়েছেন একজনই-তিনি ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা!
ফুটবল সম্রাট পেলের খেলা টেলিভিশনে সরাসরি দেখার সৌভাগ্য এ দেশের ক’জন মানুষের হয়েছে জানা নেই। ১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০- পেলে ব্রাজিলের হয়ে যে তিনবার বিশ্বকাপ জিতেছেন, বাংলাদেশের ক’জন মানুষেরই বা তা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে? সেদিক থেকে ফুটবলের কোনো মহানায়কের খেলা সরাসরি টেলিভিশনে দেখার অভিজ্ঞতা এ দেশের মানুষের হয়েছে ম্যারাডোনাকে দিয়েই। ফুটবলের প্রতি গভীর ভালোবাসাটা সেখান থেকেই আসার কথা।
তবে সেই ফুটবলের প্রেমের বীজ তো আর এমনিতেই রোপন হয়নি। ম্যারাডোনার অন্য গ্রহের শিল্পিত ফুটবল শৈলী তো ছিলই। এর সঙ্গে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে আরও কিছু বিষয়। ম্যারাডোনা ফুটবল অঙ্গনে নিজেকে বৈশ্বিক তারকা হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছেন ম‚লত ১৯৮৬ বিশ্বকাপে। জাদুকরী ফুটবলের মায়ায় সেবার তিনি ফুটবল বিশ্বকে করেছিলেন মন্ত্রমুগ্ধ।
ফুটবলের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের বসবাস সেই অনাদিকাল থেকে। কিন্তু ছিয়াশি বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার মনোমুগ্ধকর ফুটবলের অন্য একটা গুরুত্ব আছে এ দেশের মানুষের কাছে। সেবারই প্রথম বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বকাপ দেখে রঙিন টেলিভিশনে। একজন ফুটবলার কীভাবে একা কোনো দলকে বিশ্বকাপের মতো একটি বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে টেনে নিতে পারেন, সেই উদাহরণও তো প্রথম ম্যারাডোনাকে দিয়েই দেখেছে ফুটবল বিশ্ব। সেহির্ও বাতিস্তা, দানিয়েল পাসারেলা, হোর্হে লুইস বুরোচাগা, হোর্হে ভালদানোর মতো খেলোয়াড়ও আর্জেন্টিনার ছিয়াশি বিশ্বকাপ দলে ছিলেন। কিন্তু এটা তো সবারই জানা আর্জেন্টিনা সেবার বিশ্বকাপ জিতেছিল ম্যারাডোনা নামের অতিমানবীয় এক ফুটবলারের নৈপুণ্যে!
সেই বিশ্বকাপে ম্যারাডোনাকে নিয়ে কত স্মৃতিই না ভেসে ওঠে মানুষের মনে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচটিই ধরুন। এ ম্যাচ নিয়ে আলোচনার শেষ কি কখনো হয়েছে! ম্যারাডোনার জোড়া গোলে ম্যাচটি ২-১ গোলে জিতেছিল আর্জেন্টিনা। সেই ম্যাচে একই সঙ্গে নায়ক এবং খলনায়ক ম্যারাডোনা। খলনায়ক ৫১ মিনিটে করা প্রথম গোলটির কারণে। যদিও তিনি খলনায়ক শুধু ইংলিশদের কাছে। গোলটি যে ম্যারাডোনা করেছিলেন হাত দিয়ে! হেডের জন্য লাফিয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু মাথা দিয়ে বলের নাগাল পাননি। রেফারিকে আড়াল করে নিজের বাঁ হাত দিয়ে বলটি ঠেলে দেন ইংল্যান্ডের গোলকিপার পিটার শিলটনের জালে।
ম্যারাডোনার এই গোলটি কখনোই মেনে নিতে পারেননি শিলটন বা ইংল্যান্ডের কেউ। তবে ম্যারাডোনা নিজে এই গোলের নাম দিয়েছিলেন ‘হ্যান্ড অব গড’! বিতর্কিত এই গোলটির কথা বাদ দিন। ৪ মিনিট পর ম্যারাডোনা ইংল্যান্ডের মাঝমাঠ আর রক্ষণের প্রায় সব খেলোয়াড়কে কাটিয়ে যে গোলটি করেছিলেন সেটিকে বিশ্বকাপের ইতিহাসেরই সেরা গোল মানেন অনেকে। গোলটির পর ইংলিশ ধারাভাষ্য বেরি বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘আপনাকে স্বীকার করতেই হবে যে এটি জাদুকরী।’
জাদুকরী সেই ম্যারাডোনা পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ফাইনালেও খেলেছেন অসাধারণ ফুটবল। আর সবশেষে বিশ্বকাপ জয়ের পর তার ট্রফি উঁচিয়ে ধরার দৃশ্যটিও ছিল মোহনীয়। যে দৃশ্য এখনো চোখে লেগে আছে বিশ্বজোড়া ফুটবলপ্রেমীদের।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন