বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

পালিয়েছে দুর্নীতিবাজরা

গোল্ডেন মনির ধরা পড়ায় রাজউকে গ্রেফতার আতঙ্ক সমিতির ২৮০ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা তদন্ত হয়নি

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ২৯ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০০ এএম

গোল্ডেন মনির ধরা পড়লেও তার অন্যতম সহযোগী রাজউকের নেতা আব্দুল মালেকসহ অনেক কর্মকর্তারা এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অনেকে গ্রেফতার অতঙ্কে গা ঢাকা দিয়েছে। আবার কেউ কেউ ইতোমধ্যে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে বলেও শোনা যাচ্ছে। গোল্ডেন মনির গ্রেফতার আতঙ্কে সিবিএ নেতা মালেক ও নান্নু চিকিৎসার কথা বলে সিঙ্গাপুরে পালিয়েছে বলে রাজউকের কর্মকর্তা কর্মচারীরা জানিয়েছেন।

রাজউক সমবায় সমিতির ২৭৮ কোটি ৯৭ লাখ ২৫ হাজার ৭২০ টাকা দুর্নীতি, অনিয়ম এবং আত্মসাৎ করার ঘটনায় মালেকের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন গত এক বছরেও আলোর মুখ দেখছে না। সম্প্রতি বর্তমান সরকার সুশাসন নিশ্চিত করতে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে রাজউকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের তালিকা চেয়েছে বলে জানা গেছে। মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি রাজউকে আসার পর সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। শ্রমিকনেতা মালেক, নান্নু, হামিদ, রুবেল, হাসান, ফরিদ, বশির, মোবারকসহ কয়েকজন ২৮০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে জানিয়ে রাজউক সমবায় সমিতির সদস্যরা চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
রাজউক চেয়ারম্যান সাঈদ নূর আলম গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, দুর্নীতির সাথে রাজউকের কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। সমিতির ২৭৮ কোটি ৯৭ লাখ ২৫ হাজার ৭২০ টাকা আত্মসাতের আভিযোগের বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি এ বিষয়ে তদন্ত করছে। কর্মচারীদের মধ্যে গ্রেফতার আতঙ্কের বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, কেউ যদি দুর্নীতি করে থাকে তাহলে সে হয়তো পালিয়ে থাকতে পারে।

রাজউকের প্রতিষ্ঠাতা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ রফিকুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, গোল্ডন মনির ধরা পড়লেও তার সহযোগীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তারা রাজউক সমবায় সমিতির সাড়ে ৮ হাজার কর্মচারীর ২৭৮ কোটি ৯৭ লাখ ২৫ হাজার ৭২০ টাকা আত্মসাৎ করেছে। তার বিচার এখনো পাইনি। আমাদের নামে বাণিজ্যক প্লট কিভাবে বিক্রি করল তার বিরুদ্ধে সকল স্থানে অভিযোগ করে বিচার পাইনি। অভিযোগ করলে রাজউক চেয়ারম্যান তদন্তের জন্য চিঠি দেন। সে চিঠি পড়ে থাকে বছরের পর বছর। তিনি বলেন, মনির গ্রেফতার হওয়ার পরে মালেক ও নান্নু সিঙ্গাপুরে টাকা পাচার করেছে এবং এখনো পালাতক আছে। তারা অফিস করে না। অনেকে বলাবলি করছে তারা চিকিৎসার নাম করে সিঙ্গাপুরে পালিয়ে গেছে।

রাজউকের একাধিক সূত্র জানায়, ২০০৩ সালে উত্তরা (তৃতীয় পর্ব) প্রকল্পের ২৮৩টি প্লট স্থানান্তর করে উত্তরা প্রথম পর্বে নিয়ে আসা হয়। এ কাজে জড়িত ছিলেন ওই চক্রসহ রাজউকের শ্রমিক দলের সাবেক কার্যকরী সভাপতি আওরঙ্গজেব সিদ্দিকী নান্নু, রাজউকের শ্রমিক নেতা আ. মালেক, জামাল উদ্দিন ওরফে মুরগি জামাল, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক ও বর্তমান উপপরিচালক (হিসাব) জামাল উদ্দিন ওরফে টেবিল জামাল, শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মাহবুব হোসেন সরকার ও বর্তমান সহকারী পরিচালক সাবেক কানুনগো শাহ আলমসহ রাজউকের শীর্ষ কর্মকর্তারা।

বাড্ডার সাবেক কমিশনার এম এ কাইউম হাত ধরে রাজউকে গাল্ডেন মনিরের পদচারণা শুরু হয়। তাদের সঙ্গে চলাফেরা করার মাধ্যমেই রাজউকে প্লট কেনাবেচা, নকশার দালালি শুরু করেন। ২০০১-২০০৫ বাড্ডায় ২২ একর প্রকল্প নেয় রাজউক। বাড্ডা পুনর্বাসন এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করার জন্য নেওয়া হয় এ প্রকল্প। তখন ক্ষতিগ্রস্তদের ‘অ্যাওয়ার্ড সনদ’গুলো প্রভাব খাটিয়ে কিনে নেন। এ রকম চার শতাধিক ক্ষতিগ্রস্তের সনদ তারা কিনে নেন নামমাত্র মূল্যে। এমনকি রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান ইকবাল উদ্দিন চৌধুরী ও সদস্য (এস্টেট) রেজাউল করিম তরফদার, উপপরিচালক (এস্টেট) মাহমুদুর রহমান, সহকারী পরিচালক জামাল উদ্দিন ওরফে টেবিল জামাল, উপপরিচালক শওকত আলী, গোল্ডেন মনির, বাড্ডার সিরাজ মিলে অফিস থেকেই প্লট বরাদ্দের কার্যক্রম শুরু করেন। প্লট বরাদ্দের জন্য সেখানেই অফিস স্থাপন করা হয়। ওই অফিস থেকেই ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হয়। যেসব ক্ষতিগ্রস্ত ওই চক্রের সঙ্গে সমঝোতা করেনি, তাদের নামে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। পরে গোল্ডেন মনির নিজের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেন।

এ ছাড়া গোল্ডেন মনিরের সাথে রাজউকের বিভিন্ন পর্যায়ের অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীদেরও ঘনিষ্ঠতা হয়্ এদের মধ্যে অন্যতম হলো আব্দুল মালেক। রাজউক কর্মচারী বহুমুখী সমবায় লিমিটেডর সাবেক সভাপতি এবং সাবেক শ্রমিকলীগের সভাপতি (অনির্বাচিত) আব্দুল মালেক গার্ড। সাত বছরের মধ্যে রাজউক কর্মচারী সমিতির মাসিক ভাড়া থেকে মালেক এককভাবে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন প্রায় ১৫ কোটি টাকা এবং তিনি সমিতির অনিয়মতান্ত্রিকভাবে তিন বছর কোনো সাধারণ সভা না করে ৭টি দলিলের উত্তরা ১১নং সেক্টর, রোড প্লট ১৭৮ কোটি ৫৩ লাখ ৬ হাজার টাকা বিক্রি করে। যার দলিল নং ৯৮৭৮, ৫৫৬১ ১, ৫৫৫৮, ৫৫৬০, ৯৪৩১ এবং ২২৭৪ (সাফ কবলা হস্তান্তর) চুক্তি অনুযায়ী টাকা নিয়েছেন। রাজউক এর নিবন্ধনকৃত রাজউক কর্মচারী সমিতি এনেক্স ভবনের নিচতলা সাইনবোর্ড এবং অফিস কক্ষ বন্ধ করে রেখেছেন। কমিটি অন্তবর্তিকালীন কমিটিকে তাদের দায়িত্ব হস্তান্তর করতে টালবাহানা শুরু করেছে। ২০১৯ এর মত একতরফা নির্বাচন করার জন্য তারা নীলনকশা শুরু করেছেন বলে রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মনে করে।

সমিতির জমি ২২৭৪ নং দলিলের সাফ কবলা হস্তান্তরযোগ্য মাধ্যমে তিন বছরে কোনো সাধারণ সভা না করে সাধারণ কর্মচারীদের সিদ্ধান্তের বাহিরে এককভাবে আব্দুল মালেক এবং আরঙ্গজেব সিদ্দিকী নান্নু ২০১৮ সালে দলিল নম্বর ৪৫৩৬, মো. মনির হোসেনের কাছে একটি বায়না নামা দলিল সম্পাদন করেন, যাতে উল্লেখ করা হয়েছে রাজউক কর্মচারী সমিতির অবিভক্ত ৩৮% ফ্লোর, কমন স্পেস, কার পার্কিংসহ দুই লাখ আঠারো হাজার ছয় শত ছয় দশমিক চার বর্গফুট রাজউক কর্মকর্তা কর্মচারী সমবায় সমিতি অনিয়মতান্ত্রিকভাবে বিক্রয় করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দলিলের মাধ্যমে ডেভলপারদের কাজ থেকে দলিল ও চুক্তি করে ১৭৮,৫৩,০৬,৮৮২ টাকার মধ্যে মালেক খরচ দেখিয়েছে ১৮ কোটি ৫ লাখ টাকা। মালেক সাধারণ কর্মচারীর টাকা আত্মসাৎ করেছেন। মালেক ক্ষমতা অপব্যবহার করে রাজউক কর্মচারী সমিতির সদস্য শফিউল্লাহ বাবুকে সদস্যপদ বাতিল করেন। এক পর্যায় জেলা সমবায় অফিস ঢাকা কর্তৃক তার সদস্যপদ পুনর্বহাল করে। সমবায় আইন ২০০১ এবং ২০০২ এর সংশোধিত মোতাবেক ৩০ দিনের মধ্যে অন্তরর্বতীকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। তখন গোল্ডন মনিরের বাহিনী মালেক নতুন করে আবার তালবাহানা শুরু করে।

গত বছরের ১৫ অক্টোবর রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. সুলতান আহমেদ রাজউকে শুদ্ধি অভিযান চালান। তখন ৭১টি ফাইল মনিরের কক্ষ থেকে উদ্ধার করা হয়। এর পর থেকেই রাজউকে যাতায়াত কমিয়ে দেন মনির। তখন মনির ও রাজউকের অফিস সহকারী পারভেজসহ বেশ কয়েকজনের নামে মামলা হয়। গোল্ডেন মনির রাজউকে যাতায়াত কমিয়ে পূর্ত ভবনে জি কে শামীমের শূন্যস্থান পূরণে তৎপর হয়ে ওঠেন। এদিকে রাজউকে মনিরের জায়গা দখলে তৎপর হয়ে ওঠেন শ্রমিকনেতা আ. মালেক, আওরঙ্গজেব সিদ্দিকী নান্নু, রাজউকের পূর্বাচল সেলের তত্ত্বাবধায়ক গিয়াস উদ্দিন ও নিম্নমান সহকারী জাফর।

রাজউকের কর্মচারীরা জানান, গোল্ডেন মনির যখন রাজউকে যেতেন, তখন নিরাপত্তাকর্মীরা তৎপর হয়ে উঠতেন। চেয়ারম্যানের গাড়ির পাশেই মনিরের গাড়ির পার্কিং নির্ধারিত থাকত। প্রাডো ভি-৮ গাড়িতে দেহরক্ষী হিসেবে সশস্ত্র অবস্থায় থাকতেন সিরাজ, রাজউকের সাঈদুর, মামুন ও তৌহিদ। রাজউক কর্মকর্তা-কর্মচারী সমবায় সমিতির নামে রাজউক ৯৪ কাঠার একটি প্লট উত্তরায় বরাদ্দ দেয়। বিভিন্ন কৌশলে মালেক এবং নান্নু ৩০০ কোটি টাকার ওই বাণিজ্যিক প্লটটিও মনিরের কাছে বিক্রি করেন। পরে মনির দখল করে নেন। প্রথমে সমিতির কাছ থেকে অনুমোদন ছাড়াই পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নেন মনির। পরে নামমাত্র মূল্য দিয়ে সাফ কবলা দলিল করে নিজের নামে নিয়ে নেন। ওই নামমাত্র মূল্যের ১৫০ কোটি টাকার একটি টাকাও রাজউকের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পাননি। অভিযোগ বলা হয় ওই দেড়শ কোটি টাকা শ্রমিকনেতা মালেক, নান্নু, হামিদ, রুবেল, হাসান, ফরিদ, বশির, মোবারকসহ কয়েকজন আত্মসাৎ করেছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Mohin Uddin Molla ২৯ নভেম্বর, ২০২০, ২:১১ এএম says : 0
কিছুই হবে না। এটা আমাদের ডিজিটাল গনতন্ত্রের ফলাফল।
Total Reply(0)
abu hasan ২৯ নভেম্বর, ২০২০, ১০:০৩ এএম says : 0
আপনার লেখায় একমত পোষণ করি।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন