‘আমাদের দেশে অনেকাংশে ডিভোর্সের (তালাক) সংখ্যা বেড়ে গেছে। তবে ডিভোর্সের মধ্যে শিক্ষিত লোকের সংখ্যাই বেশি। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই প্রবণতাটা কম।’ একটি জামিন আবেদনের শুনানিকালে এমন মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। গতকাল সোমবার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের ডিভিশন বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।
একটি ধর্ষণ মামলায় আসামির পক্ষে জামিন শুনানির একপর্যায়ে আদালত আরো বলেন, ‘আমরা তো নানাভাবে সমালোচিত হচ্ছি। আসলে ব্যক্তিগতভাবে দুই-একটি পত্রিকার রিপোর্ট দেখে খুব অফেন্ডেড (অপরাধবোধ) হয়েছি। যেখানে লেখা হয়েছে ‘ধর্ষকের সাথে ধর্ষিতার বিয়ে’ এভাবে তো রিপোর্ট হওয়া উচিত না। আবার নারীবাদী সংগঠনগুলো বলছে এ ধরনের বিয়েতে ধর্ষকরা উৎসাহিত হবে।’ ‘যে যা-ই সমালোচনা করুক, আমরা এটাকে উৎসাহিত করব’ এমনটি উল্লেখ করে বিচারক বলেন, ‘প্রযুক্তির কারণে এখন সমাজে মানুষের সম্পর্ক গড়তেও সময় লাগে না, ভাঙতেও সময় লাগে না। দেখবেন আমাদের দেশে ডিভোর্সের সংখ্যা অনেকাংশে বেড়ে গেছে। শিক্ষিত লোকদের মধ্যে বেশি হচ্ছে বরং সাধারণ মানুষের মধ্যে এই প্রবণতাটা কম।’
শুনানিতে জামিন প্রার্থনাকারী জিয়ার আইনজীবী ফারক আলমগীর চৌধুরী আদালতের উদ্দেশে বলেন, যেখানে মামলায় মেয়েটা বলছে, আমি তাকে দীর্ঘদিন ধরে ভালোবাসি। তার সঙ্গে আমার মনোমালিন্য ঠিক হয়ে গেছে। এখানে দেখতে হবে অন্যায় কিছু হয়েছে কি না। মেয়েটা বলছে, আমার সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক। কিন্তু বিয়ে না করায় থানায় মামলা করা হয়েছে। এটা নিয়ে জজ কোর্টেও আপস করার চেষ্টা করেছে মেয়েটি। তারপর তারা হাইকোর্টে এসেছে। সকলের উপস্থিতিতে বিয়ে হয়েছে। এখানে অন্যায়ের কী হয়েছে? আর এভাবে কথায় কথায় যদি ধর্ষণের মামলা হয়ে যায়, যেখানে ধর্ষণের কোনো ভিত্তি নেই, কোনো মেডিক্যাল রিপোর্টও নেই। তারপরও কেন জামিন হবে না।’
এ সময় আদালতে সংযুক্ত আইনজীবী বলেন, ‘মাই লর্ড এমন আদেশ দেয়া হোক যাতে ভবিষ্যতে তাদের সংসারে কোনো সমস্যার সৃষ্টি না হয়। বিয়ে নামক কথার কারণে জামিন হয়ে গেল তারপর যাতে সংসার ভেঙে না যায়। সে জন্য কোনো নির্দেশনা বা কঠোরতা দিয়ে দেয়া যায় কি না ভেবে দেখবেন।’
তখন আদালত আরো বলেন, ‘মিস্টার ডিএজি! ঘর-সংসার কি কোনো কঠোরতা দিয়ে হবে? ১৫-২০ বছর সংসার করার পরও ঘর ভেঙে যাচ্ছে। শিক্ষিত লোক, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর দু’জনই কোর্টে এসেছে; দেখা গেছে তাদেরও এতদিনের সংসার ভেঙে গেছে। আদেশ-নিষেধ নিয়ে কি ঘর সংসার টেকানো যাবে?’
এ পর্যায়ে সরকারপক্ষীয় আইনজীবী আদালতের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘একটা শর্ত দিয়ে জামিন দেয়া যায় কি না বিষয়টি বিবেচনা করতে।’ তখন আদালত বলেন, ‘আমরা যদি কোনো শর্ত দিয়ে দেই, মেয়ের সঙ্গে কোনো খারাপ আচরণ করলে জামিন বাতিল হবে তাহলে দেখা যাবে মেয়ে যদি বলে আমাকে আগে ১০ বিঘা সম্পত্তি লিখে দিতে হবে, সমাজে এমন ঘটনা কিন্তু ঘটছে। সব থেকে বড় কথা হলো, দু’জনের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার সম্পর্কটাই আসল।’
আদালত বলেন, প্রযুক্তির কারণে, ‘ফেসবুকের কারণে এখন সমাজে মানুষের সম্পর্ক গড়তেও সময় লাগে না, ভাঙতেও সময় লাগে না। জামিনের অপব্যবহার করলে ওই নারী তো অভিযোগ আনতেই পারবেন। আমরা আশা করব সংসারটা ভালোভাবে চলুক।’ জামিন প্রার্থনাকারীর আইনজীবীও তখন বলেন, ‘আমার এলাকার বাসিন্দা আমিও বিষয়টি খেয়াল রাখব।’
পরে আদালত বলেন, ‘রুল দিলাম, জামিন দিলাম, অপব্যবহার করলে জামিন বাতিল করতে পারবে। আর যদি প্রমাণিত হয় যে, জামিনের জন্য বিয়ে তাহলে কিন্তু জামিন বাতিল হবে। ঠিক আছে এক বছর দেখি। এই বলে আদালত এক বছরের জামিন দেন।
প্রসঙ্গত, মামলার আসামি জহিরুল ইসলাম ওরফে জিয়া উদ্দিনের বাড়ি ফেনীর সোনাগাজীর ৮ নম্বর চরদরবেশ ইউনিয়নের দক্ষিণ-পশ্চিম চরদরবেশ গ্রামে। গত ২৭ মে ভোরে একই ঘরে অবস্থান করা অবস্থায় গ্রামবাসী জিয়া ও অভিযোগকারী মেয়েটিকে আটক করে। স্থানীয়রা দু’জনকে বিয়ে দিতে চাইলে ছেলের বাবা আবু সুফিয়ান মেম্বার এতে আপত্তি জানান। সেদিন মেয়েটি সোনাগাজী থানায় ধর্ষণ মামলা করেন। পুলিশ একই দিন গ্রেফতার করে জিয়াকে।
এদিকে উভয় পক্ষের সম্মতি থাকলে বিয়ের ব্যবস্থা করতে কারা কর্তৃপক্ষকে গত ১ নভেম্বর নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ১৯ নভেম্বর ফেনী কারাগারে আসামি জিয়া উদ্দিনের সঙ্গে বিয়ে হয় ওই নারীর। এরপর ২৯ নভেম্বর হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেন জিয়া। শুনানি শেষে গতকাল সোমবার আসামি জিয়াকে এক বছরের জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেন হাইকোর্ট।
গতকাল সরকারপক্ষে শুনানিতে অংশ নেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারওয়ার হোসেন বাপ্পী। আসামিপক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট ফারুক আলমগীর চৌধুরী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন