১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সেকারণে প্রতিবছর ২ ডিসেম্বর এলেই পাহাড় ও জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক অঙ্গন, বুদ্ধিজীবী সমাজ ও মিডিয়াতে শান্তিচুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়। শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন, অর্জন, ব্যর্থতা, পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন, নিরাপত্তা পরিস্থিতি প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা ও বিশ্লেষণ হয়। ২ ডিসেম্বর ২০২০ শান্তিচুক্তির ২৩ বছর পূর্তি। যদিও আলাপ-আলোচনায়, বক্তৃতা-বিবৃতিতে এ চুক্তিকে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ বা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি’ হিসেবে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবে এই চুক্তির নাম শান্তিচুক্তি, পার্বত্যচুক্তি, কালোচুক্তি কিছুই নয়। সরকারি গেজেট অনুযায়ী, এ চুক্তির নাম বা শিরোনাম হচ্ছে, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির সহিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির স্বাক্ষরিত চুক্তি।’ তবে আলোচনার সুবিধার্থে বর্তমান লেখায় এ চুক্তিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বলে সম্বোধন করা হবে।
শান্তিচুক্তির বর্ষপূর্তিতে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে। শান্তিচুক্তির কোন কোন ধারা বাস্তবায়িত হলো, কোন কোন ধারা বাস্তবায়িত হলো না সেসব নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। সরকার শান্তিচুক্তির বেশিরভাগ বাস্তবায়নের দাবি করে, অন্যদিকে সন্তু লারমা শান্তিচুক্তির অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়িত হয়নি দাবি করে পুনরায় সশস্ত্র বিদ্রোহের হুমকি দিয়ে থাকেন।
শান্তিচুক্তি ৪ খন্ডের বিভক্ত। ক খন্ডে ৪টি, খ খন্ডে ৩৫টি, গ খন্ডে ১৪টি, এবং ঘ খন্ডে ১৯টি মিলে সর্বমোট ৭২টি ধারা রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর তাঁর কার্যালয়ে ২০১৭ সালে আমাকে দেয়া এক স্বাক্ষাৎকারে বলেন, ক খন্ডের ১, ২, ৩, ৪ ধারা; খ খন্ডের ১, ২, ৩, ৫, ৬, ৭, ৮, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ২০, ২১, ২২, ২৩, ২৫, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ও ৩৩ ধারা; গ খন্ডের ১, ৭, ৮, ৯, ১০, ১২, ১৪ ধারা এবং ঘ খন্ডের ১, ৫, ৮, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৯ ধারা মিলে মোট ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে। খ খন্ডের ৪(ঘ), ৯, ১৯, ২৪, ২৭, ৩৪; গ খন্ডের ২, ৩, ৪, ৪, ৫, ৬ এবং ঘ খন্ডের ৪, ১৬, ১৭, ১৮ নম্বর মিলে মোট ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। খ খন্ডের ২৬, ২৯, ৩৫; গ খন্ডের ১১, ১৩ এবং ঘ খন্ডের ২, ৩, ৭, ৯ নম্বর ধারা মিলে মোট ৯টি ধারার বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এক্ষেত্রে পরিস্থিতি এখনো ভিন্নতর হয়নি।
জেএসএস সভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা সরকারের এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার মতে, সরকার শান্তিচুক্তির মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়ন করেছে। এছাড়াও ১৩টি ধারা আংশিক বাস্তবায়ন করেছে এবং ৩৪টি ধারা অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। তিনি শান্তিচুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে একাধিকবার অসহযোগ আন্দোলনেরও ডাক দিয়েছেন; একই সাথে এ চুক্তি বাস্তবায়িত না হলে পুনরায় সহিংস আন্দোলন শুরু হতে পারে বলেও হুমকি দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু সন্তু লারমা মিথ্যা প্রচারণা করছেন বলে দাবি করেছেন সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার। ২০১৪ সালের ২০ আগস্ট নানিয়ারচরে এক সভায় তিনি দাবি করেন, ২০১৩ সালে চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির সভায় ৪৮টি সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়েছে বলে মতৈক্যপত্রে সন্তু লারমা স্বাক্ষর করেছেন। এই মতৈক্য পত্রে বলা হয়েছে, অবশিষ্ট ধারাসমূহ পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। তবে ২০১৭ সালের ২৯ নভেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে ঢাকায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ৩৭টি মৌলিক বিষয় রয়েছে। যার মধ্যে ৪টি পূর্ণ বাস্তবায়িত, ৯টি আংশিক বাস্তবায়িত এবং ২৪টি অবাস্তবায়িত বিষয় রয়েছে।
যাহোক, সরকার শান্তিচুক্তির ৪৮টি ধারা বাস্তবায়িত করেছে নাকি ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত করেছে তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ ও মিডিয়া সবসময় ভুলে যায় শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল দুই পক্ষের মধ্যে এবং এ চুক্তিতে দু’পক্ষের জন্যই পালনীয় কিছু শর্ত ছিলো। এই চুক্তিতে বাংলাদেশ সরকারের জন্য পালনীয় কিছু শর্ত যেমন ছিলো, তেমনি সন্তু লারমা বা জেএসএসের জন্যও পালনীয় শর্ত ছিলো। কিন্তু শান্তিচুক্তির আলোচনায় কেবল সরকারের জন্য পালনীয় শর্তাবলী নিয়েই সকল আলোচনা হয়। সরকার কতগুলো শর্ত পালন করলো, কতগুলো করলো না, না করায় কী সমস্যা হচ্ছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা হয়, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও সন্তু লারমা বা জেএসএসের জন্য পালনীয় শর্ত নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না।
শান্তিচুক্তিতে জেএসএস ও সন্তু লারমার জন্য যে শর্ত রয়েছে তার প্রধান হলো: ‘অস্ত্র সমর্পণের মাধ্যমে জেএসএসের সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা।’
শান্তিচুক্তির ঘ খন্ডে বলা হয়েছে: ‘১২) জনসংহতি সমিতি ইহার সশস্ত্র সদস্যসহ সকল সদস্যের তালিকা এবং ইহার আওতাধীন ও নিয়ন্ত্রণাধীন অস্ত্র ও গোলাবারুদের বিবরণী এই চুক্তি স্বাক্ষরের ৪৫ দিনের মধ্যে সরকারের নিকট দাখিল করিবেন। ১৩) সরকার ও জনসংহতি সমিতি যৌথভাবে এই চুক্তি স্বাক্ষরের ৪৫ দিনের মধ্যে অস্ত্র জমাদানের জন্য দিন, তারিখ ও স্থান নির্ধারণ করিবেন। জনসংহতি সমিতির তালিকাভুক্ত সদস্যদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমাদানের জন্য দিন তারিখ ও স্থান নির্ধারণ করার জন্য তালিকা অনুযায়ী জনসংহতি সমিতির সদস্য ও তাহাদের পরিবারবর্গের স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তনের জন্যে সব রকমের নিরাপত্তা প্রদান করা হইবে। ১৪) নির্ধারিত তারিখে যে সকল সদস্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দিবেন সরকার তাহাদের প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করিবেন। যাহাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা আছে সরকার ঐ সকল মামলা প্রত্যাহার করিয়া নিবেন। ১৫) নির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে কেহ অস্ত্র জমা দিতে ব্যর্থ হইলে সরকার তাহার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিবেন।’
কিন্তু সন্তু লারমা ও জেএসএস কি এই শর্ত পালন করেছে? এই প্রশ্ন কোথাও উত্থাপন করা হয় না। পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে একজন আগ্রহী পাঠক হিসেবে জানি বা সারা দেশের মানুষ জানেন, সন্তু লারমা ও জেএসএস এই শর্তটি শুরুতেই আংশিকভাবে পালন করেছে। বর্তমানে এই শর্তটি পূর্ণাঙ্গভাবে লঙ্ঘন করে চলেছেন। সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর ১৯৯৮ সালে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন শান্তিবাহিনী চার দফায় আত্মসমর্পণ করে। এরমধ্যে ১১ ফেব্রæয়ারি ১৯৯৮ তারিখে খাগড়াছড়িতে ৭৩৯ জন আত্মসমর্পণ করেন। তাদের সমর্পণকৃত অস্ত্রের মধ্যে ১৪টি টি-৫৬ রাইফেল, এসএমজি টি-৫৬ ১২টি, এলএমজি ৭টি, জি থ্রি রাইফেল ১৩১টি, এসএমসি ৩১টি, ৩০৩ ব্রেন এলএমজি ১৪টি, মোর টি-৬৩ ৩টি, মোর(ব্রিটিশ) ৪টি, থ্রি নট থ্রি রাইফেল ৮১টি, পিস্তল/রিভলভার ৫টি, সিএম স্ট্যান্ড ২৪টি, ২ মোর ১টি, ৪০ এমএম আরএল ১টি, পাইপ গান ২৬টি, এসএলআর ৮৩, স্মল ব্রোক রাইফেল ১টি। মোট ৪৩৮টি। ১৬ ফেব্রæয়ারি ১৯৯৮ তারিখে বাঘাইহাট স্কুলে আত্মসমর্পণ করেন ৫৪২ জন। তাদের জমা দেয়া অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে টি-৫৬ রাইফেল ১৩টি, এসএমজি টি-৫৬ ৯টি, এলএমজি ৬টি, জি থ্রি রাইফেল ৩২টি, এসএমসি ১৪টি, মোর টি-৬৩ ১টি, থ্রি নট থ্রি রাইফেল ১০০টি, পিস্তল/রিভলভার ৪টি, পাইপ গান ৪টি, এসএলআর ৩৬। মোট ২১৯টি। ২২ ফেব্রæয়ারি ১৯৯৮ তারিখে বাঘাইছড়ির বরাদম স্কুলে ৪৪৩ জন অস্ত্র সমর্পণ করেন। এরমধ্যে এসএমজি টি-৫৬ ২টি, জি থ্রি রাইফেল ২টি, এসএমসি ১৫টি, থ্রি নট থ্রি রাইফেল ৩০টি, এসএলআর ১১টি। মোট ৬০টি। ৫ মার্চ ১৯৯৮ তারিখে পানছড়ির দুদুকছড়িতে ২২২ জন শান্তি বাহিনীর সদস্য অস্ত্র সমর্পণ করেন। এরমধ্যে টি-৫৬ রাইফেল ৯টি, এসএমজি টি-৫৬ ৬টি, জি থ্রি রাইফেল ৯টি, এসএমসি ১টি, থ্রি নট থ্রি রাইফেল ৩টি, এসএলআর ৩। মোট ৪৪টি। সর্বমোট ১৯৪৬ জন ৭৬১টি অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন।
তবে খাগড়াছড়িতে আত্মসমর্পণের দিনই জেএসএসের একটি অংশ অস্ত্র সমর্পণের বিরোধিতা করে কালো পাতাকা প্রদর্শন করে এবং পরবর্তীকালে গ্রæপটি ইউপিডিএফ নামে আত্মপ্রকাশ করে। তবুও পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির অন্বেষায় সরকার সন্তু লারমা ও তার দলের সহস্রাধিক সশস্ত্র সদস্যের বিরুদ্ধে খুনসহ সকল অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেয় এবং ২০ দফা প্যাকেজের আওতায় তাদেরকে পুনর্বাসন করে। জেএসএসের সকলে অস্ত্র সমর্পণ না করলেও সরকার একটি ব্রিগ্রেডসহ ২৪০টি নিরাপত্তা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেয়। অপরপক্ষে জেএসএস সন্তু লারমার পক্ষে পালনীয় শর্ত ছিলো, অবৈধ অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা এবং দেশের প্রতি আনুগত্য করা। কিন্তু জেএসএসের মূল গ্রæপও যে সেদিন সম্পূর্ণ অস্ত্র সমর্পণ করেনি, তার প্রমাণ শান্তিচুক্তির অব্যবহতি পরে শুরু হওয়া উপদলীয় সশস্ত্র সংঘাত, যা আজো চলমান রয়েছে। একথা বহুবার আলোচিত হয়েছে যে, জেএসএস কৌশলে তাদের সবচেয়ে চৌকস যোদ্ধাদের আত্মসমর্পণ করায়নি এবং উন্নত ও ভয়ঙ্কর অস্ত্রশস্ত্র জমা না দিয়ে ভাঙাচোরা ও পুরনো কিছু অস্ত্র সমর্পণ করে। সন্তু লারমা নিজেও সেকথা স্বীকার করেন। গত ২০১১ সালের ২৫ নভেম্বর ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের সাংবাদিক শামিমা বিনতে রহমানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সন্তু লরমা সকল অস্ত্র জমা দেয়ার কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। এটা ছিলো শান্তিচুক্তির সাথে, তথা জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর। ফলে শান্তিচুক্তির প্রভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের তীব্রতা কমলেও তা বন্ধ হয়নি কখনো।
সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শান্তিচুক্তির পূর্বে নিরাপত্তা বাহিনী ১৬০৯টি অস্ত্র উদ্ধার করেছে। এর মধ্যে গ্রেনেড ৩৫৯টি, মর্টার ৭০টি, মাইন ১৩টি এবং অন্যান্য গোলাবারুদ সাড়ে ৪ লক্ষ। এই পরিসংখ্যানে আরো দেখা গেছে, শান্তিচুক্তির পরে ২০০৫ সাল থেকে ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত ২৬৩০টি অস্ত্র ও ১৮৪৫৬৯টি গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। শান্তিচুক্তির পূর্বে ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত শান্তিবাহিনী কর্তৃক ২৩৮ জন উপজাতি, ১০৫৭ জন বাঙালি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ১৭৮ জন উপজাতি ও ৬৮৭ জন বাঙালি। অপহরণের শিকার হয়েছে ২৭৪ জন উপজাতি ও ৪৬১ জন বাঙালি। একই পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শান্তিচুক্তির পরে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি আঞ্চলিক সন্ত্রাসী সংগঠন কর্তৃক ৪৪১ জন উপজাতি, ২৭১ জন বাঙালি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৬৭২ জন উপজাতি ও ৮২৮ জন বাঙালি। অপহরণের শিকার হয়েছে ৯৯১ জন উপজাতি ও ৪২০ জন বাঙালি। সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষণায় আরো দেখা গেছে, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ৩৫৯ জন সদস্য নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৪৩০ জন এবং অন্যভাবে ২২৭ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। একই পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শান্তিচুক্তির পূর্বে শান্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর ৩৪৩ জন সদস্য নিহত হয়েছে। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর ১৭৩, বিজিবি ৯৬, পুলিশ ৬৪, আনসার ভিডিপির ১০ জন। নিহত সেনা সদস্যদের মধ্যে অফিসার ৫ জন, জেসিও ৩ জন, বাকিরা সৈনিক। তবে শান্তিচুক্তির পরে পার্বত্য চট্টগ্রামে নানা কারণে নিরাপত্তা বাহিনীর মোট ১৬ জন সদস্য মারা গেছে। এর মধ্যে শান্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে মারা গেছে ১১ জন, ৫ জন রাঙামাটির ভূমিধসে। এদের মধ্যে সেনাবাহিনীর ৮ জন, বিজিবি ২ জন, পুলিশ ২ জন ও আনসার ভিডিপি ৪ জন।
২০১৯ সালের ১৮ মার্চ বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে ফেরার পথে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের উপর সন্ত্রাসীরা ব্রাশ ফায়ার করলে ঘটনাস্থলেই ৭ জন নিহত এবং ১৬ জন আহত হয়। এ ঘটনার তদন্তে গঠিত সরকারি তদন্ত কমিটির অভিযোগের আঙ্গুল শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষরকারী জেএসএস ও ইউপিডিএফের দিকে। এই নৃশংস হত্যাকান্ডের পরও দেশের সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়া কেউ জেএসএস বা সন্তু লারমাকে প্রশ্ন করেনি। গণমাধ্যমে প্রকাশ, পাহাড়ে ৩ হাজার আগ্নেয়াস্ত্রসহ ১৩ হাজার সন্ত্রাসী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে তিন হাজার সশস্ত্র এবং দশ হাজার সেমি আমর্ড সন্ত্রাসী। কাউকে তো জেএসএস ও সন্তু লারমাকে আজ পর্যন্ত এ প্রশ্ন করতে দেখা গেল না যে, পাহাড়ে এতো অস্ত্র কেন? কেন শান্তিচুক্তি অনুযায়ী পালনীয় সবচেয়ে বড় শর্ত এখনো পালিত হয়নি? শুধু তাই নয়, শত শত পাহাড়ি যুবক ইতোমধ্যে প্রতিবেশী দেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে এবং এখনো করছে। সীমান্ত পথে প্রবেশ করেছে রকেট লাঞ্চার, গ্রেনেড, হাউয়িটর্জারসহ বিভিন্ন ভয়ঙ্কর যুদ্ধাস্ত্র কেন এসব ভয়ানক যুদ্ধাস্ত্র পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করছে, এ প্রশ্ন সন্তু লারমাকে কেউ করেনি কেন?
জেএসএস ও এর নেতা সন্তু লারমা শান্তিচুক্তি করেছিলেন নিজেদের উপজাতি বলে স্বীকৃতি দিয়ে। এ চুক্তির (ক) খন্ডের ১ নং ধারায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল’ বলে স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি। এ চুক্তির বিভিন্ন ধারায় বলা হয়েছে: ‘খ. ১) পরিষদের আইনে বিভিন্ন ধারায় ব্যবহৃত ‘উপজাতি’ শব্দটি বলবৎ থাকিবে। ৮) ১৪ নম্বর ধারায় চেয়ারম্যানের পদ কোন কারণে শূন্য হইলে বা তাহার অনুপস্থিতিতে পরিষদের অন্যান্য সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত একজন উপজাতীয় সদস্য সভাপতিত্ব করিবেন এবং অন্যান্য দায়িত্ব পালন করিবেন বলিয়া বিধান থাকিবে। ১১) ২৫ নম্বর ধারার উপ-ধারা (২) এ পরিষদের সকল সভায় চেয়ারম্যান এবং তাহার অনুপস্থিতিতে অন্যান্য সদস্যগণ কর্তৃক নির্বাচিত একজন উপজাতীয় সদস্য সভাপতিত্ব করিবেন বলিয়া বিধান থাকিবে। ১২ (২) এ পরিষদে সরকারের উপ-সচিব সমতুল্য একজন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা সচিব হিসাবে থাকিবেন এবং এই পদে উপজাতীয় কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার প্রদান করা হইবে বলিয়া বিধান থাকিবে। গ. ২) পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্যগণের দ্বারা পরোক্ষভাবে এই পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হইবেন যাহার পদমর্যাদা হইবে একজন প্রতিমন্ত্রীর সমকক্ষ এবং তিনি অবশ্যই উপজাতীয় হইবেন। ঘ. ১৮) পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সরকারী, আধা-সরকারী, পরিষদীয় ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সকল স্তরের কর্মকর্তা ও বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মচারী পদে উপজাতীয়দের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীদের নিয়োগ করা হইবে।’
এইভাবে শান্তিচুক্তির ভূমিকা থেকে শুরু করে ৭২টি ধারার মধ্যে কমপক্ষে ৫০ বার উপজাতি বা উপজাতি প্রত্যয়যুক্ত শব্দ রয়েছে, যাতে তিনি স্বাক্ষর করেছেন। অথচ, এখন সন্তু লারমা ও তার দল জেএসএস নিজেদের ‘আদিবাসী’ বলে দাবি করছে। সন্তু লারমা নিজে ‘বাংলাদেশ আদিবাসী পরিষদ’র সভাপতির পদ অলংকৃত করছেন। এটা কি শান্তিচুক্তির লংঘন নয়? উপজাতি কোটায় ভর্তি, চাকরিসহ আর্থিক ও অন্যান্য সকল সুবিধা নিতে বাঁধে না, কিন্তু নিজেদের উপজাতি স্বীকার করতে তাদের লজ্জাবোধ, হেয় মনে হয়!
বাংলাদেশ একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত্য রাখিয়া...’ শান্তিচুক্তি করে এখন স্বায়ত্তশাসন দাবি কি শান্তিচুক্তির লংঘন নয়? তাছাড়া তিনি দাবি করছেন, শান্তিচুক্তি শুধু লিখিতই ছিলো না, অনেক অলিখিত শর্ত ছিলো সমঝোতা আকারে, যা তিনি বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন। যদিও আওয়ামী লীগ সরকারের তরফে এ ধরনের কোনো অলিখিত সমঝোতা বা শর্তের কথা অস্বীকার করা হয়েছে। ফলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা, সন্তু লারমা মূলত শান্তিচুক্তি থেকে বেরিয়ে যেতেই এই অলিখিত শর্তের ধুয়া তুলেছেন। বিশেষ করে তার সাম্প্রতিক কর্মকান্ডগুলো এবং দলীয় সশস্ত্র কর্মীদের দেয়া গোপন নির্দেশনাগুলো তারই ইঙ্গিত বহন করে।
অন্যদিকে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি সন্তু লারমা কতোটুকু আনুগত্যশীল তা নিয়েও অনেকের প্রশ্ন রয়েছে। শান্তিচুক্তির পর ১৯৯৯ সাল থেকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন, জাতীয় পতাকা সম্বলিত গাড়িতে যাতায়াত করছেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের পরিচয়পত্র গ্রহণ করেন নাই বলে গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ। বাংলাদেশের কোনো জাতীয় দিবসও তিনি পালন করেন না। এসব কি শান্তিচুক্তির লংঘন নয়? চলতি বছর সমগ্র জাতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষ উদযাপন করছে। অথচ, সরকারি বরাদ্দে পরিচালিত তার নেতৃত্বাধীন আঞ্চলিক পরিষদকে আজ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে একটি কর্মসূচিও গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। এরপরও কীভাবে বলা যায়, সন্তু লারমা বা জেএসএস বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতার প্রতি অবিচল আনুগত্য পোষণ করে?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন