শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

সর্বকালের উত্তম আদর্শ

মুন্সি আব্দুল কাদির | প্রকাশের সময় : ৩ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

পৃথিবীতে আমাদের আগমন, বসবাস। এখানে আমাদের দিন রাত চলতে হয়। চলতে চলতে কখনও রোগাক্রান্ত হই। চিকিৎসা নেই সুস্থ হই। কোন কোন রোগ আর সেরে উঠে না। কোন কোন রোগ এক্কেবারে পরপারে পাড় করে দেয়। আবার কোন কোন রোগ আগাম সতর্কতায় কাছে ঘেঁষতে পারে না। এই আগাম সতর্কতা বা প্রতিরোধ। রোগাক্রান্ত হলে চিকিৎসা বা প্রতিকার করার নামই আদর্শ। আদর্শ মানে অন্যায়ের প্রতিরোধ করার যোগ্যতা, গুনাগুন অর্জন করা। খারাপের দিকে গেলে কল্যাণের দিকে ফিরে আসা। ভুল পথ থেকে সঠিক পথে ফিরে আসা, নিজেকে সংশোধন করা। ভালর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা।

আদর্শ হলো এমন এক আলোকের নাম যা শুধু সত্যের পথ দেখায়। এমন এক প্রদীপ যা জ্বলে উঠলে অন্যায়, অকল্যাণ, অসত্যরা ভয়ে মুখ লুকায়। আদর্শ শুধু মুখে থাকলে অথবা অধরা হিসাবে বইয়ের পাতায় থাকলে কখনও কখনও উপকারে লাগতে পারে। কিন্তু ব্যাপক ভাবে সমাজ পরিবর্তনে তেমন কাজে লাগে না। কোন আদর্শ যদি বাস্তব সামনে এসে হাজির হয়। জীবন্তভাবে তার রূপ দেখা যায়। তখন মানুষ প্রভাবিত হয়। সমাজ পরিবর্তন হয়।

মানুষ ভাল এবং মন্দ দুই দিকেই প্রভাবিত হয়। ভাল পথ তাকে সত্য সুন্দরের দিকে চালিত করে। অপর দিকে মন্দ তাকে অকল্যাণ ধ্বংস আর ক্ষতির দিকে নিয়ে যায়। আবার এই দুটো কেউ আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে। কেউ কল্যাণকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করলে এই আদর্শকে কোরআনের ভাষায় বলা হয় উসওয়াতুন হাসানাহ বা উত্তম আদর্শ। অন্যদিকে যখন কোন মন্দকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে তাকে বলা হয় উসওয়াতুস সাইয়্যিয়াহ বা মন্দ আদর্শ।

আদর্শের সংঘাত চলে আসছে মানব সৃষ্টির সূচনা থেকে। অন্যায় আদর্শ মানুষকে বিপথগামী করে। মহান রবকে ভুলিয়ে দিয়ে। মানুষ স্বেচ্ছাচারী হয়। অন্যায় পথে গা ভাসিয়ে দেয়। সে সমাজের জন্য বিষফোঁড়া রূপে আত্মপ্রকাশ করে। তার মধ্যে চোখ ধাঁধানো চাকচিক্য থাকলেও গোখরা সাপ ফণা তুলে লুকিয়ে থাকে। যে কোন সময় তাকে ছোবল দিয়ে ধ্বংস করে দেয়। মানুষ চলতে চলতে ভুল পথে চলে যায়। তার জন্য যুগে যুগে মহান রব অনেক মায়া করে নবী রাসুল সা. গণকে উত্তম আদর্শ দিয়ে পাঠিয়েছেন। মানব তরী যেন পথ হারিয়ে না ফেলে তার জন্য প্রথম মানুষটিকেই নবী করে পাঠালেন আর মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বারা তার পূর্ণতা দান করলেন। মহান রব এখানে শর্ত জুড়ে দিলেন, মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের জন্যই উত্তম আদর্শ হতে পারে যারা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি পেতে চায়। আখেরাতের মহা কল্যাণ কামনা করে। (সুরা আহযাব আয়াত ২১)।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরবের জাহিলিয়াতের চরম নৈরাজ্যকর সময়ে মক্কার সম্ভান্ত ঘরে জন্ম গ্রহণ করেন। জন্মের আগেই বাবাকে মহান রব উঠিয়ে নেন। ছয় বছর বয়সে মা কেও হারিয়ে ফেলেন। মহান রব আস্তে আস্তে তাকে গড়ে তোলেন। আরবের কোন কালিমা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। কোন অন্যায় কাজ তার দ্বারা সংঘটিত হয় নি। কোন মিথ্যা, প্রতারণা, ধোঁকা তার দ্বারা কল্পনাও করা যায় না। তার উদারতা, তার সততা, আমনতদারীতা, মানুষের কল্যাণকামীতা মক্কার মানুষের হৃদয়ে আসন গেড়ে নিয়েছে। সবাই তাকে এক বাক্যে আল আমিন বলে উপাধি দিয়েছে। এই উপাধি কোন অর্থ, বিত্ত, যশ, খ্যাতি, শক্তি, সামর্থ্যরে জন্য নয়। একমাত্র তাঁর চারিত্রিক আদর্শের কারণেই দেওয়া হয়েছে। এই মহান মানুষটিকে মহান রব এই পাপ পঙ্কিল সমাজে নিজ হাতে, নিজে তদারকী আর পাহারা দিয়ে আস্তে আস্তে বড় করে তুললেন। বিশ্বাসী আর বিশ্বস্ত বলতে একজনকেই বুঝায় তিনি হলেন নবী মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

মানুষ অভাবের কালে বিপথগামী হয়। আবার অর্থ পেয়েও আল্লাহকে ভুলে যায়। মহান রব মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে দুই ভাবেই গড়ে তোলেন। আল্লাহ তায়ালা বিত্তহীন অবস্থায় তাকে উত্তম আদর্শবান করেছেন। বিত্তবান অবস্থায়ও তাকে আদর্শের পরম শিখরে পৌছে দিয়েছেন। তিনি যখন নবুয়ত প্রাপ্ত হলেন, কোরআনের নাজিলের সাথে সাথে দীপ্ত আলোয় তৃপ্ত হৃদয়ে বিপথগামী জনতা সত্যের সন্ধান পেল। তার মহান আদর্শের কোমল পরশে মহা সমুদ্রের তরঙ্গ মালায় ডুবন্ত প্রায় মানব জাহাজ হঠাৎ জেগে উঠল। অগ্নিস্ফুলিঙ্গের দিকে ধাবিত মানবতা সম্বিত ফিরে পেল।

এই ক্ষেত্রে মক্কার ধনী বণিকের চেয়ে অসহায় মানুষজন, বিত্তহীন মানুষগুলো চিত্ত উজাড় করে সামনে এগিয়ে এল। কারণ মহান রাসুলের ভালবাসা সহায়তায় তাদের তপ্ত হৃদয়গুলো আগেই ভালবাসা,দরদ মমতা সহায়তায় সিক্ত হয়ে ছিল। কৃষক বীজ ফেলার আগে যেমন চাষ দিয়ে জমির মাটিকে রোদে ঝলসাতে দেয়। রোদে পোড়ে মাটি যেমন পানি পাওয়ার জন্য উদগ্রীব থাকে। পানি পেলে সে ফসল রোপণের জন্য উর্বর হয়ে যায়। মক্কার কিছু মানুষকে সত্য দ্বীন গ্রহণ করার জন্য মহান রব এভাবে প্রস্তত করে নিয়ে ছিলেন। সত্য আসার সাথে সাথে তারা কোন শক্তি, ভয়, চোখ রাঙানোকে জয় করে। জুলুম নির্যাতনকে পরোয়া না করে দ্বীন আল ইসলামকে গ্রহণ করে। তার বিজয়ের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ যে কত আশ্চর্যের বিষয়। পৃথিবী কোন কালে কি এমনটি হতে দেখেছে। আর এমন হবেই না কেন। যে মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে তারা এক দুই বছর নয় পুরো চল্লিশ বছর তাদের মাঝে পেয়েছে। তার চলা বলা আচার আচরণ, তার ভালবাসা, কোমলতা, তার সাহায্য সহযোগিতা, তার জ্ঞান তার সাধনা সবই তাদের সমনে। এমন মানুষকে অনুসরণ না করে কি পারা যায়। যাদের চোখ আছে তারা কল্যাণের পথ দেখতে পায়। আর যে বধীর, অন্ধ ও বোবা সে কি করে পথ পেতে পারে। মক্কার তখনকার ধনিক শ্রেনী। যারা নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করে। নিজের সম্পদ, পদবি আর যশ নিয়ে আত্মতৃপ্ত, আত্ম প্রবঞ্চনা, আত্ম অহমিকার শিকার। তাদের সত্য পথ পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। তারা যেন এই ভেবে বসল যেহেতু তারা এই সমাজের কর্তা, মহান রব নবুয়ত দিলে তাদেরকেই দিতে হবে। তাদের হীনমন্যতা, পদ হারানোর ভয় তাদেরকে কাবু করে ফেলে। অনেকে যদি ও পরে ইসলামে দাখিল হয়েছে। সে কি আলী রাঃ এর মত, খাব্বাব রাঃ এম মত হতে পারে!

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পরশে কোরআনের ছায়ায় এই উম্মতের প্রথম মানুষটি যেমন সোনার মানুষে পরিণত হয়েছিলেন তেমনি শেষ মানুষটিও সোনার মানুষ হতে পারে। প্রথম মানুষটি যেমন আল্লাহর সন্তুষ্টি পেয়েছেন শেষ মানুষটিও মহান রবের সন্তুষ্টি পেতে পারে। কোরআনই ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদর্শের দীপ্তি। কোরআনের প্রতিটি নির্দেশ তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। পালন করতে শিখিয়েছেন। কোরআনের বিধান মেনে শান্তির রাজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। পৃথিবীকে আলোকিত করেছেন। শুধু বক্তৃতা আর বিবৃতি নয় আমলের মাধ্যমে মানুষকে সংশোধন করেছেন। পৃথিবীকে নেতৃত্ত দেওয়ার জন্য তৈরি করেছেন। কোরআনের মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পরশে এমন উত্তম উত্তম মানুষজন পৃথিবীতে তৈরি হয়েছে, যা পৃথিবী কোন কালেই দেখেনি। আবার এই সাহাবাগণের পরশে এমন মানুষজন পৃথিবীতে তৈরি হয়েছে তার নমুনা পৃথিবী কি ভুলতে পারবে? আজও যারা একই আদর্শ লালন করে, এই পথে যারা চলতে চায়। তারাই পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ভাল মানুষ। তারা পৃথিবী তথা মানব জাতির কল্যাণ করতে পারে। তাদের কাছেই মানবতা নিরাপদ। শত্রু লোকটিও এখানে ন্যায় আর ইনসাফ পেতে থাকে। তার উপর কোন জুলুম করা হয় না। একটু আগে যে সত্য পথ যাত্রীদের হত্যা করার জন্য যুদ্ধের ময়দানে তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সেই লোকটি যখন মুসলমানদের হাতে বন্দি হয়। তাকে নির্যাতন করা হয় না। তার উপর জুলুম করা হয় না। এমন আদর্শ পৃথিবীর কেউ কি উপহার দিতে পেরেছে!

এই পৃথিবীতে ইয়াতিম, দুস্থ আর ক্ষুধার্তরা সব চেয়ে অসহায়। একমাত্র মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাড়া কোন এমন কোন সভ্যতা কি পৃথিবী দেখেছে যে এই সকলের দায়িত্ব রাষ্ট্র প্রধান নিয়েছেন। নিজে অনাহারে থাকছেন। নিজের সহায় সম্পদ তুলে দিচ্ছেন যাঞ্চাকারীর হাতে। কি এক অভাবিত দৃশ্য। নিজের আরাম আয়েশের চিন্তা নেই। দারিদ্রতার অভিযোগ নেই। কারো কাছে কোন কিছু চাওয়া নেই। অপরের অভাব দূর করায় ব্যস্ত। মানুষের শারীরিক রোগই নয়। আত্মিক রোগ দূর করতে সদা ব্যস্ত। মানুষের প্রভুকে চেনার জন্য সদা তৎপর। এ যে মানুষের প্রতি মহান প্রভুর কত বড় নেয়ামত। মানুষের জন্য মাওলার কত বড় এহসান। মানুষের জন্য মাওলার কতটুকুন ভালবাসা। বিশেষত আমাদের জন্য।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুরো জীবন আমাদের জন্য আদর্শ। কারো কারো মতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দ্বীনি বিষয়গুলো আমাদের জন্য মেনে চলা ওয়াজিব। আর অন্যান্য বিষয়গুলো মেনে চলা কল্যাণকর। আমরা কল্যাণের পথের যাত্রী। আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর পুরো জীবনকেই অনুসরণ করা উচিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহাবাগণ তৎপরবর্তী তাবেয়ীগন তৎপরবর্তীগন, তৎপরবর্তী আল্লাহ ওয়ালাগন শুধু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জীবন চলার মাধ্যম বানিয়ে নেওয়ার কারণে দুনিয়াতে তারা মর্যাদা পেয়েছেন। পরকালে অবশ্যই জান্নাতের মালিক হবেন।

বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তির যুগে খারাপ হওয়া যেমন সহজ। খারাপের উপকরণ পাওয়া যেমন সহজ। তেমনি ভালোকে জানাও তেমনি সহজ। মানার ক্ষেত্রে একটু কষ্ট বৈ কি। উন্নত চরিত্র, উত্তম আদর্শ, পরকালীন মুক্তি খুব সস্তা চিজ নয়। যা যত দামী তা অর্জন করাও কষ্টকর। এটাই নিয়ম। আমি চেষ্টা না করতে প্রাকৃতিকভাবে আমি ভাল হয়ে যেতে পারি না। এই সমাজ সংসার ভাল করতে হলে আমাকে অবশ্যই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদর্শ অনুসরণ করার প্রতিজ্ঞা নিতে হবে। জানতে হবে। মানতে হবে। তবে প্রথম যুগের মানুষটির মত আমরাও সোনার মানুষ হতে পারি। নতুবা কোন ভাবেই আমরা সুন্দর, কল্যাণকর সমাজের, সংসারের কল্পনা করতে পারি না। মহান রব আমাদেরকে কল্যাণের পথে, মুক্তির পথে কবুল করুন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবনকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করার জানার মানার তৌফিক দিন। আমীন।
লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন