বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বেগমপাড়া সেকেন্ড হোম তিন ব্যাংক ও দুই কোম্পানির অর্থ লুণ্ঠন সমাচার

মোবায়েদুর রহমান | প্রকাশের সময় : ৮ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০২ এএম

১৯৮৬ সালের ঘটনা। এক ভদ্র মহিলা এক ঝড়ের রাতে তার স্বামীর সাথে বেবীট্যাক্সি করে কলাবাগান যাচ্ছিলেন। শোঁ শোঁ করে প্রচন্ড বেগে বাতাস বইছিলো। বেবী ট্যাক্সি থেকে নেমে পকেট থেকে স্বামি তিনটি পাঁচ টাকার নোট বের করেন। এখানে বলে রাখি যে, তখন ত্রিচক্রযানগুলো পেট্রোলে চলত। ঐগুলোর নাম ছিল স্কুটার বা বেবীট্যাক্সি। এখন ঐগুলো গ্যাসে চলে। নতুন নাম সিএনজি। যাই হোক, ভদ্রলোক ভাড়া দেওয়ার জন্য টাকা বের করে গুনছেন। তখন বাতাসে পাঁচ টাকার তিনটি নোট উড়ে গেল। দেখলেন, অনতিদূরে দুটি বালক ঐ উড়ে যাওয়া টাকা ধরার চেষ্টা করছে। ভদ্রলোক তার উড়ে যাওয়া টাকা ধরার চেষ্টা না করে মানি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে ভাড়া মিটিয়ে দেন। তবে তার মন কিছুটা খারাপ হয়। কারণ তখন ১৫ টাকা নেহাত খেলনা ছিল না। পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে আমি বেবীট্যাক্সি করে নিউ মার্কেট থেকে মতিঝিল বিসিক অফিসে আসতাম। তখন বেবীতে মিটার ছিল। ভাড়া উঠত ৯০ পয়সা। আমি ১ টাকাই দিতাম, ১০ পয়সা আর ফেরত চাইতাম না।

শুরু করেছিলাম তিনটি পাঁচ টাকার নোট বাতাসে উড়ে যাওয়া এবং দুটি বালকের ঐ নোটগুলি ধরার চেষ্টার কথা দিয়ে। সেটি ৩৪ বছর আগেকার কথা। আর আজ? হাজার নয়, লাখ নয়, কোটি কোটি টাকা বাতাসে উড়ে বেড়ায়। শুধু ধরে নেওয়ার ব্যাপার। যারা পারছে, তারা ধরে নিচ্ছে। বাতাসে এখন আর দুই চার লাখ নয়, দুই চার কোটি নয়, শত শত, হাজার কোটি টাকা উড়ে বেড়াচ্ছে। যারা ‘লায়েক’ তারা ধরে নিচ্ছে। এবং ধরে নিয়ে টাকাগুলো দিয়ে কানাডায় বেগমপাড়া বা মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম বানাচ্ছে। যারা উড়ে বেড়ানো টাকাগুলো ধরেছেন তারা তাদের বেগম এবং বালবাচ্চাদের দেশে রাখছেন না। পাঠিয়ে দিচ্ছেন কোনো এক বেগমপাড়া বা সেকেন্ড হোমে। আর আগে থেকে যারা সুইস ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে রেখেছেন তারা বিবি-বাচ্চাদের পাঠাচ্ছেন সুইজারল্যান্ডে (প্রকৃত উচ্চারণ হল সুইটজারল্যান্ড)। আর সেখানে তাদের বেগম সাহেবা এবং ছানা পোনারা আয়েশ করে পায়েশ খাচ্ছেন।

কীভাবে এই হাজার হাজার কোটি টাকা তথা লক্ষাধিক কোটি টাকা বিদেশে যাচ্ছে? আমার এক আত্মীয়া আমাকে সেদিন বললেন যে, তার ছেলে অস্ট্রেলিয়াতে আছে। এখনো চাকুরী পায়নি। বড় অর্থ কষ্টে আছে তার ছেলে। বাংলাদেশ থেকে টাকা পাঠানো অনেক ঝুট ঝামেলার ব্যাপার। তাই তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন, আমার ছেলে-মেয়েরা যেন তার ছেলেকে সেখানে কিছু অস্ট্রেলিয়ান ডলার দেয়। অস্ট্রেলিয়ান ডলারের সম পরিমাণ টাকা বাংলাদেশে তিনি আমাকে পরিশোধ করবেন।

অতীতে সাবেক পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান থেকে যখন টাকা সাবেক পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হতো তখন বলা হতো ফ্লাইট অব ক্যাপিটাল বা পূঁজি পাচার। এখন এই পরিভাষার প্রমোশন হয়েছে। বলা হয় মানি লন্ডারিং। মানি লন্ডারিংয়ের কোনো যুৎসই বাংলা পেলাম না। তাই অর্থ পাচার বলবো।

দুই
মানি লন্ডারিংয়ের কথা বেশ কয়েক বছর থেকেই শুনে আসছি। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। হাজার হাজার কোটি নয়, লক্ষ কোটি টাকা পাচারের স্টোরিতে খবরের কাগজের পাতা ভরে গেছে। যারা পেপার ক্লিপিং মেইনটেইন করেন তাদের ফাইল মোটা হয়েছে। কিন্তু এ্যাকশন কোথায়? এবার আলোচনাটি সামনে উঠে এসেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের একটি চাঞ্চল্যকর উক্তিতে। তিনি বলেছেন, প্রাথমিক যে তথ্য তারা পেয়েছেন তাতে তারা দেখেছেন যে টাকা পাচারের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের সংখ্যাই বেশি। তার ভাষায়, “প্রাথমিক কিছু সত্যতা পেয়েছি। মনে করেছিলাম, রাজনীতিবিদদের সংখ্যাই বেশি হবে। কিন্তু রাজনীতিবিদদের সংখ্যা ৪ জন। সরকারি কর্মচারীর সংখ্যাই বেশি। এছাড়া কিছু ব্যবসায়ী আছে।” ২৮ টি ঘটনার তথ্য তারা পেয়েছেন যেগুলোর মধ্যে সরকারি কর্মচারীই বেশি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া তথ্যেই জানা গেল যে কেবল ঋণ খেলাপী ও লুটেরা ব্যবসায়ীই নয়, অনেক সরকারি অফিসার কানাডার বেগমপাড়ায় স্থায়ী বসত গেড়েছেন। এ সম্পর্কে আমার কাছে অনেক তথ্য আছে। কিন্তু আজকের লেখা আমি তথ্যবহুল করবো না। যে দুই চারটি তথ্য বা পরিসংখ্যান না দিলেই নয় কেবলমাত্র সেগুলোই উল্লেখ করবো।

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লােবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটেগরিটির হিসাবে ২০১৫ সালে বাণিজ্যে কারসাজির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমান বাংলাদেশী মুদ্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে অর্ধ লক্ষাধিক কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। গত ২২ নভেম্বর পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় যে, অনেক বড় বড় শিল্পগোষ্ঠি তাদের ব্যবসা ও অফিস নিয়ে যাচ্ছে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে।

এখন দুর্নীতি, পাতাল অর্থনীতি, ক্যাসিনো কান্ড, পাপিয়া কান্ড, স্বাস্থ্য খাতের লুটপাট সব সমার্থক হতে চলেছে। একটার পর একটা কেলেঙ্কারী ঘটে চলেছে। মো. সাহেদ করিম। টকশোর আলোচিত চরিত্র। করোনা কালের প্রথম দিকে রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক হিসাবে কোটি কোটি টাকা লুণ্ঠন। তার আগে দৃশ্যপটে আসেন সংসদ সদস্য শহীদ ইসলাম ওরফে পাপুল এবং তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম। পাপুলের আগে শিকদার গ্রুপের মালিকের দুই পুত্র রণ ও দিপু শিকদার। এক ব্যাংকের পরিচালককে গুলি করে হত্যা চেষ্টা। তারও আগে দৃশ্যপট গরম করেছিলেন পাপিয়া। তারও আগে ক্যাসিনো কান্ড নিয়ে কোটি টাকার কেলেঙ্কারী।

গত ১৬ আগস্ট একটি ইংরেজি দৈনিক একটি চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশ করে। ঐ খবরে বলা হয় যে, দেশের ৫টি বড় আর্থিক কেলেঙ্কারীর ১৮ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা পুনরুদ্ধারের কোনো হিল্লে এখনও হয়নি। এখানে জড়িত তিনটি ব্যাংক এবং দুইটি এমএলএম বা মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানি। এগুলো হলো, সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, ফারমারস্ ব্যাংক, যুবক ও ডেসটিনি নামের এমএলএম।

তিন
আলোচনা আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আগে কয়েকটি প্রশ্ন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেছেন যে, তারা যে তথ্য পেয়েছেন সেই তথ্য মোতাবেক মানি লন্ডারিংয়ের কেস ২৮ টি। তার মধ্যে রাজনীতিবিদদের সংখ্যা নাকি মাত্র ৪ জন। অবশিষ্ট ২৪ জনই নাকি আমলা এবং ব্যবসায়ী। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে ফিগারই দেন না কেন, বাস্তবে অর্থ পাচারাকারীদের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। তারপরেও তর্কের খাতিরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সংখ্যাটিই মেনে নিলাম। এখন তিনিই বলুন এই ২৮ জন কারা? কিবা তাদের নাম ধাম? কত টাকা তারা পাচার করেছেন? বিনিয়োগকারীর ক্যাটাগরিতে নাগরিকত্ব পেতে গেলে ১ কোটির ওপর টাকা জমা দিতে হয়। ঐসব অফিসার বেতনের টাকা দিয়ে সংসার চালানোর পর বেগমপাড়ায় বসত অথবা সেকেন্ড হোম ক্যাটাগরিতে বিনিয়োগের জন্য কোটি কোটি টাকা কোথায় পেলেন? শুধুমাত্র ২৮টি কেস তারা পেয়েছেন- এইটুকু বললেই কি তাদের দায়িত্ব খালাস হয়ে গেল? কত টাকা পাচার করেছেন এবং কোন পথে পাচার করেছেন তার বিস্তারিত তথ্য জনগণকে জানানো হোক। জনগণের সামনে তাদেরকে উন্মোচিত করা হোক।

প্রশাসনে একটি প্রবণতা দিনের পর দিন চলে আসছে। বড় কোনো অনিয়ম, দুর্নীতি বা লুটপাটের সংবাদ প্রকাশিত হলেই দুদকের তরফ থেকে বলা হয় যে, তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন। গত জামানার কলের গানের ভাঙ্গা রেকর্ডের মত দুদকের রেকর্ডও বাজতেই থাকে যে, তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। এই খতিয়ে দেখা কি বছরের পর বছর চলতেই থাকবে? এই খতিয়ে দেখার কি শেষ হবে না কোনোদিন?

তিনটি ব্যাংক এবং দুইট এমএলএম ১৮ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা মেরে দিয়েছে। এটি এখন একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। এতগুলো টাকা, এক কোটি দুই কোটি বা দুই একশো কোটি টাকা নয়, ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ লুট হয়ে গেল। তারপরেও ওপর তলায় টনক নড়ছেনা কেন? পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট মোতাবেক, যে অভিযোগ গঠিত হয়েছে সেখানে নাকি এসব প্রতিষ্ঠানের হোমরা চোমরাদের নাম প্রধান আসামীদের তালিকায় নাই।

এগুলোর মধ্যে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল- এই ৪ বছরে ‘বেসিক ব্যাংকে’ লুটপাট হয়েছে ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু প্রধান আসামীকে অভিযুক্ত করা হয় নাই বলে পত্রিকান্তরের রিপোর্ট প্রকাশ। অপরটি হলো ‘ফারমারস্ ব্যাংক’। বর্তমানে ‘পদ্মা ব্যাংক’। এই ব্যাংকে লুণ্ঠিত অর্থের পরিমাণ ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এই ব্যাংকের মূল মালিককে সকলেই চেনেন। জয়দেবপুরে তিনি একটি হাসপাতালও বানিয়েছেন। সেই হাসপাতালেও করোনা চিকিৎসা নিয়ে নয় ছয়ের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।

২০১০ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ‘হল মার্ক’ গ্রুপ সোনালী ব্যাংক থেকে ৩ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। ৮ বছর হয়েগেছে। মামলার সুরাহা হয়নাই। ‘যুবক’ নামক এমএলএম কোম্পানিটি আত্মসাৎ করেছে ২ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা। সেই টাকা উদ্ধারের কোনো চান্স বিশেষজ্ঞরা দেখতে পাচ্ছেন না। এটিকে একটি ডেড্ ইস্যু বলে মনে করা হচ্ছে। ‘ডেসটিনি’ গ্রুপ টাকা মেরেছে ৪ হাজার ১১৮ কোটি টাকা।
প্রশ্ন একটাই। আর সেটা হলো, এভাবে জনগণের টাকা হরিলুট করে কি অবাধে পার পেয়ে যাওয়ার কালচার চলতেই থাকবে?
journalist15@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
লেখার ভাষা সুন্দর কিন্তু তথ্যে অনেক ভুল। আশা করি ভবিষ্যতে আরও তথ্যবহুল লেখা পড়ব।
Total Reply(0)
মোবায়েদুর রহমান ৮ ডিসেম্বর, ২০২০, ৮:৪৬ পিএম says : 0
কোনটা ভুল তথ্য স্পষ্টভাবে উল্লেখ করুন।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন