শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রাজধানী ঢাকা কবে বাসযোগ্য হবে?

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ১৩ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

রাজধানী বসবাসের উপযোগিতা অনেক আগেই হারিয়েছে। এ নিয়ে বহু লেখালেখি হয়েছে। এখনও হচ্ছে। তাতে রাজধানীর উন্নয়ন ও বাসযোগ্য করার সাথে জড়িত যেসব কর্তৃপক্ষ রয়েছে, তাদের কোনো টনক নড়ছে না। রাজধানী বাসযোগ্য তো হচ্ছেই না, উল্টো খারাপ থেকে খারাপ হচ্ছে। বায়ু দূষণে রাজধানী ধুলোয় ধূসরিত হয়ে আছে, এতে কি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো বিচলন আছে? নেই। থাকলে রাজধানী ধুলার চাদরে ঢাকা পড়ে থাকত না এবং বিশ্বের শীর্ষ বায়ু দূষণের তালিকায়ও থাকত না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানে, ঢাকা যতই সমস্যায় জর্জরিত হোক, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা যতই কম হোক, ঢাকাবাসী ঢাকাতেই থাকতে চায়। তারা ঢাকা ছেড়ে যেতে চায় না। ঢাকা ছাড়ার অর্থ যেন তাদের কাছে পুরো পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। এটা আসলে অভ্যস্ততার ব্যাপার। অনেক সময় মানুষ চরম দুরবস্থার মধ্যেও নিজেকে মানিয়ে নেয়। ঢাকায় যারা বসবাস করেন এবং যারা ঢাকাগামী হন, তারা ঢাকার কঠিন জীবন এবং দুরবস্থার কথা মেনে নিয়েই থাকেন এবং আসেন। এর কারণ, ঢাকা তাদের স্বপ্ন। যারা আসেন তারা মনে করেন, ঢাকা আসতে পারলেই তাদের জীবনধারা বদলে যাবে। এর ফলে প্রতিদিন ঢাকায় মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। করোনায় কয়েক লাখ মানুষ জীবিকা হারিয়ে গ্রামে চলে গেলেও পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় আবার ফিরতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন ঢাকায় মানুষের আগমণ ঘটছে ১৭০০ জন। অবশ্য এ সংখ্যাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। কোনো কোনো হিসাবে সংখ্যাটি আড়াই হাজারের বেশি। এ হিসাবে ঢাকায় মাসে যুক্ত হচ্ছে, ৫০ থেকে ৭৫ হাজার মানুষ। পৃথিবীর আর কোনো শহরে এত অধিক সংখ্যক মানুষের যুক্ত হওয়ার নজির খুব কমই রয়েছে। বিবিএস-এর হিসাবে ঢাকার বর্তমান লোকসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ। জাতিসংঘের ইউএনএফপি’র হিসাবে পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহরগুলোর তালিকায় ঢাকা ১১তম। তবে আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার দিক থেকে এটি পৃথিবীর এক নম্বর জনঘনত্বের শহর। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ বসবাস করে। যে হারে ঢাকায় মানুষের আগমন ঘটছে, তাতে আগামী কয়েক বছরে এর অবস্থা কী হবে, তা অনুমান করা কঠিন নয়। যদিও করোনায় জীবিকা হারিয়ে কিংবা সংসারের ভার বইতে না পেরে ইতোমধ্যে কয়েক লাখ মানুষ রাজধানী ছেড়েছে। তবে আবারও তারা ফিরতে শুরু করেছে। ফলে রাজধানীর জনসংখ্যার কোনো হেরফের হয়নি। ঢাকামুখী মানুষের আগমন কমেনি। ঢাকামুখী মানুষের ঢল ঠেকানোর কোনো নীতি ও পরিকল্পনাও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নেই। যেমন আছে তেমন চলতে থাকুক-এমন একটা প্রবণতা সবসময়ই রয়েছে। প্রশ্ন আসতে পারে, ঢাকায় মানুষের এই আগমণের জন্য কি কেবল ঢাকামুখী মানুষরাই দায়ী? তারা কি সাধ করে ঢাকার কষ্টের জীবনে জড়াতে চায়? এসব প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, কেউ সাধ করে কষ্টের জীবনে জড়াতে চায় না। এর জন্য দায়ী রাষ্ট্র ব্যবস্থা। রাষ্ট্র ঢাকার মধ্যেই মৌচাকের মতো সকল সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টিতে মনোযোগী। ঢাকাকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন-আদালত, প্রশাসন, কলকারখানা থেকে শুরু করে সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। ফলে সুযোগ-সুবিধার লোভে পিঁপড়ার মতো পিলপিল করে মানুষ ঢাকামুখী হচ্ছে।

দুই.
ঢাকাকে বলা হয় মেগাসিটি। সাধারণত যে শহরের লোকসংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে যায়, সেই শহর এই খেতাব লাভ করে। ঢাকার লোকসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, তাতে আগামী কয়েক বছরে এর জনসংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়ে যাবে, ডাবল মেগাসিটিতে পরিণত হবে। এই বিপুল সংখ্যক রাজধানীবাসীর ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে, এ নিয়ে কোনো পরিকল্পনার কথা আমরা শুনিনা। পরিকল্পনা আছে কিনা, তাও জানি না। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ঢাকায় যারা থাকেন এবং আসেন, তারা নিজেরাই নিজেদের বসবাসের জায়গা করে নেন। এতে পরিকল্পনার প্রয়োজন পড়ছে না। অথচ যে কোনো রাজধানী গড়ে তোলা হয় পরিকল্পিতভাবে। এজন্য কর্তৃপক্ষ আছে। যে কেউ চাইলেই ইচ্ছামতো ঘর-বাড়ি বা ছাপড়া তুলে বসবাস করতে পারে না। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পরিকল্পিতভাবে সম্প্রসারণের কাজটি করে। ঢাকাকে দেখলে মনে হবে, এর সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। যে যেভাবে যেদিকে পারছে ঢাকাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। থামাথামি নেই। থামানোর চেষ্টাও নেই। এই সম্প্রসারণ কাজ করতে গিয়ে নগরীর প্রাকৃতিক যে বৈশিষ্ট্য থাকা অপরিহার্য, তা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ঢাকা পরিণত হচ্ছে ইট, কাঠ, পাথরের নগরীতে। বলা হয়, ঢাকার মতো প্রাকৃতিক সুষমামন্ডিত রাজধানী বিশ্বে খুব কম আছে। এটি এমন এক শহর, যার ভেতর দিয়ে এক সময় প্রায় অর্ধশতাধিক খাল ছিল। জালের মতো খাল আর চতুর্দিকে নদী। ঘর-বাড়ি, অফিস-আদালতের পাশ দিয়ে স্বচ্ছ বারিধারা বয়ে যেত। এসব এখন কেবল কল্পনায় পরিণত হয়েছে। এ প্রজন্মের কাছে তা এখন স্বপ্নের মতো। তারা কেবল শুনছে, এই সুউচ্চ ভবনটি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে বা এই সড়কটি যেখান দিয়ে গিয়েছে, এসবই খালের উপর গড়ে উঠেছে। তাদের কি বিশ্বাস করানো যাবে, আজকের যে গুলশান, সেখানে বাড্ডা এলাকা দিয়ে এক সময় নৌকা ভিড়ত? আজকের যে সুরম্য বসুন্ধরা সিটি মার্কেট, এ জায়গাটি ছিল বিশাল একটি ঝিল? সেখানে শাপলা ফুটত, নৌকা চলত। এখন ঢাকা শহরে যেসব লেক দেখা যায়, এগুলো মূলত সেসব খাল বা নদীর রেপ্লিকা মাত্র। এগুলো কৃত্রিমভাবে গড়ে তোলা হয়নি। প্রাকৃতিকই ছিল। শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষা ও বালু নদীতে গিয়ে মিশেছিল। কেবল দখলদারিত্বের কবলে পড়ে আবদ্ধ জলাভূমিতে পরিণত হয়েছে। যদি এসব খাল রক্ষা করা যেত, তাহলে ঢাকা শহরের চেহারাটা কেমন হতো? কাচঘেরা সুউচ্চ ভবন এবং এলইডি লাইটের আলোয় কী ঝলমলই না করতো! ঢাকার আজকের যে অসীম সমস্যা তা থেকে অনেকটাই মুক্ত থাকা যেত। বুক ভরে মানুষ সতেজ নিঃশ্বাস নিতে পারতো। শহরটি এখন বিশ্বের শীর্ষ বায়ুদূষণের তালিকায় রয়েছে। হবেই বা না কেন? এতে উন্নয়নের নামে যেভাবে অপরিকল্পিত সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি করে মাসের পর মাস ফেলে রেখে ধুলার কারখানায় পরিণত করা হয়, তাতে এর বায়ু ধুলায় ধূসরিত হয়ে রয়েছে। এর সাথে যানবাহন, কলকারখানা, আশপাশের ইটভাটার কালো ও বিষাক্ত ধোঁয়া পুরো রাজধানীকে যেন গ্যাস চেম্বারে পরিণত করেছে। গত সপ্তাহেও বায়ু দূষণে বিশ্বের এক নম্বর শহরের স্থান পেয়েছে। এখানে স্বাভাবিক ও স্বস্তির সাথে শ্বাস নেয়া কঠিন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বায়ুমান যচাইবিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’-এর বায়ুমান সূচক বা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) অনুযায়ী, ঢাকায় কম-বেশি সবসময়ই বায়ুদূষণের গড় হার ১৫০ ইউএস থেকে ২০০ইউএস-এর উপরে। ১৫০ ইউএস একিউআই হলে তা পুরোপুরি অস্বাস্থ্যকর। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের তথ্য অনুসারে, রাজধানীর বায়ু দূষণের ৫০ শতাংশ হয় ইটভাটা, ৩০ শতাংশ রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও সিটি করপোরেশনের বর্জ্য, ১০ শতাংশ গাড়ির জ্বালানি এবং ১০ শতাংশ হয় শিল্পকারখানার বর্জ্য থেকে। তবে পরিবেশবিদদের মতে, বায়ুদূষণের জন্য শতকরা ৫০ ভাগ দায়ী অবকাঠামোগত নির্মাণ প্রকল্প। এছাড়া পয়োনিষ্কাশন ও বর্জ্যব্যবস্থাপনার দুর্দশা রাজধানীর পরিবেশকে ভয়াবহ করে তুলেছে। দুঃখের বিষয়, সমস্যা চিহ্নিত হয়ে আছে, তবে তা প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। এসব সমস্যা সমাধানে যেসব সেবামূলক সংস্থা ও কর্তৃপক্ষ রয়েছে, তাদের এ নিয়ে মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। তাদের মধ্যে এমন প্রবণতা দেখা যায়, শীত ও শুষ্ক মৌসুমের কয়েক মাস একটু ধুলাবালি হবেই, বৃষ্টি হলে তা ঠিক হয়ে যাবে। তাদের এ ধরনের প্রবণতা ও মানসিকতার কারণেই রাজধানী বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে রয়েছে। সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো যদি তাদের কাজটুকু যথাযথভাবে করত, তাহলেও অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হতো। বিশেষ করে দুই সিটি করপোরেশন, যাদের উপর ঢাকার অধিকাংশ সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব, তারা যদি একটু তৎপর ও পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করত, তবে ঢাকার দুরবস্থার কিছুটা হলেও উন্নতি হতো।

তিন.
ঢাকার অসংখ্য সমস্যার মধ্যে অন্যতম প্রধান সমস্যা যানজট। মেট্রোরেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের মতো বড় প্রকল্পের কারণে প্রধান প্রধান সড়কগুলো দখল করে নির্মাণ কাজ চালানোয় তা সরু সড়কে পরিণত হয়েছে। ফুটপাতের পাশ দিয়ে সরু রাস্তা দিয়ে বাসসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচল করতে গিয়ে কী দুর্ভোগের শিকার হয়, তা সকলেরই জানা। এতে মানুষের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়, তার হিসাব বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন সময়ে দিয়েছে। বুয়েটের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, যানজটের কারণে বছরে ২২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়, কোনো কোনো সংস্থার মতো আরো বেশি। জাতিসংঘের ইউএনডিপির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, এ ক্ষতি ৩৫ হাজার কোটি টাকার উপরে। এ হিসাবের মধ্যে রয়েছে, যানজটে দৈনিক ৪০ লাখ কর্মঘন্টা নষ্ট হওয়ায় আর্থিক ক্ষতি হয় ৩০০ কোটি টাকা। এর সাথে যুক্ত হয়েছে যানবাহনের পুড়ে যাওয়া বাড়তি জ্বালানির মূল্য (যানজটে বাসে ৩ গুণ তেল পোড়ে) এবং নগরবাসীর স্বাস্থ্যহানির আর্থিক মূল্য। যানজটে বছরে যে ক্ষতি হয় তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছর একটি করে পদ্মাসেতু নির্মাণ করেও অতিরিক্ত অর্থ উদ্বৃত্ত থেকে যাবে। এভাবে বছরের পর বছর ধরে যে ক্ষতি হচ্ছে, এ ক্ষতি যদি অর্ধেকেও নামিয়ে আনা যায়, তবে প্রতি দুই বছরে একটি করে পদ্মাসেতু নির্মাণ করা সম্ভব হতো। আমরা পদ্মাসেতু নির্মাণে যেভাবে নিজস্ব অর্থায়ন এবং দ্রুত গতিতে কাজ সমাপ্ত করার দিকে মনোযোগী হয়েছি, এ মনোযোগ যদি যানজট নিরসনের দিকে দিতাম, তাহলে আমাদের অর্থনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো! যে বিনিয়োগ নিয়ে এতো হা-হুতাশ ও অর্থনৈতিক টানাপড়েন এবং জনগণের পকেট থেকে নানা উপায়ে সরকারের পয়সা বের করে নেয়ার ফন্দি-ফিকির, তার কি প্রয়োজন পড়ত? এমনকি যে ঘাটতি নিয়ে লাখ লাখ টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়, সে ঘাটতি কি থাকত? সরল হিসেবে যদি ধরা হয়, তবে যানজটের ক্ষতি অর্ধেকে নামিয়ে আনা গেলে, চার বছরের মধ্যে ঘাটতিবিহীন একটি বাজেট দেয়া সম্ভব হতো। যাই হোক, যানজটের ক্ষতির মাত্রা বলে শেষ করা যাবে না। এর ক্ষতি বহুমাত্রিক। যানজটে পড়ার ভয়ে কর্মজীবী মানুষ থেকে শুরু করে প্রত্যেকের স্বাভাবিক জীবন ও কর্মকান্ড প্রতিদিনই ব্যাহত হচ্ছে। ঢাকায় যারা বসবাস করেন, তারা জীবনযাত্রা পরিবর্তন করে এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। যারা ঢাকায় আসেন, তাদের জীবনযাত্রা অনিবার্যভাবেই পরিবর্তন করতে হয়। যেখানে কর্মস্থলে যাওয়ার স্বাভাবিক সময় আধাঘন্টা, সেখানে তাকে দুই ঘন্টা আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। তানাহলে কোনোভাবেই চাকরি-বাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিকমতো চালানো সম্ভব নয়। যানজটের কারণ মোটামুটি সবারই জানা। এর অন্যতম কারণ রাস্তার তুলনায় অধিক সংখ্যক গাড়ি। সাধারণত একটি আদর্শ শহরে ২৫ ভাগ সড়ক থাকে, সেখানে ঢাকা শহরে রয়েছে মাত্র ৮ ভাগ। আবার এই ৮ ভাগের মধ্যে কার্যকর রাস্তা হচ্ছে আড়াই ভাগ। এই কার্যকর রাস্তা দিয়ে সোয়া দুই লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারলেও এখানে চলছে ৯ লাখের উপরে। তার উপর প্রতিদিন কয়েকশ’ গাড়ি রাস্তায় নামছে। এ পরিস্থিতিতে যানজট সৃষ্টি না হয়ে উপায় আছে? আরও কারণ রয়েছে। নগরীতে লোকসংখ্যার অনুপাতে যে পরিমাণ গণপরিবহণ থাকার কথা তা একেবারেই নেই। অথচ যানজট সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য এবং লোকজনের যাতায়াতে পর্যাপ্ত গণপরিবহণের বিকল্প নেই। সারা বিশ্বেই গণপরিবহণের উপর বেশি জোর দেয়া হয়। বাংলাদেশই কেবল ব্যতিক্রম। এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, নগরীতে ৬০ ভাগ মানুষ হেঁটে চলেন। রিক্সায় চলেন ১৯ ভাগ। বাস ও অটোরিক্সায় চলেন ১৬ ভাগ। আর প্রাইভেট কারে চড়েন মাত্র ৫ ভাগ। অর্থাৎ ৫ ভাগ মানুষের প্রাইভেট কারের জন্য ঢাকার যানজটকে আরও তীব্র করে তুলেছে। একটি প্রাইভেট কারে ড্রাইভারসহ দুইজন থেকে পাঁচজন চড়তে পারে। বেশিরভাগ সময় শুধু দুইজনই চড়েন। বাকি তিনজনের জায়গা খালিই পড়ে থাকে এবং রাস্তার বিরাট একটা অংশ দখলে চলে যায়। আবার এসব গাড়ি রাস্তার উপর পার্কিং করার কারণেও যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। নগরবিদরা মনে করেন, যাদের একাধিক প্রাইভেট কার রয়েছে, তাদেরকে একটির মধ্যে সীমাবদ্ধ করা প্রয়োজন এবং তার জায়গায় আধুনিক, আরামদায়ক ও শৃঙ্খলাবদ্ধ গণপরিবহণ সংখ্যা বৃদ্ধি করা জরুরি।

চার.
ঢাকাকে বাসযোগ্য করার তাকিদ নগরবিদরা বহুদিন ধরেই দিচ্ছেন। তারা প্রতিনিয়ত এন্তার পরামর্শ ও পরিকল্পনার কথা বাতলাচ্ছেন। তাদের এ পরামর্শ নগরবাসীর কাছে শুনতে ভাল লাগলেও যাদের শোনার কথা এবং বাস্তবায়ন করার কথা, তারা শোনে না। যানজট নিরসন এবং সৌন্দর্য বর্ধনে এক ফুটপাত দখলমুক্ত করা নিয়ে কত কী ঘটে! ফুটপাত দখলমুক্ত করা নিয়ে এক ধরনের ইঁদুর-বেড়াল খেলা আমরা প্রায় সময়ই দেখি। ফুটপাত আর দখলমুক্ত হয় না। দখলকারীরা এতটাই শক্তিশালী যে সিটি করপোরেশনও তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে। ঢাকাকে মানুষের চাপমুক্ত রাখতে এবং ঢাকাগামী মানুষের স্রােত ঠেকাতে বিচার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যাংকিং সেবাসহ প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের কথা বহুদিন ধরেই বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন। এসব সরকারের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। সরকার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক কিছুই করেছে। আমরা মনে করি, ঢাকাকে হালকা এবং আধুনিকভাবে গড়ে তুলতে হলে সরকারকে বিকেন্দ্রীকরণের কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্যান্য বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরগুলোতে ঢাকার মতো সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে। বায়ু দূষণ রোধ করতে হবে এবং অপরিকল্পিত সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করতে হবে। সেবামূলক সংস্থাগুলোর মধ্যে কাজের সমন্বয় সাধন করতে হবে এবং দ্রুত কাজ শেষ করতে হবে। মাসের পর মাস খঁড়ে ফেলে রাখলে হবে না। ঢাকায় আর কোনো কলকারখানা স্থাপনের অনুমোদন দেয়া যাবে না। বিভিন্ন আঞ্চলিক শহরে শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে হবে, যাতে ঢাকার বাইরে কর্মসংস্থান সৃর্ষ্টি হয় এবং জীবিকার সন্ধানে মানুষকে ঢাকামুখী না হতে হয়।
darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Jack Ali ১৩ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০৯ পিএম says : 0
When our country will be ruled by the Law of Allah then we will be able tio live in our country pollution free, crime free.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন