শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

আমরা কি অসভ্য ও জংলী জাতিতে পরিণত হয়েছি?

মোবায়েদুর রহমান | প্রকাশের সময় : ২২ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

আমরা কি অসভ্য, বুনো, বর্বর এবং জংলী জাতিতে পরিণত হয়েছি? তাই যদি না হবে তাহলে মৃত্যুদন্ডের আইন পাশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে ধর্ষণ থামছে না কেন? ভাবলে অবাক হতে হয় যে, নভেম্বরের ১৭ তারিখ থেকে ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ পর্যন্ত এই এক মাসে দেশে ১৩৪টি ধর্ষণের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এই এক মাসে ঢাকার জাতীয় দৈনিকসমূহে প্রকাশিত ঘটনাই ঐ ১৩৪টির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এর বাইরে আরো অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে, যেগুলো সংবাদপত্রের পাতায় আসেনি। অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে যেগুলো থানায় রিপোর্ট করা হয়নি। এখনও সমাজে ধর্ষিতাকে সমবেদনা জানালেও সে সামাজিক মর্যাদা ফিরে পায় না। কুমারী মেয়ে ধর্ষিতা হলে এবং সেই ধর্ষণের ঘটনা জানাজানি হলে মেয়েটির সহজে বিয়ে হয় না। আর বিবাহিতা মেয়ে ধর্ষিতা হলে স্বামী বা স্বামীর পরিবার তাকে আর গ্রহণ করতে চায় না।

গত অক্টোবরে ধর্ষণের অপরাধে মৃত্যুদন্ডের বিধান রেখে একটি প্রেসিডেন্সিয়াল অধ্যাদেশ জারি হয়। এর আগে মন্ত্রিসভায় এই প্রস্তাব পাশ হয়। মন্ত্রিসভা মৃত্যুদন্ডের এই প্রস্তাব অনুমোদনের এক কি দুইদিন পর প্রেসিডেন্ট সেই প্রস্তাবে সই দেন। প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষর লাভের সঙ্গে সঙ্গেই প্রস্তাবটি আইনে পরিণত হয়। আর তার এক সপ্তাহের মধ্যেই টাঙ্গাইলের একটি ধর্ষণ মামলায় ৫ ব্যক্তিকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছে। সেই মৃত্যুদন্ড এখনও কার্যকর হয়নি। নি¤œ আদালত থেকে হাইকোর্টে আপিল, তারপর আপিল বিভাগে আপিল, তারপর রিভিউ। কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটি আমরা কেউ জানি না। কিন্তু কথা হলো, টাঙ্গাইলের ঐ একটি মৃত্যুদন্ডর রায়ের পর আর কোনো মৃত্যুদন্ড হয়নি কেন?

ধর্ষণের কেস্ যথাযথভাবে হ্যান্ডেল না করার কারণে পুলিশের বিরুদ্ধে এন্তার অভিযোগ উঠছে। কিন্তু এখনও পুলিশের টনক নড়েনি। অবশেষে মাননীয় হাইকোর্টকেই এগিয়ে আসতে হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে ৬ মাসের মধ্যে মামলার রায় দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। ৬ মাস পার হয়েছে। কিন্তু মামলার রায় হয়নি, এরকম কতগুলো মামলা রয়েছে? এ ব্যাপারে নারী ও শিশু নির্যাতন আদালত সংখ্যাটি জানাবেন কি? ইতোপূর্বে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে যে, এই ধরনের অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আর এই সুযোগে আসামীরা জামিন পেয়ে গেছে এবং নতুন করে ধর্ষণের পাপে লিপ্ত হয়েছে অথবা তাদের বিরুদ্ধে যারা মামলা করেছিল তাদের হুমকি ধামকি দিচ্ছে।

দুই
কিছুক্ষণ আগে আমরা বলেছি যে, মামলার শম্বুক গতি দেখে স্বয়ং মাননীয় হাইকোর্টেরও বিবেক জাগ্রত হয়েছে। কিন্তু পুলিশের বিবেক জাগ্রত হয়নি। গত ২ সেপ্টেম্বর বেগমগঞ্জের একলাশপুর ইউনিয়নের এক গৃহবধুকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণের ৩২ দিন পর ঐ ভিডিওটি ভাইরাল হয়। এ ব্যাপারে মাননীয় বিচারপতিগণ বলেছেন যে, নিজের বাড়ির নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা এক নারীর ওপর দুর্বৃত্তদের নির্যাতনের ঘটনা তাদের বিচারিক বিবেককে নাড়া দিয়েছে। ঘটনার ৩২ দিন পর কেন তা জানাজানি হলো এবং পুলিশ আগেই কেন এ বিষেয়ে তৎপর হয়নি, তা জানতে চেয়ে মাননীয় বিচারপতিরা তাদের মন্তব্যে বলেছেন, এটা মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্যতম অপরাধ এবং এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতেই হবে।

২০১৯ সালের মার্চে নির্যাতনে নিহত ফেনীর মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহানের মামলাতেও হাইকোর্টের মাননীয় বিচারকগণ অনুরূপ নির্দেশনা দিয়েছেন। এই মামলায় সোনাগাজী থানার ওসির বিরুদ্ধে প্রিন্সিপাল সিরাজউদ্দৌলাকে রক্ষা করার চেষ্টার অভিযোগ করা হয়। মাননীয় বিচারপতিগণ বলেন, তাঁরা এই মামলার তদন্তের ব্যাপারটি অবজার্ভ করতে, অর্থাৎ ‘লক্ষ’ করতে থাকবেন। এই অবজার্ভেশেনের পরেই তদন্ত গতি পায় এবং পুলিশ ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (পিবিআই) তৎপর হয়। সেই তৎপরতারই ফলশ্রুতি হলো আসামীর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির রায়।

নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলা ধর্ষণ ও গণধর্ষণের জন্য ইতিহাসে স্থায়ী স্থান পাবে। এই উপজেলার ৪ সন্তানের জননী ৩৫ বছর বয়স্কা গৃহবধুকে নৌকায় ভোট না দেওয়ার কারণে ১০ থেকে ১২ ব্যক্তি পালাক্রমে ধর্ষণ করে। ধর্ষিতার অভিযোগ, উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনের হুকুমে তাকে গণধর্ষণ করা হয়। অথচ পুলিশ প্রথমে যে চার্জশিট দেয়, সেখানে প্রধান আসামী রুহুল আমিনের নাম বাদ দেওয়া হয়। এই সুবর্ণচরেই উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচনে চশমা প্রতীকের প্রতিপক্ষকে ভোট না দেওয়ায় ৬ সন্তানের জননী ৪৫ বছর বয়স্ক গৃহবধুকে ১০/১২ ব্যক্তি গণধর্ষণ করে। আবার সেই সুবর্ণচরেই ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীকে ভোট দেওয়ায় প্রভাবশালী দলের আবুল কালাম আজাদের সমর্থক আলাউদ্দিন ৫ সন্তানের জননী পলি আক্তারকে ধর্ষণ করে। লোক লজ্জার ভয়ে ধর্ষিতা বিষপানে আত্মহত্যা করে। এই মামলার পর্যবেক্ষণে মাননীয় হাইকোর্ট বলেন, মেয়েকে ধর্ষণের ঘটনায় পিতা বা শ্বশুর যদি ন্যায়বিচার না পান, অথবা ন্যায়বিচার পেতে অস্বাভাবিক বিলম্ব হয় তাহলে বুঝতে হবে, সমাজ কোথায় চলে গেছে।

সম্ভবত এসব কারণেই দেখা যাচ্ছে যে, মৃত্যুদন্ডেরআইন পাশ হওয়ার পরেও ধর্ষণ তো কমইেনি, বরং তা আগের তুলনায় বেড়েছে। এগুলোর মধ্যে ২১টি কেস হলো গণধর্ষণের এবং অবশিষ্ট কেসগুলো হলো এক ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণের। আইন ও শালিস কেন্দ্রের রেপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ১২ মাসে যতগুলো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, ২০২০ সালের ১১ মাসে ধর্ষণের ঘটনা তার চেয়ে বেশি ঘটেছে।

গত সেপ্টেম্বর মাসে সিলেট এমসি কলেজে ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ কর্তৃক এক যুবতী গৃহবধুকে পালাক্রমে ধর্ষণের পর সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এই ঝড় থামতে না থামতেই পরের মাস অর্থাৎ অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে নোয়াখালীর এক গৃহবধৃকে যুবলীগের কয়েকজন নেতা কর্তৃক ধর্ষণ এবং ধর্ষণের সেই ছবি ভাইরাল হওয়ার পর বিক্ষোভের অগ্নিতে ঘৃতাহুতি হয়। মানবাধিকার কর্মী, ছাত্র এবং নাগরিক সমাজের একটি অংশ বলেন, বর্তমানে অপরাধকে ছাড় দেওয়ার সংস্কৃতি (Culture of impunit), নৈরাজ্যকর আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও তার অঙ্গ সংগঠনসমূহের প্রশ্রয়, অবদমিত গণতন্ত্র এবং বিচার প্রাপ্তিতে অস্বাভাবিক বিলম্বের ফলেই ধর্ষণের ঘটনা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। এই পটভূমিতেই ১৩ অক্টোবর মৃত্যুদন্ড সম্বলিত ধর্ষণের প্রেসিডেন্সিয়াল অধ্যাদেশ জারি করা হয়।

তিন
সম্প্রতি পাকিস্তানে ধর্ষণ বিরোধী আইন পাশ হয়েছে। ধর্ষণের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা এবং শাস্তি কঠোর করার লক্ষ্যে নতুন ধর্ষণ বিরোধী অধ্যাদেশে স্বাক্ষর করেছেন সে দেশের প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভী। গত মাসে অর্থাৎ নভেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মন্ত্রিসভা এ সম্পর্কিত বিলটি অনুমোদন করে। যৌন নিপীড়কদের তালিকা তৈরি করা, যৌন অপরাধীদের শিকার, ভুক্তভোগীদের গোপনীয়তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং অপরাধীদের রাসায়নিকভাবে খোজাকরণ বা নিবীর্জকরণ থাকছে এই বিধানে। ধর্ষণের মামলা দ্রুত আদালতে বিচার করা যাবে। এই মামলা ৪ মাসের মধ্যে শেষ করতে বলা হয়েছে এই আইনে। লাহোর শহরের উপকণ্ঠে এক নারীকে গণধর্ষণের ঘটনা প্রকাশিত হলে প্রবল জনরোষ তৈরি হয়। সেই জনরোষের কারণেই ধর্ষণ বিরোধী এই আইন প্রণীত হলো। একটি মহাসড়কের পাশে দুই সন্তানের জননী ঐ নারী ধর্ষিত হন। যৌন নির্যাতনের শাস্তি হিসাবে পৃথিবীর আরো অনেক দেশ এই Chemical castration বা রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় মানুষকে সাময়িকভাবে বা স্থায়ীভাবে পুরুষত্বহীন করা হয়। এই পদ্ধতিতে ঔষধ প্রয়োগের মাধ্যমে পুরুষের টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমানো হয় অথবা হরমোনটি নিশ্চিহ্ন করা হয়। ইন্দোনেশিয়া ও পোলান্ডে এই খোজাকরণ শাস্তি চালু আছে।

খোজাকরণ ছাড়া ধর্ষণের সিরিয়াস কেসগুলোতে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়ার ব্যবস্থাও আছে সদ্য প্রণীত ধর্ষণ বিরোধী আইনে। উক্ত আইনে আরো বলা হয়েছে, কোনো থানায় ধর্ষণের মামলা করলে ৬ ঘণ্টার মধ্যে অবশ্যই তার মেডিক্যাল পরীক্ষা করতে হবে।

মৃত্যুদন্ডের বিধান করা সত্তে¡ও বাংলাদেশে ধর্ষণ থামছে তো নাই, বরং তা আরো বেড়ে চলেছে। ধর্ষণকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনার জন্য প্রত্যেকটি মামলার মেডিক্যাল রিপোর্ট, পুলিশী তদন্ত এবং বিচার - এই সমস্ত কাজ ৬ মাসের মধ্যে অবশ্যই শেষ করতে হবে। ধর্ষণের ব্যাপারে গ্রাম্য শালিস অবিলম্বে বিলোপ করতে হবে। ভিকটিমের গোপনীয়তা ও সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। বিশিষ্ট আইনজীবী শাহ্দীন মালিক মনে করেন যে, সীমিত গণতন্ত্রের (Limited democrac) কারণেই ধর্ষণের সংখ্যা বাড়ছে। তাঁর মতে, গণতন্ত্রকে যদি অবাধ ও উন্মুক্ত করে দেওয়া না হয় তাহলে ধর্ষণ বন্ধ তো হবেই না, বরং তা আরো বাড়তে থাকবে।
journalist15@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (8)
Sakib Hossain ২২ ডিসেম্বর, ২০২০, ৪:১৩ এএম says : 0
অবস্থা দেখে তো সেরকমই মনে হচ্ছে
Total Reply(0)
গিয়াস উদ্দীন ফোরকান ২২ ডিসেম্বর, ২০২০, ৪:১৪ এএম says : 0
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের উচিত ধর্মের দিকে ফিরে যাওয়া
Total Reply(0)
কামাল রাহী ২২ ডিসেম্বর, ২০২০, ৪:১৪ এএম says : 0
অত্যান্ত সময় উপযোগী লেখা
Total Reply(0)
রায়হান ইসলাম ২২ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০৪ পিএম says : 0
দেশে আইনের শাসন থাকলে মানুষ এত অন্যায় করার সাহস পেতো না
Total Reply(0)
প্রিয়সী ২২ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:১২ পিএম says : 0
ধর্ষণের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা এবং কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
Total Reply(0)
সঞ্জয় ২২ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:১৩ পিএম says : 0
এই বিষয়টি নিয়ে লেখার জন্য মোবায়েদুর রহমান সাহেবকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি
Total Reply(0)
Qulsum ২২ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:৩৩ পিএম says : 0
Amra shovvo chilam kobe???
Total Reply(0)
Jack Ali ২৩ ডিসেম্বর, ২০২০, ৪:৫০ পিএম says : 0
Only Islam is the Answer.. Democracy is the Kafir law, it creates barbarian monster as such they commit all sort of heinous crime, they loose their morality and humanity. Remember , democracy never lasts long. It soon wastes, exhausts, and murders itself. There never was a democracy yet that did not commit suicide.”—John Adams Marvin Simkin: “Democracy is not freedom. Democracy is two wolves and a lamb voting on what to eat for lunch. True democracy is the tyranny of the majority. True democracy is mob rule. World renowned Philosopher Bernard Shaw commented that “If all the world was united under one leader, Mohammad would have been the best fitted man to lead the peoples of various creeds, dogmas and ideas to peace and happiness.” They are utterly deaf, dumb, and blind; they can no longer recover. (Al-Baqarah 2:18)They are deaf, dumb and blind, and so they do not think and understand. (Al-Baqarah 2:171) One of the Non-Believer Historian Nicolson remarked about Qur'an: An encyclopaedia for Law of Legislation.. Also George Bernad Shaw the greatest philosopher once said: within one century the whole Europe particularly England will embrace Islam to solve their problems.
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন