শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

চাঁদপুরে পরিত্যক্ত ইটভাটায় ভিনদেশী ফলের সমারোহ

চাঁদপুর থেকে স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৩ ডিসেম্বর, ২০২০, ১০:১১ এএম

মাটি পুড়িয়ে ইট তৈরির চিমনির বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় যেখানে বিদেশি ফল দূরের কথা, স্বাভাবিক ফসল উৎপাদনই ছিল প্রায় অসম্ভব। সেই ইটভাটার জমিতেই এখন চাষ হচ্ছে দুর্লভ জাতের বিভিন্ন আম, পারসিমন, ব্লাড অরেঞ্জ, গ্র্যাপফ্রুটস, হলুদ ও লাল ড্রাগন ফল, নতুন জাতের মাল্টা, কমলা, স্ট্রবেরিসহ বিখ্যাত ক্যান্টালোপ বা রকমেলন। পরিবেশ দূষণকারী ইটভাটায় এখন ভিনদেশী ফলের সমারোহ।

প্রকল্পের মালিক কৃষি উদ্যোক্তা হেলাল উদ্দিনের মনে করেন, ফ্রুটস ভ্যালি এগ্রো নামের নতুন এ প্রকল্পে এমন সব বিদেশি ফলের চাষ হচ্ছে ইতিপূর্বে দেশের কোথাও যার বাণিজ্যিক চাষ হয়নি। তিনি সফল হলে পুরো দেশেই ছড়িয়ে দেয়া হবে এসব উন্নতমানের ফলের চারা। এর ফলে বিদেশি ফল আমদানি-নির্ভরতা কমবে বলে তিনি আশা করেন। প্রকল্পটি সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, অসংখ্য মানুষ প্রকল্পে এসে উঁচু দামে গাছপাকা ফল কিনছেন।

ফ্রুটস ভ্যালি নামের পরিবেশবান্ধব এ এগ্রো প্রকল্পে ব্যবহার হচ্ছে সর্বাধুনিক কৃষি প্রযুক্তি। পানি সেচের জন্য ব্যবহার হচ্ছে ব্যয়বহুল ড্রিপ-ইরিগেশন পদ্ধতি। এর ফলে প্রতিটি গাছের গোড়ায় নিয়মিত নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে। ফল চাষের পাশাপাশি প্রায় দেড় একর আয়তনের ইটভাটার আরেকটি পতিত নিচু জমিতে চাষ হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের বিদেশি সবজি। যার মধ্যে আছে বিভিন্ন রঙের ক্যাপসিকাম, ব্রুকলি, চার জাতের চেরি টমেটো, কালো টমেটো, হলুদ টমেটো, ইতালিয়ান জাতের বিচিহীন শসাসহ নানা ধরনের নতুন জাতের ফসল। সম্পূর্ণ অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে বিশ্বখ্যাত উন্নত জাত ও মানের বিভিন্ন জনপ্রিয় বিদেশি ফল।

চাঁদপুর জেলা সদরের শাহমাহমুদপুর ইউনিয়নের শাহতলী এলাকায় ফ্রুটস ভ্যালি নামের এ এগ্রো প্রকল্পে প্রথমবারেই বাম্পার ফলন হয়েছে বিভিন্ন বিদেশি ফলের। সাফল্যের এ খবর ছড়িয়ে পড়ায় পুরো জেলায় আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয়, চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক ফল কিনে প্রকল্পের প্রথম ক্রেতা হয়েছেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (সার্বিক) নেতৃত্বে জেলা প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রকল্পটি পরিদর্শন করেছেন।

ফ্রুটস ভ্যালি এগ্রোতে প্রথম ফসল হিসেবে চাষ করা বিখ্যাত রকমেলন, মাস্কমেলন, হানিডিউ ও আইসবক্স ইয়েলো নামের হলুদ তরমুজের ব্যাপক ফলন হয়েছে। ইটখোলার এ জমিতে এমন ফলন দেখে হতবাক হয়েছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা।

দুর্লভ জাতের ও স্বাদের এসব বিশ্বখ্যাত ফল দেখার জন্য প্রতিদিনই দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য নারী-পুরুষ ছুটে আসছেন ফ্রুটস ভ্যালিতে। এ নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নতুন কৃষি উদ্যোক্তা হেলাল উদ্দিন। যিনি পেশায় সিনিয়র সাংবাদিক। ঢাকায় দীর্ঘ ৩৭ বছর তিনি সাংবাদিকতা পেশায় জড়িত। প্রায় ৬০ বছরের পারিবারিক দুটি লাভজনক ইটভাটা বন্ধ করে তিনি সে জমিতে বিদেশি ফল চাষ করে নজির সৃষ্টি করেছেন।

ফ্রুটস ভ্যালি এগ্রো প্রকল্পটি প্রায় চার মাস আগে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগে প্রায় আড়াই একর জমি বালু ভরাট করা হয়। এ বালুময় মাঠেই জৈব সার মেশানো মাটির কৃত্রিম টব তৈরি করে বিশ্বখ্যাত ফল চাষ শুরু করে চমক সৃষ্টি করেছেন কৃষি উদ্যোক্তা হেলাল উদ্দিন।

এমন অনেক জাতের ফল চাষ করা হয়েছে যা এদেশে প্রথম বাণিজ্যিক চাষ। কয়েক জাতের রকমেলন বা সাম্মাম, আইসবক্স ইয়েলো (উপরে সবুজ ডোরাকাটা ভেতরে গাঢ় হলুদ) এবং হানিডিউ নামের মেলন। ভেতরে বিচিহীন হলুদ তরমুজ যা আইসবক্স ইয়েলো নামে পরিচিত।

কৃষি উদ্যোক্তা হেলাল উদ্দিন জানান, ‘লাভজনক ইটভাটার ব্যবসা বন্ধ করে এগ্রোতে প্রথম বিনিয়োগেই দুষ্প্রাপ্য বিশ্বখ্যাত কিছু ফলের বাণিজ্যিক চাষের ঝুঁকি নিয়েছি। এসব ফলের জাত সংগ্রহ করতে দীর্ঘ সময় অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। জাতগুলো বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী কি না নিশ্চিত হতে হয়েছে। যখন বিশ্বাস করেছি, প্রতিটি ফলের জাতই বাণিজ্যিক চাষ উপযোগী তখনই বিনিয়োগের ঝুঁকি নিয়েছি। আমি মনে করি ফ্রুটস ভ্যালি এগ্রো প্রকল্পটি হবে এদেশের একটি মডেল ফল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। যেখানে প্রথমবারের মতো এমন কিছু ফলের চাষ হচ্ছে যা এতদিন ছিল স্বপ্ন। আমি সফল হলে তা পুরো দেশেই ছড়িয়ে যাবে। ’
এসব ফলের বাণিজ্যিক বাজারজাত এখনো শুরু হয়নি। তবে, এখন সময় এসেছে সাম্মাম, রকমেলন, মাস্কমেলন বাজারজাত করার। ইতিমধ্যে ঢাকার কিছু সুপারশপসহ অনেকেই আগাম বুকিং দিয়ে রেখেছেন এসব ফল কিনতে।

চাঁদপুর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আয়শা আক্তার বলেন, হেলাল উদ্দিন উদীয়মান উদ্যোক্তা হিসেবে সম্পূর্ণ অর্গানিক পদ্ধতিতে আনকমন বিদেশি সুস্বাদু ফল উৎপাদনের চেষ্টা করছেন। গতানুগতিক চাষের বাইরে ভিন্নতায় তিনি সফলও হচ্ছেন। ইতোমধ্যে তিনি তার উৎপাদিত ফলন ঢাকার বড় কয়েকটি শপিংশপে সরবরাহও করেছেন। চেষ্টা করেছেন বিদেশি এসব আনকমন ফল এদেশে উৎপাদনের। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে পরিবেশবান্ধব জৈব প্রযুক্তিতে এসব ফল উৎপাদন করা হচ্ছে।
কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, ‘বৃহত্তর কুমিল্লার মধ্যে চাঁদপুরে এই প্রথম জৈব ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে বিদেশি দুর্লভ ফল চাষাবাদ করে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন তিনি। তিনি পরমান করেছেন যে কোনো জায়গায় এ ধরনের ফল বাগান করা কোনো কষ্টসাধ্য বা ঝুঁকির বিষয় নয়। শুধু উদ্যোগে নিলে আর সামান্য পরিচর্যা করলেই এ ধরণের ফল বাগান সারাদেশের যে কোনো স্থানে করা সম্ভব। এজন্য সরকারও ব্যাপক সহায়তা করবে।’

ফ্রুটস ভ্যালির প্রথম ফল ক্রেতা চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মো. মাজেদুর রহমান খান জানান, ‘আমি তিন ধরনের ফল কিনে এনেছি। অবশ্যই স্বাদে-গুণে আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বিদেশি ও আনকমন বিষমুক্ত ফল অবশ্যই স্বাস্থ্যসম্মত বলে মনে করি। এ ধরনের ফল উৎপাদনে অন্যরাও এগিয়ে এলে মানবদেহের পুষ্টির চাহিদা যেমন পূরণ হবে তেমনি দেশে নতুন নতুন উদ্যোক্তাও তৈরি হবে। ’

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন