বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পরিবেশ রক্ষায় বায়োটেকনোলজি

মাহমুদ কামাল এনামুল হক | প্রকাশের সময় : ২৯ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০২ এএম

সাম্প্রতিক সময়ে, অর্থনৈতিক, জনসাধারণ এবং উন্নয়নের জন্য টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব পরিবেশগত প্রক্রিয়াগুলির ব্যবহার ও চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে যে সব প্রযুক্তির ব্যবহার উন্নয়নের মাত্রাকে বৃদ্ধি করছে, জৈবপ্রযুক্তি এর মধ্যে অন্যতম। জৈব প্রযুক্তি এমন একটি প্রযুক্তি যা বিভিন্ন পণ্য বিকাশ বা তৈরি করতে জৈবিক প্রক্রিয়া, জীবজন্তু বা এর কিছু অংশ ব্যবহার করে। অপরদিকে পরিবেশগত জৈবপ্রযুক্তি (এনভায়রনমেন্টাল বায়োটেকনোলজি) হলো জৈবপ্রযুক্তি, যা প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর প্রয়োগ করতে ব্যবহৃত হয় এবং পরিবেশগত জৈবপ্রযুক্তির দ্বারা বোঝা যায় যে কেউ বাণিজ্যিক ব্যবহার এবং শোষণের জন্য জৈবিক প্রক্রিয়াটি ব্যবহার করার চেষ্টা করে। পরিবেশগত জৈবপ্রযুক্তি আরও সংজ্ঞায়িত করে যে, দূষিত পরিবেশের (ভূমি, বায়ু, পানি) প্রতিকারের জন্য জৈবিক প্রক্রিয়ার বিকাশ, ব্যবহার এবং নিয়ন্ত্রণকরণ এবং পরিবেশ বান্ধব প্রক্রিয়াগুলির জন্য (সবুজ উৎপাদন প্রযুক্তি এবং টেকসই উন্নয়ন)। পরিবেশগত জৈবপ্রযুক্তি উদ্ভিদ, প্রাণী, ব্যাকটিরিয়া, ছত্রাক এবং শেওলার মাধ্যমে প্রকৃতির সর্বাধিক ব্যবহার হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে। তাছাড়া জৈবপ্রযুক্তি দূষিত পানি, বায়ু এবং কঠিন বর্জ্য প্রবাহের পর্যবেক্ষণ, মূল্যায়ন, মডেলিং, এবং চিকিৎসা সম্পর্কিত সমস্যাগুলি কার্যকরভাবে মোকাবেলার জন্য কাজে লাগানো যায়। পরিবেশ দূষণকারী উৎস সনাক্ত এবং জৈবিক ভিত্তিক পদ্ধতিগুলি ব্যবহার করে প্রক্রিয়া মডেলিং ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, মূলত এই জাতীয় কৌশলগুলির যথার্থতার কারণে। আজকাল উপলব্ধ বিভিন্ন জৈবপ্রযুক্তি এইভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত প্রযুক্তিগুলির মতো বর্জ্য পানি, বায়ু এবং কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন জৈবিক প্রক্রিয়াগুলির টেকসই ব্যবহারের কাজ করছে।

উন্নয়নশীল দেশগুলিতে পানি, বায়ু এবং মাটি দূষণ দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়নের কারণে স্থায়ী পরিবেশগত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশগত কুজনেট কার্ভ (ইসিসি) ব্যবহার করে দেখা গেছে যে, একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে অর্থনৈতিক বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে, পরিবেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য একটি উচ্চ মূল্য প্রদান করেছিল। কারণ মানব জাতি সকল সম্ভাব্য মূল্যবান সংস্থানকে কাজে লাগানোর জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিল। কৃষিক্ষেত্রগুলিতে প্রক্রিয়া সহজেই জমির নিষ্কাশন এবং ভূ-পৃষ্ঠের পানিকে মূল্যবান পানির উৎসগুলিতে স্থানান্তরিত করে। যার ফলে পানির গুণগতমানের অবনতি ঘটে, যা পানির গুণাগুণ নিরীক্ষণের জন্য অভিনব বায়োসেন্সর ব্যবহারের নিশ্চয়তা দেয়।

দ্রুত শিল্প প্রবৃদ্ধির ফলে জলাশয়ে বিষাক্ত রাসায়নিক এবং ভারী ধাতুর উচ্চতর নির্গমন ঘটে। জলাশয়গুলিতে সঞ্চারিত একটি নির্দিষ্ট দূষণকারী মাত্রা আশেপাশের শিল্পকারখানার উপর নির্ভর করে। টেক্সটাইল, মাইনিং, ট্যানারি, মেটাল প্যাটিং, সার এবং কৃষি শিল্প, ব্যাটারি, কীটনাশক, আকরিক শোধনাগার, পেট্রোকেমিক্যালস এবং কাগজ উৎপাদন প্রভৃতি শিল্পগুলি মাটি, বায়ু এবং পানির দূষণজনিত সমস্যায় ব্যাপক অবদান রাখে। কিছু রাসায়নিক বায়োডিগ্রেটেবল হয় না, তাই মাটি, বায়ু এবং পানির মধ্যে মিশে এবং খাবার শৃঙ্খলেও সমস্যা সৃষ্টি করে থাকে। এর ফলস্বরূপ মানুষের স্বাস্থ্যের সমস্যা এবং জলজ জীবের মৃত্যু ঘটে। জলাশয়ে নাইট্রোজেন এবং ফসফরাসের উপস্থিতি জলজ ব্যবস্থায় বায়োমাসের উৎপাদন বৃদ্ধি করে, যার ফলে পানির গুণমান হ্রাস পায় এবং এই বাস্তুতন্ত্রগুলির প্রাকৃতিক ভারসাম্য হুমকির মুখে পড়ে। যদিও অনেক দেশে বর্জ্য পানি থেকে কড়া নাইট্রোজেন এবং ফসফরাস স্রাবের মান নির্ধারণ করে। শিল্পকারখানা প্রায়ই এই প্রয়োজনীয়তা পূরণে সমস্যার মুখোমুখি হয়। একটি নির্দিষ্ট দেশের নিয়ন্ত্রক দৃষ্টিকোণ থেকে, সর্বশেষ নির্গমনের মান মেনে চলার জন্য বিদ্যমান বর্জ্য জল ব্যবস্থাপনা জৈব প্রযুক্তিগুলিকে নতুন ভাবে বিকাশ বা সহজ করা প্রয়োজন।

ভারী ধাতু এবং কীটনাশক জাতীয় পরিবেশ দূষণকারীরা সাধারণত অ্যাসিড খনি বা অন্যান্য শিল্প এবং কৃষিজাতীয় জলস্রোতে থেকে নির্গত পানিতে উপস্থিত থাকে। এই বিষাক্ত দূষকগুলি জীবগুলিতে জমে এবং কার্সিনোজেনসিটি ও তীব্র বিষাক্ততার মতো বিরূপ প্রভাব তৈরি করতে পারে। সক্রিয় ব্যাকটিরিয়া, ছত্রাক, মিশ্রিত মাইক্রোবিয়াল ব্যবহার করে এমন জৈবিক প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ খনিজায়ন করা যায় এবং এই দূষকগুলি ও তাদের বিষাক্ত উপজাতগুলি অপসারণ করা সম্ভব। ভারী ধাতু, দূষিত বর্জ্য পানির ক্ষেত্রে, বায়োসোরপশন একটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ স্বল্প ব্যয়ের পদ্ধতি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং যেখানে জৈবিক অনুঘটকগুলি জলীয় দ্রবণগুলি থেকে ভারী ধাতবগুলি সরিয়ে এবং পুনরুদ্ধারে নিযুক্ত করা হয়। এটি একটি সুপরিচিত সত্য যে বিভিন্ন উৎস থেকে নর্দমার জলের নগর নদী বা স্রোতে নির্গত হয়। প্রচলিতভাবে, জলাশয়ের পানির গুণমান নির্ধারণের জন্য পানির গুণমানের সূচক পদ্ধতির অন্যতম সেরা সরঞ্জাম সা¤প্রতিক গবেষণাগুলি নগর জলাশয়ের পুনর্বাসনের জন্য এবং তাদের মান উন্নত করার জন্য উদ্ভাবনী এবং উদ্ভাবনী সমাধানের প্রস্তাব করেছে। ব্যাকটেরিয়াল প্রযুক্তি (বিটি) হ্রদ, নদী এবং প্রবাহের মতো নগরায়িত জলাশয়গুলিকে পুনর্বাসিত করতে পারে। বিটি যেসব সুবিধাগুলি সরবরাহ করে; জনস্বাস্থ্যের জন্য টেকসই এবং নির্ভরযোগ্য, স্বল্প রক্ষণাবেক্ষণ, ন্যূনতম পরিচালন ব্যয় এবং অপারেশনের যে কোনও স্তরে পুনঃব্যবহার।

গ্রিন হাউজ বা সবুজ ঘরের সাথে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত। আমাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদেরা অনেক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। শীত প্রধান দেশে গাছপালাকে ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য কাচের ঘরে গাছ লাগানোর পদ্ধতি বা গ্রীন হাউস তারই একটি। কিন্তু মানুষ ক্রমে এই পৃথিবীটাকেও একটু একটু করে গ্রীন হাউসে পরিণত করে ফেলেছে। শিল্প কারখানার কালো ধোঁয়া, জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, পেট্রোলিয়াম প্রভৃতি) ব্যবহারে বায়ুমন্ডলে বাড়ছে কার্বন ডাই অক্সাইড সহ অন্যন্য বিষাক্ত গ্যাসের পরিমাণ। এই বিষাক্ত গ্যাসগুলো সবাই মিলে আমাদের এই সবুজ পৃথিবীর চারপাশে তৈরি করেছে কাচের মতো একটি দুর্ভেদ্য স্তর। পৃথিবীর এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির ব্যাপারটি কিন্তু আজ থেকে বহু বছর আগেই উত্থাপন করেন সুইডিশ বিজ্ঞানী আরহেনিয়াস, ১৮৯৬ সালে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে জলবায়ুর উপরে যেরকম নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পৃথিবীর দরিদ্র দেশের মানুষেরা।

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঠেকাতে মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন। পরিবেশ দূষণ এড়িয়ে এই পৃথিবীটাকে মানুষের বাসযোগ্য করে রাখতে ১৭২টি দেশের অংশগ্রহণে ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলন। ১৯৯৭ সালে ডিসেম্বরে জাপানের কিয়োটোতে জাতিসংঘ ক্লাইমেট চেঞ্জ কনভেনশনের উদ্যোগে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা কিয়োটো প্রটোকল নামে পরিচিত। এই চুক্তিতে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক ছয়টি গ্যাস নির্গমন ও নিঃসরণ হ্রাসের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। এই ছয়টি গ্যাস হচ্ছে- কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, হাইড্রোফ্লুরো কার্বন, পারফ্লুরো কার্বন এবং সালফার হেকসাফ্লুরাইড।

পরিবেশ দূষণের আরেকটি ভয়াবহ দিক হচ্ছে ওজোন স্তরের ক্ষয়। পৃথিবী থেকে বিশ থেকে ত্রিশ কিলোমিটার উপরের ওজোন স্তরটি আমাদের অতিবেগুনি বা আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে রক্ষা করে। এর ফলে মানুষের ত্বকের ক্যন্সার, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাওয়া ছাড়াও উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধিও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এই ওজোন স্তরের ক্ষয়ের জন্য যে রাসায়নিক পদার্থটি বেশি দায়ী তার নাম ক্লোরোফ্লুরোকার্বন, সংক্ষেপে সিএফসি। জৈবপ্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য দুর্দান্ত সুযোগ তৈরি করছে এবং কীটনাশক, সারের মতো কৃষি রাসায়নিকগুলির হ্রাস ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। বায়োটেকনোলজি সুন্দর পরিবেশ অর্জনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ও পরিবেশ-বান্ধব ফসল যেমন পোকামাকড় প্রতিরোধী, ভেষজনাশক সহনশীল প্রজাতি ব্যবহার করে টেকসই উন্নয়ন করছে। এমন ফসল উৎপাদন করছে যা নাইট্রোজেন ঠিক করতে পারে এবং পরিবেশকে পরিশোধিত করে। বৈশ্বিক খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে অপরদিকে বিদ্যমান জমি ও কৃষি ক্ষেত্রের মধ্যে উৎ্পাদন এবং আধুনিক উদ্ভিদ প্রজনন পদ্ধতির ব্যবহার উন্নত হয়েছে যা মাটির কাঠামো, জৈব পদার্থ এবং উর্বরতা উন্নত করতে লেবু গাছের মতো ফসলের উৎপাদনবৃদ্ধি করতে সক্ষম। এইগুলো জৈবিক উৎস সংরক্ষণ এবং মাটি ক্ষয় রোধ করতেও ভ’মিকা রাখে। পশুর কিছু উপকারী প্রভাব পরিবেশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে আলোচিত হয়েছে। প্রযুক্তির বিপ্লবে আমাদের জীবনধারা পালটে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই প্রযুক্তির একটি বিরাট অংশ জুড়ে আছে রাসায়নিক প্রযুক্তি। বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক প্রযুক্তির উপরে ভিত্তি করেই গড়ে উঠছে বিভিন্ন ধরনের শিল্পকারখানা। এসব শিল্প কারখানায় তৈরি হচ্ছে আমাদের বিভিন্ন ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী।

পরিবেশ দূষণ পৃথিবীর সব দেশেরই একটি অভিন্ন সমস্যা। দূষণ রোধে বিভিন্ন ধরনের সম্মেলন, সেমিনার, চুক্তি হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা পরিবেশ বান্ধব বিকল্প প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা বলছেন। কিন্তু পরিবেশ দূষণের ফলে আমাদের ভবিষ্যৎ ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। এই অনিশ্চয়তার জন্য ধনী দেশগুলো বেশি দায়ী। তবে এই পরিবেশ দূষণের নেতিবাচক প্রভাব থেকে কোনো দেশেরই মুক্তি নেই। তাই পৃথিবীতে আমাদের টিকে থাকতে হলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করাটা জরুরি। আর তা না পারলে পৃথিবী থেকে আমাদের অস্থিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়াটাও অসম্ভব কিছু নয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Arko Chowdhury ২৩ নভেম্বর, ২০২২, ৭:১৫ পিএম says : 0
খুবই কার্যকর একটি বক্তব্য। ধন্যবাদ।
Total Reply(0)
Arko Chowdhury ২৩ নভেম্বর, ২০২২, ৭:১৫ পিএম says : 0
খুবই কার্যকর একটি বক্তব্য। ধন্যবাদ।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন