শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

শালীন হোক মাহফিল আলোচনা

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:১০ এএম

সম্প্রতি ওয়াজবক্তাদের নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। তারা সর্বত্র আলোচিত সমালোচিত হচ্ছেন। ইউটিউবের কল্যাণে এঁদের ওয়াজ খুব সহজে দেখা যায়, শোনা যায় এবং মাপা যায়। এই মাপার বেলায় যদি রাসুল (সা.)-এর পথ ও পদ্ধতি সামনে রাখা হয়, তাহলে স্পষ্ট বোঝা যায়, অধিকাংশ ওয়াজবক্তার ওয়াজ তা থেকে যোজন যোজন দূরে। তাঁদের শব্দচয়ন ও বিষয় নির্বাচন থেকে শুরু করে অঙ্গভঙ্গি এবং ওয়াজের আর্থিক ফি- সবকিছুতে তারা যেনো পুরোপুরি বাণিজ্যিক হয়ে উঠছেন। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে গিয়ে অথবা লোক হাসাতে গিয়ে নানা ধরনের অশোভন ও অনর্থক কথা বলে অনেক ওয়াজবক্তা হাসি ও সমালোচনার পাত্র হচ্ছেন। দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, সাধারণ শ্রোতারা এখন ওয়াজবক্তাদের মুখে কৌতুক শুনে বা অভিনয় দেখে হাসতে বেশি আগ্রহী। আল্লাহর ভয় ও রাসুল (সা.)-এর জন্য ভালোবাসা এবং সাহাবিদের জীবনকথা এসব ওয়াজে খুব একটা আলোচিত হয় না। যে যত বেশি গান শোনাবেন, কৌতুক ও অভিনয়ে হাসাতে পারবেন, তার ওয়াজ তত বেশি জমবে। ওয়াজের বাজারে সম্মানির সূচক তত উর্ধ্বমুখী হবে। তাই ওয়াজের বাজারে নিজের অবস্থান পোক্ত করতে কেউ কৌতুকের আশ্রয় নেন, কেউ ইংরেজি শব্দের ব্যবহার দেখান, কেউ গান শোনান, কেউ নিজের অভিনব কারিশমা জাহির করেন। আবার এত এত ওয়াজবক্তাদের বদৌলতে দেশে এখন বক্তাকেন্দ্রিক বেশ ভক্তশ্রেণি গড়ে উঠছে। এক বক্তার ভক্তরা অন্য বক্তার ভুল ধরে তাকে ঘায়েল করার মধ্যে সত্যের বিজয় ও অসত্যের পরাজয় খুঁজে পাচ্ছে। অনেক ওয়াজবক্তাকে দেখা যায়, কথায় কথায় আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.)-এর নামে, হাদিসের নামে বা ধর্মের নামে মিথ্যাচার করতে। অথচ রাসুল (সা.) কি কখনও এভাবে লোক হাসিয়ে ওয়াজ করেছেন? কিংবা তিনি কি কখনও ‘তুই-তোকারি’ করে চেঁচিয়ে চেয়ার-মঞ্চ কাঁপিয়েছেন? ইসলাম থেকে দূরে থাকা লোকদের নিয়ে হাসিঠাট্টা, মিথ্যাচার কিংবা গালিগুলুজ করে সমবেত শ্রোতাদেরকে উস্কে দেওয়ার কোনো নমুনা নবীজীবনের কোথাও আছে? সর্বোপরি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্দিষ্ট অংকের ফি নির্ধারিত রেখে ওয়াজ করা কি আদৌ ইসলামের দাওয়াত হতে পারে?
বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এক কথায় বলা চলে, ওয়াজের বক্তারা এখন সমাজের বিত্তবানদের ‘পুতুলে’ পরিণত হচ্ছেন। কারণ দিনশেষে এই বিত্তবানদের বদৌলতে ওয়াজের হাদিয়া ভালো জুটছে। ওয়াজের বক্তারা যেসব পাপের ওয়াজ করেন, সেগুলোর অধিকাংশ গরিব লোকেরা করেন। ধনী ও প্রভাবশালী লোকদের কুকর্ম এসব ওয়াজে সাধারণত আলোচিত হয় না। যদি মাহফিলে আগতদের একটা অংশও হেদায়েতপ্রাপ্ত হত, তাহলে আমাদের সমাজের চিত্রটা সত্যিই বদলে যেত। কিন্তু বদলেছে কি? মানুষে মানুষে প্রতিহিংসা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। যে হারে মাহফিলের সংখ্যা বেড়েছে, সেই হারে যদি হেদায়েতপ্রাপ্তের সংখ্যা বাড়তো, তাহলে দেশে চুরি, নেশা, গুম, দুর্নীতি, ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা এত বেশি হতো না। এক থেকে দেড় ঘণ্টা ওয়াজের বিনিময়ে হাজার হাজার টাকা, আয়োজক কমিটি মাদরাসাঅলা হলে মাদরাসার বার্ষিক সঞ্চয়, মসজিদের পক্ষ থেকে হলে মসজিদের জন্য সঞ্চয় করা বর্তমানে অধিকাংশের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত এক দশক আগের তুলনায় বাংলাদেশে এখন ওয়াজ মাহফিল বেশি হচ্ছে। প্রতি ওয়াজে বক্তা এবং শ্রোতার সংখ্যাও বাড়ছে অনেক। কিন্তু সামাজিক অবক্ষয় ও অধঃপতন রোধে এসব ওয়াজ কার্যকর ভূমিকা রাখছে বলে বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সমাজে আজ ওয়াজের নামে আওয়াজ হচ্ছে অনেক। কিন্তু শ্রোতাদের হৃদয়ে তা আর আগের মতো প্রভাব ফেলছে না। এর পেছনে যদি অন্তত দুটি মৌলিক কারণ থেকে থাকে, তবে তা হলো- ওয়াজবক্তাদের দুনিয়ামুখী মানসিকতা এবং তাদের অসচেতন দাওয়াতি পন্থা। যতদিন না এই চিত্র বদলাবে, ততদিন ওয়াজের মাধ্যমে বক্তা, ডেকোরেটর, রেন্ট-এ কার, হেলিকপ্টার, ছাপাখানাসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্টদের পকেট ভারী হবে ঠিক, কিন্তু হারিয়ে যেতে থাকবে ইসলামের সুমহান সৌন্দর্যের দিকে আহবানের নববী পথ ও পদ্ধতি।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন