বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ইংরেজি নববর্ষ সংখ্যা

চট্টগ্রাম বন্দর : অর্জন এবং প্রয়োজন

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:১০ এএম

‘সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার- চট্টগ্রাম বন্দর’। ‘কান্ট্রি মুভস উইথ আস’। উভয় প্রত্যয় দিয়েই দেশের প্রধান চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের থিম স্লোগান। আমদানি-রফতানি, শিল্পায়ন, শিল্প-কারখানা পরিচালনা, বৈদেশিক ও দেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, সর্বোপরি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) খাতে সর্ববৃহৎ অংকের রাজস্ব আদায়ের চাবিকাঠি, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির হৃৎপিন্ড চট্টগ্রাম বন্দর। বাংলাদেশের গেইটওয়ে। চট্টগ্রাম বন্দর কার্যক্রম বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে প্রতিনিধিত্ব করে। ‘কেমন আছে বাংলাদেশ’- তার সার্থক প্রতিচ্ছবি প্রধান সমুদ্র বন্দরের হালচাল। বিদায়ী ২০২০ ইংরেজি সালে চট্টগ্রাম বন্দরের সাফল্যের পালকে অর্জন অনেক। নতুন বছর ২০২১ সালকে ঘিরে প্রত্যাশার পারদ উঁচুতে।
তবে আশা-নিরাশার দোলাচলও আছে। দেশের ও বৈশি^ক ক্রমবর্ধমান চাপ আর চাহিদা সুচারুরূপে সামাল দিতে হলে প্রধান বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন বিশেষত ভৌত অবকাঠামো, ভারী যান্ত্রিক সাজ-সরঞ্জামের প্রয়োজন মেটাতে হবে। এমনটি তাগিদ আসছে পোর্ট-শিপিং সার্কেল ও বন্দর ব্যবহারকারীদের পক্ষ থেকে। ফি-বছর মুনাফা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বন্দর। তার নিজস্ব অর্থায়নে এবং যৌথ বিনিয়োগে উন্নয়ন, আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের অপরিহার্যতা পরিপূরণ করা সম্ভব। বহুল আলোচিত ‘আগামীর বন্দর’ বে-টার্মিনাল পরিকল্পনা আজও ‘কল্পনা’র অনিশ্চয়তায় ঝুলে আছে। এ নিয়ে চিটাগাং চেম্বারসহ ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তা, বন্দর ব্যবহারকারীদের মাঝে বিরাজ করছে অসন্তোষ-হতাশা, অনেক জিজ্ঞাসা। তাছাড়া বৈদেশিক বাণিজ্য ও রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়ায় আরও আধুনিকায়নে, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এবং যুগের চাহিদা পূরণে চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টম হাউসের মধ্যকার সমন্বিত পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন অপরিহার্য।
জেগে আছে বাতিঘর
বৈশি^ক মহামারী করোনাকালে বিশ^ব্যাপী মন্দার ঘাত-অভিঘাত বাংলাদেশেও প্রতিটি ক্ষেত্রে স্পষ্ট। অর্থনীতির গতিময়তা ও জনজীবনের স্বাচ্ছন্দ্যকে নাস্তানাবুদ করে দিচ্ছে করোনা নামক অদেখা ভাইরাসের মহাদৈত্য। করোনাকারণে মার্চ-এপ্রিল থেকে বছরের শুরুর দিকেই দেশের সরকারি-আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারি, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, বিভাগ, সংস্থা ও কোম্পানিগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রম একে একে প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। শাট ডাউন লক ডাউনে প্রায় অচল হয়ে পড়ে দেশ, দেশের অর্থনীতি। মুখ থুবড়ে পড়ে উৎপাদন কার্যক্রম। অথচ তেমনি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেই বঙ্গোপসাগরের কোলে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় গড়ে ওঠা হাজার বছরের নিরাপদ পোতাশ্রয় চট্টগ্রাম বন্দর আশার আলোকবর্তিকা নিয়ে জেগে ছিল এবং আছে আজও।
দেশি-বিদেশি জাহাজ ও নাবিকদের জন্য বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, হাসপাতালের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সী-অ্যাম্বুলেন্স সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখা, নাবিকদের চট্টগ্রাম নগরীতে প্রবেশরোধে শোর পাস বন্ধ, বন্দরের জনবল ও বন্দর ব্যবহারকারী লোকজনের নিয়মিত শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা সাপেক্ষে সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ, জেটি-বার্থ, ইয়ার্ড, শেডসহ সর্বক্ষেত্রে করোনায় সর্বোচ্চ সতর্কতার নিয়ম-বিধি অনুসরণ করা হচ্ছে।
এর মধ্যদিয়ে অকুল সমুদ্রে জাহাজের নাবিকের দিক-নির্দেশক সাগরতীরের বাতিঘরের মতোই দেশ ও জাতিকে আশা-ভরসা দেখিয়ে আসছে চট্টগ্রাম বন্দর। এভাবে বছরজুড়ে রয়েছে কর্মচঞ্চল। ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শিল্প-কারখানা, আমদানি-রফতানিসহ দেশের অর্থনীতিতে রক্তসঞ্চালকের ভূমিকা পালন করছে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর। শুধুই তাই নয়; রফতানিমুখী গার্মেন্টসহ বিভিন্ন খাত উপখাতে বন্দরচার্জ, মাশুল, পেনাল রেন্ট বা দÐভাড়া মওকুফের মাধ্যমে অন্তত ৩শ’ কোটি টাকা প্রণোদনা সহায়তা হিসেবে ছাড় দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)।
জট সামাল, দক্ষতা, সেবার নজির
করোনাকারণে সড়ক, নৌপথ, সড়ক মহাসড়কে পরিবহন বন্ধ থাকায় মার্চের শেষের দিক থেকে জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনারসহ খোলা সাধারণ পণ্যসামগ্রী এবং জাহাজের ভয়াবহ জট সৃষ্টি হয়। বেসরকারি আইসিডি (অফডক) মালিক, স্টেক হোল্ডারদের সহযোগিতায় বন্দর কর্তৃপক্ষ ও নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় দক্ষতার সাথে জট পরিস্থিতি দ্রæত সামাল দেয়। বিশেষত চিকিৎসা সরঞ্জামসহ জরুরি সেবাখাতের পণ্যসামগ্রী, মাহে রমজানের ভোগ্য ও নিত্যপণ্য, রফতানিমুখী গার্মেন্টসহ শিল্পের কাঁচামাল, খাদ্যসামগ্রী অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খালাস ও ডেলিভারি পরিবহন করা হয়।
প্রথমদিকে বন্দরে আমদানি-রফতানি থমকে গেলেও শিগগিরই পণ্য প্রবাহ স্বাভাবিক হয়ে উঠে। প্রধান আমদানি-রফতানিকারক দেশ চীনে করোনা নিয়ন্ত্রণে আসার সাথে সাথেই বাংলাদেশের অভিমুখে জাহাজের পর জাহাজে শিল্পপণ্যসহ বিভিন্ন পণ্য চালান আসে ক্রমাগত। অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত পণ্য ছাড়করণে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস বন্দরের সাথে সমন্বয় জোরদার করার ফলে দ্রæতায়িত হয় খালাস প্রক্রিয়া। জাতীয় স্বার্থে সেবা দানে নজির স্থাপন করেছে বন্দর। করোনার অভিঘাত ঠেলে গার্মেন্টসহ শিল্পের কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ও শিল্পের যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ, খাদ্যশস্য, চিনি, সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল সিমেন্ট ক্লিংকার, পাট ও পাটপণ্য আমদানি-রফতানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে ভোজ্যতেল, পেট্রোলিয়াম, সৌখিন ও ভোগ্যপণ্য আমদানি কমতির দিকে রয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে দেশের আমদানি-রফতানি কার্যক্রমের ৯২ শতাংশই সম্পন্ন হয়ে থাকে। সার্বিকভাবে দেশের প্রধান এই সমুদ্র বন্দর জাতীয় অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রেখে চরেছে। চট্টগ্রাম বন্দরভিত্তিক দেশের একক বৃহৎ রাজস্ব প্রতিষ্ঠান কাস্টম হাউসের শুল্ক-কর আদায় ছাড়াও ভ্যাট অ্যান্ড একসাইজ, কর-রাজস্ব, বন্দরের চার্জ-ডিউজ, বন্দর ব্যবহারকারীদের কর-রাজস্ব খাতে অবদান ইত্যাদি মিলিয়ে বার্ষিক কমপক্ষে এক লাখ কোটি টাকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ রাজস্ব জোগানদার বহুপাক্ষিক এই প্রতিষ্ঠান।
বৈশি^ক অবস্থানে ৬ ধাপ উন্নতি
প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় পরিচালনাধীন চট্টগ্রাম বন্দর ১৩৩ বছরে পড়ছে। ধাপে ধাপে এগিয়ে গেছে বন্দরের দক্ষতা, গতিশীলতা, সক্ষমতার সূচকগুলো। লন্ডনভিত্তিক পোর্ট-শিপিং বিষয়ক প্রাচীনতম বিশ^খ্যাত জার্নাল দ্য লয়েড’স লিস্ট মূল্যায়ণ ও জরিপে পৃথিবীর একশ’ সর্বাপেক্ষা কর্মচঞ্চল কন্টেইনার বন্দরের ২০১৯ সালের পারফরমেন্সের আলোকে গত ৩০ আগস্ট-২০২০ সালে প্রকাশিত সংস্করণে চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন অবস্থান ৫৮। এক বছরে ছয়টি ধাপ অতিক্রম কওে ৫৮তম অবস্থানে উন্নীত হয়েছে এ বন্দর। তাছাড়া নৌ-দস্যুতার হুমকিমুক্ত, শ্রম অসন্তোষমুক্ত এবং ব্যবস্থাপনায় উন্নতির সূচকে চট্টগ্রাম বন্দরের ইমেজ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদায়ী বছরে চট্টগ্রাম পোর্ট লিমিট কুতুবদিয়া অবধি বিস্তৃত হয়েছে।
বৈশি^ক সূচকের মাপকাঠিতে সর্বাপেক্ষা ব্যস্ত একশ’ কন্টেইনার-পোর্টের তালিকায় এক দশকের ব্যবধানে চট্টগ্রাম বন্দর বেশ দ্রæতই ৩০ ধাপ অতিক্রম করেছে। আন্তর্জাতিক পোর্ট-শিপিং সার্কেলে চট্টগ্রাম বন্দরের সাফল্য দেশের সুনাম বৃদ্ধি করেছে। গত ২০ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর উপদেষ্টা কমিটির ১৪তম সভায় নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি অদূর ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম বন্দরকে বিশে^র সর্বাধিক ব্যস্ত একশ’ কন্টেইনার-পোর্টের তালিকায় ৩০তম অবস্থানে উন্নীত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
দ্য লয়েড’স লিস্টের পর্যালোচনায় চট্টগ্রাম বন্দর ২০১৯ সালে ৩০ লাখ ৮৮ হাজার ১৮৭ টিইইউএস (২০ ফুট হিসাবে একক ইউনিট) কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করেছে। ২০১৮ সালে এর পরিমাণ ছিল ২৯ লাখ ৩ হাজার ৯৯৬ টিইইউএস।
এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির বার্ষিক হার ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। চট্টগ্রাম বন্দরে দেশের মোট কন্টেইনারের ৯৮ শতাংশ হ্যান্ডেল হয়। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পরিবাহিত পণ্যসামগ্রীর ২৮ শতাংশ হ্যান্ডেল হয় কন্টেইনারে। বাকি ৭২ শতাংশ খোলা মালামাল (ব্রেক বাল্ক কার্গো) সাধারণ জাহাজযোগে পরিবহন করা হয়। লয়েড’স লিস্টে চট্টগ্রাম বন্দর এক দশক আগে ২০১০ সালে ছিল ৮৮তম অবস্থানে।
৪৪ বছর আগে সাধারণ জাহাজযোগে মাত্র ৬টি কন্টেইনার হ্যান্ডলিং দিয়ে ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেইনার যুগে প্রবেশ। আজ বছরে ৩১ লাখ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হচ্ছে। কন্টেইনার শিপিংয়ে বৈদেশিক বাণিজ্য সময় ও ব্যয় সাশ্রয়ী। নিরাপদ, সুরক্ষিত, ঝামেলামুক্ত। তাই কন্টেইনার-নির্ভরতা বাড়ছেই। পেঁয়াজ-রসুন-আদা, ফলমূল থেকে শুরু করে খুচরা যন্ত্রাংশ, মেশিনারিজ ও যান্ত্রিক সরঞ্জাম, বিলাসবহুল গাড়ি, প্রযুক্তি ও সেবাপণ্য ইত্যাদি অধিকাংশই আসছে কন্টেইনারে।

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন