শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ইংরেজি নববর্ষ সংখ্যা

২০২০ সালের রাজনীতি অর্থনীতি স্বাস্থ্য ও বিদেশনীতি

মোবায়েদুর রহমান | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:১০ এএম

বর্ষ শেষের সালতামামি লিখতে গেলে যেসব বিষয় প্রাধান্য পায় সেগুলো হলো, রাজনীতি, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক প্রভৃতি। এ বছর সবক’টি বিষয়কে ছাপিয়ে যে বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে সেটি হলো করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯। তাই প্রথমেই করোনাভাইরাস দিয়ে শুরু করা যাক।
করোনাভাইরাসকে এবার আর মহামারি বা এপিডেমিক বলা হয়নি। বলা হয়েছে, প্যান্ডেমিক। এপিডেমিক বা মহামারি বলতে বোঝা যায় এক দেশে বা একটি অঞ্চলে মহামারি আকারে একটি রোগ ছড়িয়ে পড়া এবং অসংখ্য লোকের প্রাণহানি ঘটা। কিন্তু প্যান্ডেমিক হলো, এক দেশ বা এক মহাদেশের বা দুই একটি মহাদেশে ছড়িয়ে পড়া রোগ। কিন্তু এবারের করোনা ভাইরাস প্যান্ডেমিকের চেয়েও বেশি কিছু এবং ভয়াবহ। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নাই, যেখানে এই রোগটি মরণ ছোবল হানেনি। সকলেই এই সম্পর্কে গত এক বছর থেকে শুনে আসছেন। তাই এ সম্পর্কে আর কিছু বলবো না। তবে একটি বিষয়ে আমি তাজ্জব হয়েছি। পৃথিবীতে একটি মহাদেশ আছে, যার কথা খুব কমই আলোচিত হয়। সারা বছরই এই মহাদেশটি বরফে আচ্ছাদিত থাকে বলে মনুষ্যবসতি বলতে গেলে নাই। তারপরেও বৈরী প্রকৃতির সাথে লড়াই করে অত্যন্ত নগন্য সংখ্যক লোক এখানে বাস করেন। এই মহাদেশটির নাম এন্টার্কটিকা। সেই এন্টার্কটিকাতেও করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। আলাস্কা আমেরিকার একটি অঙ্গরাজ্য হলেও আমেরিকার মূল ভ‚খন্ড থেকে এটি আলাদা। সেখানেও করোনা আঘাত হেনেছে। এক বছর হলো পৃথিবীব্যাপী করোনার তান্ডব চলছে। কবে শেষ হবে, কেউ জানে না। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো, এটি আল্লাহতায়ালা দিয়েছেন। তখনই করোনা পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে, যখন আল্লাহতায়ালা এটিকে উঠিয়ে নেওয়ার বা মানুষের নিয়ন্ত্রণে রাখার সিদ্ধান্ত নেবেন।
এবার রাজনীতি প্রসঙ্গ। প্রথমে বাংলাদেশের রাজনীতি। সত্যি কথা বলতে কি বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে বলার মতো কিছু নাই। বিগত কয়েক বছর থেকে এটি একটি ওয়ান ওয়ে ট্রাফিক। ব্যাটিং চলছে একতরফা। সেই ব্যাটিং ইনিংসের যেন শেষ নাই। বাংলাদেশের রাজনীতির চরিত্র ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছিল দ্বিদলীয়। একদিকে আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে বিএনপি। এই দুটি দলকে ঘিরেই দুটি জোট গড়ে উঠেছিল। দুই জোটে দুটি বড় দল ছিল। বিএনপি জোটে জামায়াতে ইসলামী এবং আওয়ামী জোটে জাতীয় পার্টি। ২০১৫ সালে বিএনপি লাগাতার অবরোধ করে। অবরোধ প্রবল হলেও সরকার প্রচন্ড রাষ্ট্র শক্তি প্রয়োগ করে সেই আন্দোলন বানচাল করে। এরপর দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের অন্যতম দল বিএনপি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট বয়কট করে। তারপরেও শাসক দল ফাঁকা মাঠে গোল করে। এ নির্বাচনে জনগণ তেমন একটা অংশগ্রহণ করে নাই। নির্বাচন কমিশন তথা হুদা কমিশন যদিও বলেছে, ঐ নির্বাচনে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে, কিন্তু শিক্ষিত অশিক্ষিত কেউই সেই কথা বিশ্বাস করেনি। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, ঐ নির্বাচনে ১৫ শতাংশের ওপরে ভোট পড়েনি। ১৫ শতাংশের ভোট কখনো জনমতের প্রতিফলন হতে পারে না। এই এক তরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে দেশে এবং বিদেশে প্রবল ও শক্তিশালী প্রতিবাদ উত্থিত হয়। এক পর্যায়ে সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, এটি ছিল নিয়ম রক্ষার অর্থাৎ সংবিধান রক্ষার নির্বাচন। তাই শীঘ্রই আরেকটি নির্বাচন দেওয়া হবে। কিন্তু সেই নির্বাচন আর দেওয়া হয়নি, বিরোধী দলসমূহও সরকারের নিকট থেকে নির্বাচন আদায় করে নিতে পারেনি। তারপর থেকেই প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বলতে গেলে হাইবারনেশনে যায়। সরকারও চালায় প্রচন্ড দমন নীতি। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়, অসংখ্য নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয়। ফলে বিরোধী দলসমূহের অসংখ্য নেতাকর্মী বছরের পর বছর ফেরারী হয়ে থাকেন। এই অবস্থায় বিরোধী দল, বিশেষ করে বিএনপির রাজনীতি সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠান এবং বিবৃতি জারি করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এর ফাঁকে ফাঁকেও তারা মাঠে নামতে চাইলে পুলিশ তাদেরকে বের হতে দেয়নি। অতীতের মিছিল এবং জনসভা খর্বাকৃতি হতে হতে মানববন্ধনে এসে ঠেকে।
এভাবেই রাজনীতি এক তরফা হতে থাকে। মাঠে শুধু খেলতে থাকে সরকারি দল। তবে এর ফাঁকেও দেখা যায় যে এরশাদের জাতীয় পার্টি সভা করতে চাইলে করতে পেরেছে। আর সিপিবি বা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে কোনো সময় মিছিল করতে দেওয়া হয়েছে, আবার কোনো সময় দেওয়া হয়নি। বিএনপি ছাড়া অপর প্রধান বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী এবং ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির ঘর থেকে বের হতে পারেনি।
এভাবেই দিন গড়াতে থাকে এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন এসে পড়ে। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনে বিএনপির প্রধান সঙ্গী ছিলো জামায়াতে ইসলামী। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করে। এবার বিএনপি জোটের পরিধি বাড়ায়। ২০ দলের বাইরেও আরেকটি জোট করে। বেগম জিয়া কারাগারে থাকায় মাঠের রাজনীতিতে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ এবং জনগণের সাথে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন ড. কামাল হোসেনকে ঐক্য ফ্রন্টের অর্থাৎ বিএনপিরও নেতা মানা হয়। ঐ ঐক্য ফ্রন্টের অধীনেই আনা হয় ২০ দলীয় জোটকে। যাই হোক, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর যে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল সেই নির্বাচনের ৫০ শতাংশেরও বেশি ভোট আগের দিন অর্থাৎ ২৯ ডিসেম্বরের রাতেই দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এই নির্বাচনে বিরোধী দলের কপালে জোটে ৬টি আসন। এক দিন পরেই নতুন বছর অর্থাৎ ২০১৯ সাল। ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনের পর সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করে যে, দিনের ভোট রাতে হয়েছে। তাই তারা নির্বাচন মানে না, এই পার্লামেন্ট মানে না এবং ভবিষৎে যে সরকার গঠিত হবে সেটিও তারা মানে না।
ঐক্যফ্রন্টের এই অবস্থানের পর জনগণ প্রত্যাশা করেছিল যে, ঐ নির্বাচনের বিরুদ্ধে তারা দুর্বার গণ আন্দোলন গড়ে তুলবেন। সেই উদ্দেশ্যে তাৎক্ষণিকভাবে ২/৩ দিনের লাগাতার হরতাল দেবেন। কিন্তু এসবের কিছুই হলো না। ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির ৬/৭ জন এমপি শপথ গ্রহণ করলেন এবং নব গঠিত পার্লামেন্ট এবং আওয়ামী লীগের চতুর্থ মেয়াদের সরকারকে বৈধতা দিলেন। রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তার বিবরে চলে গেল বিএনপি। রাজনৈতিক মাঠ থেকে সরে গেল জামায়াতে ইসলামী। সরে গিয়ে তারা দাওয়াতী কার্যক্রমে নিজেদেরকে নিয়োজিত করলো।
তারপর এসে গেল ২০১৯ সাল। রাজনৈতিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটল না। এসে গেল ২০২০ সাল। ২০২০ সালের শেষে এসে যখন পেছনে তাকাই, তখন দেখি রাজনীতির ভয়াবহ অবস্থা। এরমধ্যে অনেকগুলো উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়েছে। জনগণ নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আমাদের হাতে যথেষ্ট পরিসংখ্যান আছে। এমনও দেখা গেছে যে, কোনো উপনির্বাচনে ভোট পড়েছে ১০ শতাংশেরও কম। এটি একটি ভয়াবহ অবস্থা। রাজনীতির বিরাজনীতিকরণ হয়েছে। এটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য ভয়াবহ অশনি সংকেত। কর্তৃত্ববাদ (Authoritarianism)) এবং একচ্ছত্রবাদ (Totalitarianism) ব্যক্তি বা দলকে বছরের পর বছর ক্ষমতায় রাখে। কিন্তু দিন শেষে (At the end of the day) দেখা যায়, নৈরাজ্যবাদের ভয়াবহ উত্থান। ২০২১ সালেও বহুত্ববাদের (Pluralism) উদ্ভব বা বিকাশের কোনো সম্ভাবনা বা পূর্বাভাস নাই।
২০২০ সালের করোনাভাইরাস সমস্ত মানুষের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত শুধুমাত্র দুর্বলই নয়, এটি রীতিমত ভেঙ্গে পড়েছে। প্রাণঘাতি রোগ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অর্থ হচ্ছে মানুষের প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। এই ছিনিমিনি খেলায় আমরা দেখেছি সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহায়তায় রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক শাহেদ করিম, জেকেজির ডা. সাবরিনা এবং আওয়ামী লীগের শারমিন জাহানের ভয়াবহ দুর্নীতি। করোনা টেস্টের নামে ১৫৪৬০টি ভূয়া টেস্ট এবং ভূয়া রিপোর্ট বিবেক সম্পন্ন কোনো মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের যোগসাযশে সেই অপকর্মটিও তারা করেছে। ওরা এন-৯৫ মাস্ক এবং পিপিই নিয়েও ছিনিমিনি খেলেছে। সবচেয়ে বড় জালিয়াত শাহেদ করিমকে ছবিতে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতা ও মন্ত্রীর সাথেও দেখা গেছে।
২০২০ সালের অর্থনীতি করোনার কশাঘাতে বিপর্যস্ত হয়েছে। বছরের মধ্যভাগ থেকে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেও বোধগম্য কারণে পূর্বের সেই গতি এখনো ফিরে পায়নি। ইতিপূর্বে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গেলেও ধন বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে প্রকটভাবে। জিনি কো-এফিসিয়েন্ট বলে একটি কথা আছে। এটি যত বেশি হবে ততই ধনী আরো ধনী হবে এবং গরিব আরো গরিব হবে। বিপরীতে জিনি কো-এফিসিয়েন্ট যত কম হবে ততই ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ধন বৈষম্যের ফারাক কম হবে। দক্ষিণ এশিয়ার ৭টি দেশ এবং আফগানিস্তানসহ মোট ৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের জিনি কো-এফিসিয়েন্ট সবচেয়ে বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিজের অধ্যাপক ড. রাশেদ আল তিতুমীর বলেন, তিনটি কারণে বাংলাদেশে ধন বৈষম্য উৎকট আকার ধারণ করেছে। এগুলো হলো (১) লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার, (২) লক্ষ কোটি টাকার ঋণ খেলাপ এবং (৩) ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লক্ষ কোটি টাকার লুটপাট, দুর্নীতি ও আত্মসাৎ। তার মতে, এই দুর্নীতি ও লুটপাট মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নস্যাৎ করেছে।
বিদেশনীতির কথা বললে আমেরিকা রাশিয়াসহ অনেক দেশই এসে যায়। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ধারণা বা Public perception হলো এই যে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি হলো Indo Centric বা ভারতকেন্দ্রিক বা ভারতনির্ভর। তবে ২০১৬ সাল থেকেই চীন আমাদের পররাষ্ট্রনীতির দরজায় করাঘাত করছিল। ২০২০ সালে দেখা যাচ্ছে, সে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ থেকে যে বছর শুরু হলো সেই বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে দেখা যাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে চীন কতখানি উবহঃ করলো বা কতখানি প্রভাব বিস্তার করতে পারলো।
journalist15@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন