শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইংরেজি নববর্ষ সংখ্যা

করোনায় মানবিকতার জয়

ইশরাত মাহমুদ ডানা | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০৯ এএম

প্রকৃতির প্রতিটি জড় এবং জৈব সত্তা একে অপরের সাথে যে কতটা ওৎপ্রোতভাবে জড়িত এবং পরস্পরের প্রতি যে কতটা নির্ভরশীল, তা করোনা মহামারি হানা দেয়ার আগে এত তীব্রভাবে অনুভূত হয়নি। অত্যন্ত ছোঁয়াচে ও প্রাণঘাতী অদৃশ্য এ জীবাণুর কাছে ধনী-গরিব, ধর্ম, বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে সবাই সমান। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা সেবা বা চিকিৎসাহীন দুর্গম অঞ্চল কোনোটাই রুখতে পারছে না করোনাকে। কোভিড-১৯’র ভ্যাকসিন বের হতে না হতেই হামলা চালিয়েছে কোভিড-২০। একটি অদৃশ্য জীবাণুর কাছে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের এ অসহায়ত্ব তার স্বজাতির প্রতি মমত্ববোধকে গভীর করে তুলেছে। মানুষের অগ্রাধিকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে, দৃষ্টিভঙ্গিতে, জীবনবোধে ও উপলব্ধিতে এসেছে সূ² পরিবর্তন।
করোনা মহামারিতে কেউ চরম স্বার্থপরতা নিয়ে অমানবিক হয়ে উঠেছেন, কেউ পরিস্থিতির ফায়দা লুটে কোটিপতি হচ্ছেন, আবার অনেকে নিজের সমস্ত উপার্জন নিয়ে নিঃস্বার্থভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। করোনা জাগিয়ে তুলেছে প্রায় মৃত মানবিকতা। দুঃখক্লিষ্ট অবস্থায় আতঙ্ক আর মৃত্যুভয় সত্তে¡ও বহু মানুষ মানবতা আর সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তারকা চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, শিল্পী, সাহিত্যিক ও খেলোয়াড়সহ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিশ^জুড়ে অপরের সাহায্যে পথে নেমেছে মানুষ। নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী সমাজসেবায় ব্রতী হয়েছেন তারা। তাই গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করোনার বিধ্বংসী রূপের পাশাপাশি বছর জুড়ে করোনার ইতিবাচক প্রভাবগুলোর আলোচনাও আবশ্যক হয়ে উঠেছে।
করোনা প্রাদুর্ভাবে বিশ্বের দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের অবস্থা এখন শোচনীয়। অসহায়, দরিদ্র মানুষকে বিনামূল্যে খাদ্য, চিকিৎসাসেবা, ওষুধ ও চিকিৎসা উপকরণ এবং নগদ অর্থ বিতরণ করতে প্রকাশ্যে ও নেপথ্যে রাতদিন কাজ করে যাচ্ছেন দেশ বিদেশের অসংখ্য বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি। অনেকে জীবাণুনাশক ছাড়াও মাস্ক-পিপিই তৈরি ও বিতরণ করছেন। অনেকে এসব সাহায্য প্রয়োজনীয় মুহূর্তে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছেন। কেউ কেউ এককালীন সাহায্য দিচ্ছেন। কারও কারও সহযোগিতা এখনও চলছে। দেশে বিদেশে নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাবের মধ্যেই করোনার বিরুদ্ধে এক অসম লড়াইয়ে নামতে হয়েছে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদেরও। শুধুমাত্র পেশা নয়, মানবিকতার স্বার্থে অন্যের জীবন বাঁচানোর ব্রতী হয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে তাদের অনেককেই। অনেকে বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে অক্লান্তভাবে চিকিৎসা ও সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। হলিউড-বলিউডসহ বিশে^র বিভিন্ন অঙ্গনের তারকাদের মতো বাংলাদেশের অনেক তারাকা বছর জুড়ে চেষ্টা করেছেন নিম্নবিত্ত ও অসহাদের পাশে দাঁড়াতে। বিশ^জুড়ে লাখো-কোটি পরিবারের সাহায্যে সামিল হয়ে মেলে ধরেছেন তাদের মানবসত্ত্বা।
করোনালকডাউনে কিছু পারিবারিক সহিংসতার খবর আসলেও পরিবারগুলোর বেশিরভাগের মধ্যে পরস্পরকে কাজে সহায়তা করার এবং কঠিন পরিস্থিতিতে একে অপরের পাশে থাকার মতো উল্লেখযোগ্য গুণাবলীর বিকাশ ঘটেছে। লকডাউনের কারণে মানুষ দীর্ঘ একটা সময় ঘরে থাকতে বাধ্য হয়েছে। এ সময় বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রী ও অন্যান্য পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক গভীরতর হয়েছে। লকডাউনে বাড়ীতে আটকে পড়াদের হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকায় অনেকেই বাসার ছাদে বা বারান্দায় বাগান করছেন, যা একদিকে প্রাত্যহিক শাকসবজির চাহিদা মেটাতে কাজে আসছে, অন্যদিকে করোনাকালে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়িয়ে তুলছে।
করোনার অবসরে সাংসারিক কাজ, সাহিত্য, শিল্প ও সাংস্কৃতিক চর্চ্চা, অনলাইনে নতুন ও গঠনমূলক কিছু শেখার বা শেয়ার করার আগ্রহ মানুষের সৃষ্টিশীলতা ও ধৈর্যেরও প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। লকডাউনের নির্মম বাস্ততার মধ্যেও মানুষ দেখিয়েছে মননশীলতার দ্যুতি। ফ্রান্স, ইটালিসহ, স্পেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ঘরবন্দি মানুষেরা নিজেদের এবং অন্যদের বিনোদিত করতে ব্যালকনিতেই জমিয়ে ফেলেছেন কনসার্ট, নাচ বা চিত্রাঙ্কন। নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষকে অনলাইনে বিভিন্নভাবে বিনোদন দেয়ার চেষ্টা করেছেন করোনাকালে সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠা কিছু মানুষ এবং প্রখ্যাত তারকারাও। তাদের প্রতি নানানভাবে ভালোবাসা জানাতে ভুলছে না কৃতজ্ঞরা।
করোনার মৃত্যু-খগ্ড় মানুষকে রুখতে পারেনি তার শ্রেষ্ঠ গুণ-মানবিকতার প্রকাশকে। যৌনপল্লী থেকে শুরু করে রাস্তার ভিক্ষুক পর্যন্ত মানুষ শুধুমাত্র মানুষের জন্যই নয়, মানুষ দাঁড়িয়েছে রাস্তার কুকুর-বিড়ালসহ বিভিন্ন অভুক্ত প্রাণীর পাশেও। জীবন বাঁচানোর তাগিদে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ লকডাউন হয়ে আছে। উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেঁচে থাকা পথের পশু-পাখিরা চরম খাদ্য সঙ্কটে পড়েছে। দেশ-বিদেশে বিভিন্ন স্থানে কুকুর, বিড়াল, কাক বা ক্ষুধার তাড়নায় বন থেকে বেরিয়ে আসা পশুপাখিদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানবিক সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বহু মানুষ। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ ২০২০ সালে করোনা মহামারিতে লাখ লাখ অনাকাক্সিক্ষত করুণ মৃত্যু, নানান ঘটনা-দুর্ঘটনা এবং চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে একথাটাই জোড়ালোভাবে বার বার প্রমাণ করেছে মানুষ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন