শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বিনিয়োগকারীদের ঘুরে দাঁড়ানোর বছর

ফিরে দেখা ২০২০

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০৮ এএম

বিদায়ী বছরের শুরুটা মোটেও ভালো ছিল না দেশের শেয়ারবাজারের জন্য। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও তারল্য সঙ্কটে ভুগতে থাকা শেয়ারবাজার মহামারি করোনাভাইরাসের ছোবলে গভীর সঙ্কটে তলিয়ে যায়। পুঁজি হারানোর শঙ্কায় ভুগতে থাকেন বিনিয়োগকারীরা। তবে বছরের শেষটা শুরুর মতো হয়নি। বরং হতাশা ভুলে মুখে হাসি নিয়েই ২০২০ সাল শেষ করেছেন পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা।

দীর্ঘ মন্দা কাটিয়ে করোনাভাইরাসের প্রকোপের মধ্যেই সুদিন ফিরেছে দেশের শেয়ারবাজারে। শুধু সুদিন বললে হয় তো ভুল হবে। বছরের শেষ দিকে দেশের শেয়ারবাজার এতটাই ভালো অবস্থানে রয়েছে, ২০১০ সালের মহাধসের পর এতটা ভালো অবস্থানে আর দেখা যায়নি। যে কারণে পুঁজি হারানোর আতঙ্ক ভুলে বছরের শেষার্ধে মুনাফা তুলে নিতেই ব্যস্ত ছিলেন বিনিয়োগকারীরা। নতুন স্বপ্ন নিয়ে বাজারে ছুটে এসেছেন লাখের অধিক নতুন বিনিয়োগকারী। সূচক, লেনদেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা সবকিছু মিলে ফুরফুরে অবস্থায় ২০২০ সাল শেষ করেছে শেয়ারবাজার। শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নতুন চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের নেতৃত্বে বর্তমান কমিশন শেয়ারবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে এসেছে। এরই সুফল শেয়ারবাজারে দেখা যাচ্ছে। আগামীতে বিনিয়োগকারীদের এ আস্থা ধরে রাখাই শেয়ারবাজারের জন্য সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, দীর্ঘদিন ধরে ধুঁকতে থাকা শেয়ারবাজারে মহামারি করোনাভাইরাস আতঙ্কে গত মার্চে বড় ধরনের ধস নামে। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় টানা ৬৬ দিন বন্ধ রাখা হয় শেয়ারবাজারের লেনদেন। এর মধ্যেই বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম। তার সঙ্গে কমিশনার হিসেবে যোগ দেন আরও তিনজন। নতুন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর শেয়ারবাজারে লেনদেন চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়। এতে টানা ৬৬ দিন বন্ধ থাকার পর ৩১ মে থেকে শেয়ারবাজারে আবার লেনদেন চালু হয়।

নতুন নেতৃত্বের অধীনে শেয়ারবাজারে লেনদেন চালু হলেও অব্যাহত থাকে লেনদেন খরা। তবে জুলাই মাসে এসে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে কড় বার্তা দেয় নতুন কমিশন। অনিয়মে জড়িত থাকায় একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বড় অঙ্কের জরিমানা করা হয়। সতর্ক করা হয় সরকারি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি)। বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসকে জরিমানার পাশাপাশি সতর্ক করা হয়। পরে আইসিবিকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। বাতিল করা হয় এক ডজন দুর্বল কোম্পানির আইপিও। নিয়ন্ত্রক সংস্থার একের পর এক পদক্ষেপের ফলে ঘুরে দাঁড়ায় শেয়ারবাজার। ৫০ কোটি টাকার নিচে নেমে যাওয়া লেনদেন এখন হাজার কোটি টাকার আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে।

বছরের শেষটা শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের জন্য আলো ঝলমলে হলেও শুরুটা মোটেও ভালো ছিল না। ৪৪৫২ পয়েন্ট নিয়ে নতুন বছরে পদার্পণ করা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স জানুয়ারি মাসের অর্ধেক পার না হতেই চারশ পয়েন্টের ওপরে হারিয়ে বসে। ১৪ জানুয়ারি সূচকটি নেমে আসে ৪০৩৬ পয়েন্টে। লেনদেন হতে থাকে দুশ থেকে তিনশ কোটি টাকার মধ্যে।

এরপর সূচক কিছুটা বাড়লেও মার্চে এসে ছোবল মারে মহামারি করোনাভাইরাস। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই করোনার শুরুর ছোবল শেয়ারবাজারের জন্য এতটাই ভয়াবহ ছিল একদিনেই ডিএসইর প্রধান সূচক প্রায় তিনশ পয়েন্ট পড়ে যায়। মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাংলাদেশে শুরু হয় বিদায়ী বছরের ৮ মার্চ। ওইদিন বাংলাদেশে প্রথম তিনজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য প্রকাশ পায়। এর প্রভাবে ৯ মার্চ শেয়ারবাজারে ভয়াবহ ধস নামে। ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স একদিনে রেকর্ড ২৭৯ পয়েন্ট পড়ে যায়। এরপর দফায় দফায় দরপতন হতে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ১৯ মার্চ থেকে শেয়ারবাজারে লেনদেনের সময় এক ঘণ্টা কমিয়ে আনা হয়।

এর পরও পতন ঠেকানো না গেলে প্রতিটি কোম্পানির শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস (দামের সর্বনি¤œ সীমা) নির্ধারণ করে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। এর মাধ্যমে শেয়ারবাজারের পতন কিছুটা হলেও থামানো যায়। তার পরও টানা ৬৬ দিনের বন্ধ শুরু হওয়ার আগে ডিএসইর প্রধান সূচক ৪০০৮ পয়েন্টে নেমে আসে। ৬৬ দিন বন্ধ থাকার পর ৩১ মে শেয়ারবাজারে আবার লেনদেন শুরু হলেও চলতে থাকে দরপতন। এতে ডিএসইর প্রধান সূচক চার হাজার পয়েন্টের মনোস্তাত্তি¡ক ভিত্তির নিচে নেমে আসে। লেনদেন কমে চলে আসে ৬০ কোটি টাকার ঘরে।

বিএসইসির বর্তমান চেয়ারম্যান যখন দায়িত্ব নেন তখন ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ছিল ৪০০৮ পয়েন্টে। গত সোমবার (২১ ডিসেম্বর) লেনদেন শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১১৫ পয়েন্টে। অর্থাৎ নতুন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর ডিএসইর প্রধান সূচক বেড়েছে ১০০৭ পয়েন্ট। অপরদিকে ৬০ কোটি টাকার ঘরে নেমে যাওয়া লেনদেন উঠে এসেছে হাজার কোটি টাকার ওপরে।

এদিকে, বছরের শুরুতে পুঁজি হারানোর শঙ্কায় ভুগলেও বছরের শেষ দিকে বিনিয়াগকারীদের মুখে হাসি ফুটেছে। হতাশায় নিমজ্জিত যে বিনিয়োগকারীরা লোকসানে শেয়ার বিক্রি করে পুঁজিবাজার ছাড়ার পথ খুঁজছিলেন, সেই বিনিয়োগকারীই এখন মুনাফা তুলে নিচ্ছেন। ফলে ব্রোকারেজ হাউজবিমুখ হয় পড়া অনেক বিনিয়োগকারী আবার মতিঝিলের ব্রোকারেজ হাউজগুলোতে যাওয়া শুরু করেছেন।

শুধু পুরোনো বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারমুখী হয়েছেন তা নয়, প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে আসছেন। সিডিবিএল’র তথ্য অনুযায়ী, বিনিয়োগকারীদের ২৫ লাখ ৭৮ হাজার ১০২টি বিও হিসাব নিয়ে ২০২০ সালে পা রাখে শেয়ারবাজার। ভয়াবহ ধস নামায় ৩ আগস্ট সেই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ২২ লাখ ৯৯ হাজার ১৪০টিতে। অর্থাৎ বছরের প্রথম সাত মাসেই প্রায় তিন লাখ বিনিয়োগকারী হারায় শেয়ারবাজার।

দীর্ঘ মন্দা কাটিয়ে শেয়ারবাজারে আবার সুদিন ফেরায় নতুন নতুন বিনিয়োগকারী আসা শুরু হয়েছে। এতে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৪৮টি। অর্থাৎ গত সাড়ে চার মাসে ২ লাখ ৩৭ হাজার ২০৮ নতুন বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজারে এসেছেন। এর মধ্যে ডিসেম্বরের ২০ দিনেই বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব বেড়েছে ২৭ হাজার ৪৫৬টি।

অন্যদিকে, ২০২০ সালে লেনদেন শুরুর আগে ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা। করোনার প্রকোপে ভয়াবহ ধস নামলে ১৮ মার্চ তা ২ লাখ ৮৭ হাজার ৩৮২ কোটি টাকায় নেমে আসে। সংকট কাটিয়ে বছরের শেষার্ধে শেয়ারবাজার ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফেরায় ২১ ডিসেম্বর লেনদেন শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ১৫ হাজার ৬২ কোটি টাকায়। এ হিসাবে গত ৯ মাসে ডিএসইর বাজার মূলধন বেড়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। বাজার মূলধন হলো তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিটের সম্মিলিত দাম।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন