শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

মিয়ানমার : সু চির যাত্রা কি নির্বিঘœ হবে?

প্রকাশের সময় : ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা : মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার শুভ সূচনা হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। প্রায় ৫ দশকের সেনাশাসনের অবসান ঘটিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের জন্য নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে গত ১ ফেব্রুয়ারি পার্লামেন্ট অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন মিয়ানমারের অবিসংবাদিত নেত্রী অং সান সু চি। নভেম্বরে জাতীয় নির্বাচনে সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ৮০ শতাংশ আসনে জয়লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে যা এনএলডির ভূমিধস বিজয় হিসেবেই মনে করা হয়। কিন্তু সংবিধানিক মারপ্যাঁচে ক্ষমতাটা তবুও নিরঙ্কুশ হয়নি সংগ্রামী এই নেত্রীর। কারণ তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী দলের নেত্রী হলেও মিয়ানমারের রাষ্ট্রপতি পদ অলঙ্কৃত করতে পারছেন না। মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী কোন বিদেশীকে বিয়ে করলে বা কারো সন্তান-সন্ততি বিদেশী নাগরিক হলে তিনি রাষ্ট্রপতি হওয়ার অযোগ্য বিবেচিত হন। সিনহুয়া জানিয়েছে, সু চি তার দলের নির্বাচিত সাংসদদের সাথে নিয়ে পার্লামেন্ট অধিবেশনে যখন যোগ দেন তখন পার্লামেন্টে এক আনন্দঘন ও উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মূলত সু চির এই বিজয়কে গণতান্ত্রিক মিয়ানমারের নবযাত্রা বলেই মনে করছে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহল। প্রথম অধিবেশনে নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের স্পিকার নির্বাচিত করেছে এনএলডি নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্যরা। পাথিয়েন এলাকার এনএলডির পার্লামেন্ট সদস্য ইউ উইন মিন্টকে স্পিকার হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে। আর ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হয়েছেন সামরিক জান্তা সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (ইউএসডিপি) ইউ টি খুন মিত। বিষয়টিকে যদিও ইতিবাচক হিসেবেই দেখা হচ্ছে কিন্তু শঙ্কাটা একেবারে কেটে যায়নি বলেই মনে হচ্ছে।
মিয়ানমারের বিদায়ী পার্লামেন্টের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ৩০ জানুয়ারি। তার মাত্র দুদিন পর ১ ফেব্রুয়ারি সকালে নবনির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে প্রথম অধিবেশন শুরু হয় যা মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। নতুন সংসদের প্রথম অধিবেশনে পার্লামেন্টের ৪৩০ জন সদস্যই উপস্থিত ছিলেন। নতুন পার্লামেন্টের স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার পর এখন প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রাধিকারমূলক কাজ হলো একজন নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা। যিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় নির্বাহী ক্ষমতার চর্চা করবেন। বিষয়টি নিয়ে সাংবিধানিক জটিলতা দেখা দিয়েছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন আগামী মার্চ মাসের শেষে পদত্যাগ করবেন বল ধারণা করা হচ্ছে। বিজয়ী দলের প্রধান হওয়া সত্ত্বেও সু চির প্রেসিডেন্ট হওয়ার ক্ষেত্রে সাংবিধানিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। সু চির সন্তান ও স্বামী বিদেশি নাগরিক হওয়ার কারণেই তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারছেন না। তবে নির্বাচনের আগে এক বক্তৃতায় সু চি বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হতে না পারলেও তিনি প্রেসিডেন্টের ওপরেই থাকবেন। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত সে দিকেই গড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে।
মিয়ানমারের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হতে পারেন তা নিয়ে ব্যাপক জল্পনাকল্পনা চলছে। সু চির ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয়ের বরাত দিয়ে স্থানীয় একটি সংবাদমাধ্যম বলেছে, এনএলডির একজন সিনিয়র নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু নারী নেত্রী টিন মার অং বা অশীতিপর সাবেক সেনা প্রধান ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল (অব) উ থিন ও অথবা সু চির ব্যক্তিগত চিকিৎসক প্রেসিডেন্ট পদ অলঙ্কৃত করতে পারেন। সেনাবাহিনীর সাথে একটা আপসরফা করে সংবিধানে সংশোধনী এনে সু চির প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভবনাটাও একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না পর্যবেক্ষক মহল। তবে সে ক্ষেত্রে সু চিকে সেনাবাহনীকে বড় ধরনের ছাড় দিতে হবে। অবশ্য সে সম্ভাবনাটা খুবই ক্ষীণ। বিষয়টির যবনিকাটা কীভাবে হয় তা দেখার জন্য অপেক্ষাই করতে হবে বৈ-কী!
১৯৬৮ সালে তৎকালীন গণতান্ত্রিক সরকারকে সরিয়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণের পরে আবারো গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসছে মিয়ানমার। সবকিছু ঠিক থাকলে এ বছরের এপ্রিলে গণতান্ত্রিক সরকার সু চির নেতৃত্বে তাদের যাত্রা শুরু করবে। অর্ধ শতকেরও বেশি সময়ের সামরিক শাসনের পর বহুল প্রতীক্ষিত একটি গণতান্ত্রিক কাঠামোয় যাত্রা শুরু হলো মিয়ানমারের। এনএলডির এমপি ইউ মিন ও বলেন, ‘আমি এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হলাম। কিন্তু এবারের বিষয়টা আলাদা, কারণ এবারের পার্লামেন্টে এনএলডির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। কিন্তু আমরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে এসেছি এবং আমরা বৈচিত্র্যের নিশ্চয়তা দিচ্ছি। ৬৬৪ আসনের পার্লামেন্টে মোট নির্বাচিত এমপির সংখ্যা ৪৯১। এর মধ্যে সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) থেকে নির্বাচিত হয়েছেন ৩৯০ জন। সু চির দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও দেশটির পার্লামেন্টে সেনাবাহিনীর প্রভাব থাকছে। কারণ তাদের জন্য ১৬৬টি আসন সংরক্ষিত রয়েছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও থাকছে তাদের হাতে।
নতুন সরকারকে অনেক চ্যালেঞ্জই মোকাবেলা করতে হবে। দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে গতিশীল করে নাগরিকদের জীবনমান উন্নত করায় হবে নতুন সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সামরিক জান্তার সরকারের সময় মিয়ানমার কূটনীতিতে অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে। তাই নতুন সরকারকে তা অবশ্যই পুনরুদ্ধার করতে হবে এবং পররাষ্ট্রনীতিতে আমূল পরিবর্তন আনা খুবই জরুরি। জাতীয় প্রতিরক্ষা ও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণেও জোরালো কাজ করতে হবে নতুন সরকারকে। মিয়ানমানে জাতিগত সমস্যাটাও বেশ প্রবল। দেশটি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও উপজাতীয়দের বসবাস রয়েছে সেখানে। জাতিগত সমস্যাও সেখানে বেশ প্রকট। যেহেতু সু চির দল পার্লামেন্টে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে তাই জনগণের আবেগ-অনুভূতিকে সম্মান এবং জাতিগোষ্ঠীর মতামতকে হিসাবে নিয়েই নতুন সরকারকে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। সু চির পক্ষে আর কোন বিকল্প পথ খোলা আছে বলে মনে হয় না।
নতুন সরকারের সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেবে রোহিঙ্গা মুসলিম সমস্যা। সামরিক জান্তা ও উগ্রবাদী বৌদ্ধরা যে কোন মূল্যে মিয়ানমারকে মুসলিমশূন্য করতে বদ্ধপরিকর। বিগত নির্বাচনে মুসলিম প্রার্থীদের বিভিন্ন অজুহাতে নির্বাচনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এমনকি উগ্রবাদীদের হাতে রাখতেই সু চির দল এনএলডিও নির্বাচনে মুসলিম প্রার্থী দেয়নি যা সু চিকে অনেকটাই বিতর্কিতও করেছে। এমনকি শান্তিতে নোবেল বিজয়ের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিষয়টি মাথায় রেখেই তাকে আগামী দিনের করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। সু চির এনএলডি পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের পর রোহিঙ্গা মুসলমানরা কিছুটা হলেও আশায় বুক বেঁধেছে। তারা মনে করছে, নতুন সরকার সামরিক জান্তার মত মুসলমানদের ওপর নিষ্ঠুর আচরণ হয়তো করবে না। হয়তো নতুন সরকার মুসলমানদের জন্য মন্দের ভাল হিসেবে অবির্ভূত হবে এবং মুসলমানরা আগের চেয়ে কিছুটা হলেও সুবিধাবোধ করবে। মূলত মিয়ানমানের সকল জাতিগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করাই হচ্ছে এনএলডির প্রধান চ্যালেঞ্চ। তবে আপাতত সু চির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দলের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ ও নিষ্কণ্টক করা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন