শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

অগ্নিকান্ড বাড়লেও বাড়েনি সচেতনতা

গত বছরে দেশে ১৮১০৪টি অগ্নিকান্ডে ১শ’৫৯ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ৫ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

রাজধানীসহ সারাদেশেই অগ্নিকান্ডের ঘটনা বাড়লেও বাড়েনি জনসচেতনতা। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা যেমন-ফায়ার সার্ভিস, রাজউক, সিটি করপোরেশন আবাসিক-বাণিজ্যিক ভবনসহ কল-কারখানাগুলোতে যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিশ্চিতে সঠিক নজরদারি করতে পারছে না, বা করছে না। আর এ কারণে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়েই চলছে। ২০২০ সালে সারাদেশে ১৮ হাজার ১০৪টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে মারা গেছে ২ হাজার ১৩৮ জন। আহত হয়েছে ১৪ হাজার ৯৩২ জন। তবে রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ অগ্নিকান্ডের ঘটনার সূত্রপাতের পেছনে মানুষের অসচেতনতা, ঘনবসতি, অপরিকল্পিত নগরায়নকে দায়ী করেছেন নগরপরিকল্পনাবিদরা। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে এ সব তথ্য পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, গত বছর অগ্নিকান্ডে ১৫৯ কোটি, ২৫ লাখ, ৪৩ হাজার, ৩৪১ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অগ্নিকান্ডের ঘটনা কমিয়ে আনতে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষে বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দিলেও তা মানছে না। ফলে অগ্নিকান্ডের ঘটনা কমছেই না।
ফায়ার সার্ভিসের সংশ্লিষ্টরা জানায়, দেশের আট বিভাগের মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি অগ্নিকান্ড ঘটে। আর সবচেয়ে কম অগ্নিকান্ড সিলেট বিভাগে। নতুন গঠিত ময়মনসিংহ বিভাগেও অগ্নিকান্ডের সংখ্যা সিলেটের চেয়ে বেশি। ঢাকায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা বেশি, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বেশি। ঢাকায় ঘনবসতি ও অলিগলিতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ করতে না পারায় ঢাকায় ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। ব্যবসায়িক এলাকা পুরনো ঢাকায় সড়কগুলো একেবারেই সরু। কোনো সড়কেই দুটি গাড়ি পাশ কাটানোর জায়গা নেই। পুরনো ঢাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এখন অগ্নিকান্ডের সময়ে ফায়ার সার্ভিসের পানিবাহী গাড়ি প্রবেশে সমস্যায় পড়ছে। দেশের বহুতল ভবন ও কল-কারখানাসহ বাণিজ্যিক ভবনগুলোর প্রায় ৯০ ভাগেই অগ্নিনির্বাপণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। বেশির ভাগ ভবন পুরনো, তাই বর্তমানে সেগুলোতে প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা সংযোজন করাও কঠিন। তাছাড়া অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলেও আগুনের ঘটনা বাড়ছে।
নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, সারা দেশের তুলনায় ঢাকায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা বেশি ঘটছে। আর এই অগ্নিকান্ডের পেছনে মূল তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথমত মানুষের অসচেতনতা, দ্বিতীয়ত ঘনবসতি এবং তৃতীয় অপরিকল্পিত নগরায়ণ। দেখা গেছে, মানুষ অসচেতনভাবে গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখছেন কিংবা বৈদ্যুতিক সংযোগে দুর্বল তার ব্যবহার করায় অগ্নিকান্ডের ঘটছে।
তিনি আরো বলেন, ঢাকায় কিভাবে অগ্নিকান্ড কমিয়ে আনা যায় সেই বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিটি করপোরেশন যৌথভাবে কাজ করছে। তবে নগর পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। রাজউক যদি রাজধানীর প্রতিটি ভবনের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক ও কঠোরভাবে মনিটরিং করতে পারলে অগ্নিকান্ডসহ অনেক দুর্ঘটনা কমে আসবে বলে মনে করনে এই নগরপরিকল্পনাবিদ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কয়েক বছর আগে পুরান ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটি ১৭ দফা সুপারিশ করেছিল। ওই সুপারিশমালার মধ্যে ছিল জরুরি ভিত্তিতে আবাসিক এলাকা থেকে গুদাম বা কারখানা সরিয়ে নেয়া, অনুমোদনহীন কারখানার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া, রাসায়নিক দ্রব্যের মজুদ, বাজারজাতকরণ এবং বিক্রির জন্য লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়া জোরদার করা, ‘অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন ২০০৩’ ও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক বা বিস্ফোরক দ্রব্যের মজুদ বা বিপণনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক দ্রব্য বা বিস্ফোরক জাতীয় পদার্থ মজুদকরণ বা বিপণন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা, ঘরবাড়িতে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক তারের গুণগতমান নিশ্চিত করা, রাস্তায় স্থাপিত খোলা তারের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন, সম্ভাব্য দুর্ঘটনা পরিহার করতে প্রতি মাসে অন্তত একবার বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার সরেজমিনে পরীক্ষা করা, দ্রুত অগ্নিনির্বাপণের জন্য স্থানীয়ভাবে পৃথক পানির লাইনসহ হাইড্রেন্ট পয়েন্ট স্থাপন করা, দুর্ঘটনা মোকাবেলায় জাতীয় পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন, রাসায়নিক ও রাসায়নিক জাতীয় দাহ্য বস্তুর আলাদা দফতরের পরিবর্তে সব দফতরের মধ্যে সমন্বয় সাধন, সময়ের চাহিদা অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের অবকাঠামো, জনবল, প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামের আধুনিকায়ন, জনসচেতনতা বাড়ানো, অগ্নিকান্ডের সময় যেন উৎসুক জনতা উদ্ধার কাজে বিঘ্ন ঘটাতে না পারে সেজন্য আইনৎশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো, পাঠ্যসূচিতে অগ্নিকান্ড, উদ্ধার ও প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়গুলো বাধ্যতামূলক করা, ৬২ হাজার কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবক তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা, কমিউনিটি সেন্টারগুলো নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার আওতায় আনা এবং বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো ডেকোরেটরের উপকরণের সঙ্গে প্রয়োজনীয়সংখ্যক অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র রাখা ইত্যাদি। কিন্তু নিমতলীর ঘটনার ১০ বছর পরও সুপারিশমালাগুলোর অধিকাংশই বাস্তবায়ন করা হয়নি। ২০১০ সালে নিমতলীতে আগুনে পুড়ে ১২৪ জন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন