শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

আড়ালেই থেকে যায় তদন্ত প্রতিবেদন

রাজউকের দুর্নীতি

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ৭ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০৩ এএম

রাজউক থেকে বিনা ঘুষে সাধারণ মানুষ সেবা পেয়েছেন, এমন ঘটনা গত ১২ বছরে বিরল। রাজউক কর্মকর্তা, দালাল ও সেবাগ্রহীতাদের একাংশের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে চুক্তি করে সুনির্দিষ্ট হারে ঘুষ নেয়া হয়। রাজউক ও দুর্নীতি একাকার এবং সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে ২০২০ সালে ৯০ থেকে ১২০ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। রাজউকের অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির ঘটনা ধরা পড়ে। এসব দুর্নীতিবাজ এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং রাজউক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু বছরের পর বছর এবস তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আড়ালেই থেকে যায়। তদন্ত প্রতিবেদন আর আলোর মুখ দেখছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজউক থেকে বিনা ঘুষে সাধারণ মানুষ সেবা পয়েছেন, এমন ঘটনা বিরল। রাজউক কর্মকর্তা, দালাল ও সেবাগ্রহীতাদের একাংশের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে চুক্তি করে সুনির্দিষ্ট হারে ঘুষ নেয়া হয়। রাজউক ও দুর্নীতি একাকার এবং সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজউকে দুর্নীতি ও অপব্যবস্থা রয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান মো. সাঈদ নূর আলম বলেন, আমি দায়িত্ব নেয়ার পর যে সব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি। সেগুলো তদন্ত করতে দেয়া হয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তারা প্রতিবেদন দিচ্ছে না। সেটার জন্যও ব্যবস্থা নেয়া হবে। দুর্নীতি আগের চেয়ে বাড়ছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার মনে হয় কমেছে। তবে বাড়েনি।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অথরাইজড অফিসার নূর আলম যেন টাকার কুমির। ভবনের অনুমোদন, আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক ভবন কিংবা ভবনের ঊর্ধ্বগতি ও অবৈধ অংশসহ নানা ত্রুটি বিচ্যুতি ধরে টাকা আদায় করাই হচ্ছে তার মূল কাজ। এছাড়াও মাসের পর মাস নতুন আবেদনের ফাইল আটকে আবেদনকারীর কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ আদায় করা তার নিত্যদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গুলশান-বনানী-মহাখালী ও বাড্ডা এলাকা রাজউকের জোন ৩-এর আওতাভুক্ত। এসব এলাকার বিভিন্ন ফাইল আটকে রেখে নানা বাহানায় অতিরিক্ত টাকা আদায় করেন নূর আলম। স¤প্রতি অথরাইজড অফিসার নূর আলমের বেপরোয়া দুর্নীতি ও হয়রানি বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ২৭/২ উত্তর কাফরুলের বাসিন্দা মো. আজহারুল ইসলাম লিখিত আবেদন করেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব লুৎফুন নাহার স্বাক্ষরিত চিঠিতে নূর আলমের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের (যুগ্ম সচিব) আইন উপদেষ্টা এ কে এম নুরুন্নবী কবিরকে তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। কিন্তু সাড়ে ৩ মাস পেড়িয়ে গেলেও প্রতিবেদনটি আলোর মুখ দেখেনি। কর্মকর্তাদের মোটা অংকের বিনিময়ে ম্যানেজ করে নূর আলম প্রতিবেদনটি ধামাচাপা দিয়ে রেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া সাকের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ হেলালী, পূর্বচাল সেল শেখ শাহিনের পিএস রিপন, বাশার শরিফ, নানু ও এম এ মালেকের বিরুদ্ধে অনেক বার তদন্ত কমিটি গঠন করা হযেছে রাজউক থেকে। কিন্তু সেগুলো আলোর মুখ দেখছে না। যার অনেক কমিটি গঠন করেছেন বর্তমান চেয়ারম্যান।

এ বিষয়ে নূর আলম ফোনে ইনকিলাবকে বলেন, কিসের তদন্ত? কিসের প্রতিবেদন? আপনার কোনো কাজ থাকলে বইলেন-করে দিব। আমার কোনো অফিসার যদি আমার নাম ব্যবহার করে টাকা চায় তার দায় তো আমার না। আপনি কি দেখেছেন আমি টাকা নিয়েছি, কিংবা টাকা চেয়েছি? অতএব এসব অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই।

টিআইবির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সেবা গ্রহণের জন্য অবৈধভাবে অর্থ আদায় করেন রাজউকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্রের জন্য জরিপ বাবদ ব্যক্তি পর্যায়ের গ্রাহক থেকে নেয়া হয় দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা। রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারদের কাছ থেকেও একই পরিমাণ নেয়া হয়। রাস্তা প্রশস্ত দেখানোর জন্য ব্যক্তির কাছ থেকে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা নেয় রাজউক। দশতলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণের জন্য ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র বাবদ ব্যক্তিকে দিতে হয় ১৫ থেকে ৮০ হাজার টাকা। আর ডেভেলপারদের দিতে হয় এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা। দশতলার ঊর্ধ্বে ভবন নির্মাণের জন্য ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র বাবদ ডেভেলপারদের দিতে হয় তিন থেকে ১০ লাখ টাকা। দশতলা পর্যন্ত নকশা অনুমোদনের জন্য ব্যক্তিকে দিতে হয় ৫০ হাজার থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা এবং ডেভেলপারদের দিতে হয় দুই থেকে দশ লাখ টাকা। দশতলার বেশি ঊর্ধ্ব ভবনের নকশা অনুমোদনের জন্য ব্যক্তিকে কত দিতে হয় সে তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারদের ঘুষ হিসেবে দিতে হয় ১৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা। বড় প্রকল্পের জন্য ডেভেলপারদের দিতে হয় ১৫ লাখ থেকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত। এছাড়া নকশা অনুমোদনের জন্য পরিদর্শনে গেলে রাজউক কর্মকর্তাদের দিতে হয় পাঁচ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। রাজউকের প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ও গবেষণায় উঠে এসেছে।

রাজউকে নবম থেকে বিশতম গ্রেড পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে জনবল নিয়োগের কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব, স্বজনপ্রীতি, চেয়ারম্যানের ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। প্রেষণে নিয়োগের ক্ষেত্রে কারিগরি পদে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মকর্তাকে পদায়ন করা হয় না। কিছু ক্ষেত্রে রাজউকের স্থায়ী কর্মকর্তাদের পদোন্নতি না দিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে প্রেষণে নিয়োগ দেয়া হয়। আবার সুবিধাজনক এলাকা বা জোনে পদায়ন ও বদলি এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রেও একই ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি বিদ্যমান। পছন্দনীয় স্থান বা পদে দুই লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকা এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৩০ হাজার থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত নিয়মবহিভর্ভাবে লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে মাঝ পথে বছরের পর বছর আটকে রাখা হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
মোঃ আশরাফুল হক ৬ জানুয়ারি, ২০২১, ৩:৩০ এএম says : 0
ক্ষমতা আছে যার দেশ আছে তার বিচার আছে তার আইন ও আছে তার দেশটা মানে ওদের বাপের
Total Reply(0)
নজরুল ইসলাম ২৫ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:২৩ পিএম says : 0
এতো কিছুর পরও সরকার কিছুই করতে পারছেনা। আমলারা নিজেরা দূর্নীতিতে জড়িত হচ্ছে। মনে হয় রাজউক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অধীনে আনা প্রয়োজন। তাহলে আমরা জনগন কিছু সেবা পাবো।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন