শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মহানগর

আস্থার সঙ্কট হলে টিকাদান প্রশ্নবিদ্ধ হবে

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৯ জানুয়ারি, ২০২১, ৮:০৪ পিএম

দেশে করোনা ভ্যাকসিন প্রদান নিয়ে মানুষের মধ্যে যেন বঞ্চনার অনুভুতি বা বিভক্তি তৈরি না হয়। প্রথম ধাপে যদি আস্থার সংকট কিংবা গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে তাহলে পুরো কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।

শনিবার (৯ জানুয়ারি) রাজধানীর বিএমএ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। ‘কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনা প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টর্স ফোরাম (বিএইচআরএফ)।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যন প্রফেসর ডা. সায়েদুর রহমান। তিনি বলেন, টিকা কার্যক্রমের সফলতা নির্ভর করে স্বচ্ছতার উপর। যত স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রক্রিয়াটি হবে, মানুষের সঙ্গে বার বার আলাপ করে হবে, তাতে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। সত্যিকারের ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের দেয়া হবে, ঝুঁকিগ্রস্থ মানুষকে সেবা-সহায়তার জন্য যারা কাজ করছেন, তাদেরকে দেয়া হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে যাদের কম ঝুঁকি তাদেরকে দেয়া হবে।

বাংলাদেশ ও বিশ্বের ভ্যাকসিন কার্যক্রমের নানা দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, ভ্যাকসিন কারা পাবে, এই প্রশ্নের উত্তর ঠিকমতো না দিলে সমাজে একটি অস্থিরতা, বঞ্চনার অনুভ‚তি তৈরি হবে। ভ্যাকসিন কারা পাবে, সেটা যদি যৌক্তিকভাবে বা বিজ্ঞানসম্মতভাবে নির্ধারণ করা না হয় এবং সে সিদ্ধান্ত দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়াও জরুরি। ভ্যাকসিনের কার্যক্রমে সাফল্য নির্ভর করে এটার গ্রহণযোগ্যতার উপরে। যদি আস্থার জায়গাটা দুর্বল হয়, তাহলে এই কর্মকান্ড ঠিকমতো চালানো সম্ভব হবে না। প্রফেসর সায়েদুর বলেন, ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে প্রথমে দেড় কোটি মানুষকে টিকা দেয়া হবে। কোন দেড় কোটি মানুষকে দেয়া হবে, তা কতোটা বিজ্ঞান ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য এবং আমাদের দেশের প্রত্যাশার সঙ্গে মেলে- এভাবে যদি না ঘটে তাহলে মানুষের আস্থা কমে যাবে, তা দ্বিতীয় পর্যায়ের ভ্যাকসিনের সময় প্রভাব ফেলবে। পশ্চিমা দুনিয়ায় প্রায় অর্ধেক মানুষ টিকা না নেয়ার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, যদি বাংলাদেশে এটা ঘটে, তাহলে কী হবে? কোনো একজন মানুষ যদি ভ্যাকসিন নিতে না চায় তাহলে ওই বাড়ি, বাসায়, অ্যাপার্টমেন্টে, কমিউনিটিতে কেবল তিনি নন, অন্যরাও ঝুঁকিতে থাকবে। এই ঝুঁকির মাধ্যমে ভ্যাকসিনেশনের সুবিধাটাই কমিয়ে দিচ্ছেন। অন্য ভ্যাকসিন পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ানোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক, কুটনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

বিএমএ’র সাবেক সভাপতি প্রফেসর ডা. রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, আমার মনে হয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিজে স্বচ্ছ নয়। তাদের মাথায় কী আছে, আমার বুঝের অভাব আছে। তাদের অব্যবস্থাপনার জন্য জাতি এর আগেও ভুগেছে। আমি মনে করি, তারা আগামীতেও আমাদের ভোগাবে। ভারত থেকে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন আসা নিয়ে ধোঁয়াশা দূর করার আহ্বান জানিয়ে প্রফেসর রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, এক্ষেত্রে ধোঁয়াশা রয়েছে। এটা কি বেক্সিমকো আনছে, না আমরা আনছি? বাংলাদেশ সরকার কেন সরাসরি আনতে পারল না, এটা আমাদের জানতে হবে। তা না হলে এটা (ধোঁয়াশা) থাকবে। তিনি বলেন, আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, মন্ত্রণালয় আমাদেরকে তথ্য সঠিকভাবে দিচ্ছে কি-না?.

মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন করে টিকা দেয়ার যে আলোচনা হচ্ছে সে বিষয়ে তিনি বলেন, আপনারা বলছেন, একটা অ্যাপ তৈরি করবেন। কতদিন লাগবে আপনাদের অ্যাপ তৈরি করতে? সেই অ্যাপে ঢুকতে পারবে কি না। কারণ সেই অ্যাপের কোয়ালিটি কী রকম হবে? এগুলো কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। আমি মনে করি, বাংলাদেশের সক্ষমতা আছে। তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাই বড় সমস্যা। টিকা নিতে অনীহার বিষয় নিয়ে রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, সাধারণ মানুষকে কীভাবে দেবেন, সে তো ডাকলেও আসবে না। আর যে জটিলতা আমরা দেখেছি, আমাদের পরীক্ষার নাম তালিকাভুক্তির জন্য সাধারণ মানুষ কিন্তু বিপদে পড়েছে। যারা ক্ষমতাবান, তাদের কিন্তু ভিন্ন কোটা আছে, সে কোটায় তারা নিয়ে গেছে।

অনুষ্ঠানে অনলাইনে যুক্ত হয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, প্রথম দফায় ৫০ লাখ টিকা আসবে। কারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা পাবে, সেটা তারা ইতোমধ্যে নির্ধারণ করেছেন। অনলাইন ও মোবাইল অ্যাপে নিবন্ধনের মাধ্যমে তা সম্পন্ন হবে। অগ্রাধিকার তালিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যাদের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি, যাদের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং সংক্রমিত হলে যাদের মধ্যে জটিলতা বা মৃত্যু ঝুঁকি বেশি, সেই ক্রাইটেরিয়া মাথায় নিয়ে অগ্রাধিকার গ্রুপ ঠিক করেছি। এক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারও কিছু পরামর্শ রয়েছে। আমাদের টিকাদান কর্মসূচির যে জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি রয়েছে, তাদের কাছ থেকেও পরামর্শ নিয়েছি। প্রফেসর সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, যারা পাবেন তাদের তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে আমরা অনলাইন নিবন্ধন নিয়ে কাজ করছি এবং আমাদের যে অ্যাপটা তৈরি করা হবে তা প্রায় সম্পন্নের পর্যায়ে। টিকা কোথা থেকে দেয়া হবে, কাদের মাধ্যমে দেয়া হবে, জনবল কারা হবে, তাদের প্রশিক্ষণের বিষয় সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। টিকা কার্যক্রমকে বড় রকমের চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রথম ধাপে আমরা ৫০ লাখ টিকা পাব, যেটা আমরা কিনেছি সেখান থেকে। কোভ্যাক্স থেকে কখন পাব সেটা এখনো নিশ্চিত নয়। বলা হচ্ছে, ফেব্রুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে। প্রথম প্রান্তিকের মধ্যে পাব, সেটাও বলা হচ্ছে। প্রথম দফায় যারা টিকা পাবেন, তাদেরকে আলাদা করে টিকা দেয়া, কারণ সবার মধ্যে টিকা পাওয়ার একটা প্রত্যাশা রয়েছে। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

কখন কোন গ্রুপ টিকা পাবেন, আমরা প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে তা প্রকাশিত করেই টিকাটা দিব। যারা পাবেন কি পাবেন না এই দ্বিধাদ্বন্ধে আছেন, তারা জানতে পারবেন, তিনি পাবেন এবং কবে পাবেন। নতুন টিকার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার বিষয়টিও বড় রকমের চ্যালেঞ্জ মন্তব্য করে তিনি বলেন, যেহেতু টিকাগুলো নতুন, সেহেতু এখান থেকে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হওয়ার আশঙ্কা থাকতেই পারে। যে কোনো টিকা বা ওষুধ থেকে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয়। সেটা ব্যবস্থাপনার জন্য পদক্ষেপ নেয়া, আমাদের কিছু ভেরিফাই কমিটি আগে থেকে রয়েছে, ইপিআইয়ের, সেটার মাধ্যমে এটা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার পর ব্যবস্থাপনা আমাদের পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে।

সভায় উপস্থিত থেকে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রনে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণে করেছে। কিন্তু বিএমএকে কোন কাজে সম্পৃক্ত করছে না, বা বিএমএ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কোন পরামর্শ করছে না। অথচ বিএমএ দেশের চিকিৎসা পেশাজীবীদের জাতীয় সংগঠন। সারাদেশে আমাদের সদস্য রয়েছে। যারা এসব কাজ সম্পন্ন করতে মন্ত্রনালয়কে সহযোগীতা করতে পারেন।

বিএইচআরএফ সভাপতি তৌফিক মারুফের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক রাশেদ রাব্বি সঞ্চালনায় সংলাপে আরও বক্তব্য রাখেণ স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ স্বাচিপ-সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ডা. এম এ আজিজ, ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ এম এ হামিদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আবু জামিল ফয়সাল। এছাড়া জুমে সংযুক্ত হয়ে বক্তব্য রাখেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রফেসর আ ফ ম রুহুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বিএমএ দফতর সম্পাদক প্রফেসর ডা. শেখ শহীদ উল্লাহ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন