শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

অস্বস্তিতে যাত্রীরা

স্বাস্থ্যবিধির কোনো শর্তই মানা হয় না আগের মতোই বিশৃঙ্খল গণপরিবহন সায়েদাবাদ টার্মিনালে চাঁদাবাজির অভিযোগ

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ১৩ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০০ এএম

করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে গত বছর ২৪ মার্চ থেকে বাংলাদেশে গণপরিবহন চলাচল কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিভিন্ন জেলায় বাস, লঞ্চ ও রেল চলাচল ৩১ মে থেকেই চালু করার অনুমতি দেয়া হয়। এ সময় বাসে অর্ধেক আসন ফাঁকা রাখার শর্তে প্রায় ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানো হয়। ১ সেপ্টেম্বর থেকে স্বাস্থ্যবিধি মানাসহ কয়েকটি শর্ত দিয়ে গণপরিবহন পুরোদমে চালু হয়।

এরপর বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রস্তুতির নির্দেশ দেয়া হয়। তবে সরকার ও বিআরটি’র নির্দেশনা পরও স্বাস্থ্যবিধিসহ অন্যান্য শর্ত কেউই মানছে না। রাজধানীর গণপরিবহনগুলোর চিত্র দেখলে মনেই হবে না যে দেশে করোনার সংক্রমণ আছে বা ছিল। এমতবস্থায় সচেতন যাত্রীরা উপায় না পেয়ে গণপরিবহনে যাতায়াত করছেন চরম অস্বস্থি নিয়ে।

শীতে করোনাভাইরাসের প্রকোপ আরো বাড়তে পারে এমন আশঙ্কা থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে দেয়া হয়েছে কঠোর নির্দেশনা। তবে সরকারের এই কঠোরতাকে বৃদ্ধাঙ্গালি দেখিয়েছে রাজধানীর গণপরিবহনগুলো। অনেক যাত্রী যেমন স্বাস্থ্যবিধি মানতে চাইছেন না, তেমনি পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যেও দেখা গেছে স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনীহা। ভুক্তভোগিদের মতে, আবার আগের মতোই বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। এদিকে, নিষিদ্ধ সত্তে¡ও সায়েদাবাদ টার্মিনালে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে। মালিক সমিতির নেতারা অনেক চেষ্টা করেও কয়েকটি পরিবহন কোম্পানির বাস থেকে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে পারছেন না।

জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোস্যাল কাউন্সিলের এক প্রতিবেদন অনুসারে ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থাপনা নিয়ে সন্তুষ্ট নয় ৬৭ শতাংশ গণপরিবহন ব্যবহারকারি। করোনার মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি ও বিআরটিএ’র শর্ত না মানায় এখন এ অসন্তুষ্টির মাত্রা অনেক বেড়েছে বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারনা। ‘সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট ইনডেক্স ফর ঢাকা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, রাজধানীর গণপরিবহনে ভোগান্তির শুরুটা হয় গাড়িতে উঠতে গিয়ে। ভিড় ঠেলে ওঠার পর আসন না মিললে দাঁড়িয়ে বা ঝুলে যাওয়াটাই নিয়তি। আরামে যেতে পারে না আসনধারীও। বড় অস্বস্তির কারণ ঘিঞ্জি বিন্যাসের নোংরা ও ভাঙাচোরা আসন। অথচ পাবলিক বাসের ওপর নির্ভরশীল গণপরিবহন ব্যবহারকারী সিংহভাগ মানুষ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাস এড়িয়ে ট্যাক্সি কিংবা অটোরিকশায় যেতে চাইলে গুনতে হয় কয়েক গুণ বেশি ভাড়া। হালের রাইডশেয়ার কিছুটা সহজলভ্য হলেও সেখানে রয়েছে উচ্চভাড়া ও অপেশাদারিত্বের ছাপ। সব মিলিয়ে দুর্ভোগ-ভোগান্তিতে ভরা রাজধানীর নগর পরিবহন ব্যবস্থা। এতে নগর পরিবহনের সবটা জুড়ে শুধুই অসন্তুষ্টি। গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে ঢাকার নগর পরিবহন ব্যবস্থা যেভাবে বিশৃঙ্খল হয়ে উঠছে, তাতে যাত্রীদের অসন্তোষ আরো বাড়তে পারে। বিশেষত কভিড-১৯ পরিস্থিতি গণপরিবহনে মানুষের যাতায়াতকে আরো অস্বস্তিদায়ক করে তুলেছে। স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে সন্তুষ্ট হতে না পারায় অনেক মানুষই করোনাকালে গণপরিবহনে ভ্রমণ থেকে নিজেকে বিরত রাখছে।

বিশ্বের সবচেয়ে যানজটপ্রবণ শহরগুলোর একটি ঢাকা। এখানে রাস্তার তুলনায় গাড়ি অনেক বেশি। যদিও জনসংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল গাড়ির সংখ্যা। সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট ইনডেক্স বলছে, ঢাকার অর্ধেকের বেশি মানুষ গণপরিবহনের প্রাপ্যতা নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। তবে মানুষ আরো অসন্তুষ্ট গণপরিবহনের সময়ানুবর্তিতা নিয়ে। প্রায় ৭২ শতাংশ মানুষ মনে করে, ঢাকায় গণপরিবহন সময়সূচি মেনে চলে না, যা ভোগান্তির বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে ঢাকায় বাস-মিনিবাস আছে আট হাজারের মতো। যদিও পরিবহন মালিকরা বলছেন, বর্তমানে চলাচলরত বাসের সংখ্যা সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজারের বেশি। এসব বাসের সিংহভাগই ভাঙাচোরা। ফিটনেস নেই অন্তত ৬০ শতাংশ বাসের। আসন-মেঝে থেকে শুরু করে দরজার হাতল পর্যন্ত নোংরা। ঢাকার এ অপরিচ্ছন্ন বাস গণপরিবহন ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট নয় ৬৭ শতাংশ ব্যবহারকারী। শুধু বাস-মিনিবাস নয়, পরিচ্ছন্নতায় ঘাটতি রয়েছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, লেগুনা, ট্যাক্সির মতো বাহনেও। ঢাকার পাবলিক বাসগুলোয় যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতা নিত্যচিত্র। সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট ইনডেক্স অনুযায়ী, ঢাকার গণপরিবহন ব্যবহারকারীরা সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্ট গণপরিবহনের নিরাপত্তা নিয়ে। প্রতি ১০০ জন ব্যবহারকারীর ৭৬ জনই মনে করেন, ঢাকায় গণপরিবহনে ভ্রমণ অনিরাপদ।

ঢাকার গণপরিবহন ব্যবহারকারীদের ‘ক্যাপটিভ ইউজার’ হিসেবে অভিহিত করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মো. হাদিউজ্জামান। তিনি বলেন, ঢাকায় যারা গণপরিবহন ব্যবহার করে, তারা সবাই বাধ্য হয়েই ওঠে। যাত্রীরা চায় একটা নির্ভরযোগ্য বাস সেবা। সময়মতো বাস পাওয়া এবং সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছা যাত্রীদের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকার রাস্তাগুলোর পুরোটা জুড়েই বাস স্টপেজ। এখানে রাস্তা থেকেই ওঠে যাত্রী, নামে রাস্তার ওপরই। খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশনা এলেও ঠিক হয়নি রাস্তার ওপর যাত্রী ওঠানামা। একই চিত্র উঠে এসেছে সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট ইনডেক্সেও।

সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী গণপরিবহনের যাত্রীদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। বেশিরভাগ যাত্রী পরছেন না মাস্ক। তাছাড়া গাড়ির চালক সুপারভাইজার তারাও মাস্ক ব্যবহারে উদাসীন। গণপরিবহনের নির্ধারিত সিটের কয়েক গুণ বেশি যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। একেকটি বাসে দ্বিগুণ বা তার চেয়েও বেশি যাত্রী দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। বেশিরভাগ গণপরিবহনে গাদাগাদি করে যাত্রী তোলা হচ্ছে। করোনা শুরুর দিকে গণপরিবহনে সুপারভাইজার যাত্রীদের হাতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিতে দেখা গেলেও এখন আর তা কেউ মানছেন না। মানুষ কিছুটা সতর্ক হলেও এখন মাস্ক ব্যাবহার, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা ইত্যাদি ব্যাপারে চরম উদাসীনতা দেখা গেছে।

অন্যদিকে, পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ হলেও রাজধানীর সায়েদাবাদ টার্মিনালে কয়েকটি কোম্পানির বাসে প্রতিদিন মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে তিশা ক্লাসিক পরিবহনের ঢাকা-কোম্পানীগঞ্জ রুটের প্রতিটি বাস থেকে চাঁদা তোলা হচ্ছে ১৭৫০ টাকা। যার মধ্যে ঢাকায় তোলা হয় ৩৫০ টাকা। চিটাগাং রোডে ১০০ টাকা, মেঘনায় মুন ফিলিং স্টেশনে তোলা হয় ৬০০ টাকা, বাকি ৭০০ টাকা তোলা হয় কোম্পানীগঞ্জে। মালিক ও শ্রমিকরা জানান, তিশা কোম্পানীগঞ্জ রুটের এই চাঁদা তোলে আকতার ও মোবারক। একজন মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মোবারক নিজের প্রভাব খাটিয়ে কোম্পানী পরিচালনার নামে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করে চলেছে। তার কাছে মালিকরা অসহায়। শুধু তাই নয়, তিশা ক্লাসিকে মোবারকের বাস আছে মাত্র একটি। তাও অন্যের বøু বুক নিজের নামে পরিবর্তন করানো। এই একটি বাস দিয়েই তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেজে মালিক-শ্রমিককে জিম্মি করে চাঁদাবাজি করে যাচ্ছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন