বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

প্রকাশের সময় : ২৭ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ফারুক হোসাইন : ‘তোমাদের পানে চাহি বন্ধু আর আমি জাগিব না/কোলাহল করি সারা দিনমান কারও ধ্যান ভাঙিব না।/নিশ্চল নিশ্চুপ/আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ।’ সেই ধূপের মতোই নিভৃতে দীর্ঘ দিন জ্বলেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। নির্বাক হয়ে অতিবাহিত করেছিলেন ১৯৪২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত। এই নীরবতার মধ্যেই চিরবিদায় নিয়েছেন পৃথিবী থেকে। আজ সেই অমর কবির ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র মহাবিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ৭৭ বছর বয়সে ঢাকার তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গববন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই। যেন গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই...।’ কবির সেই আকাক্সক্ষার কথা মনে রেখেই তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে দাফন করা হয়। এরপর থেকেই জাতীয় কবির মৃত্যু দিবসে রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে। এবারও জাতীয় কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে।
বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে সপ্তম অষ্টম দশক পর্যন্ত কাজী নজরুল ইসলাম শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়ন ও ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তার কবিতার মাধ্যমে মশাল জ্বেলেছিলেন। আবার প্রেম আর বিরহের এমন মর্মস্পর্শী কবিতা আর গানের প্লাবন এনেছিলেন বাংলা সাহিত্যে, যা তুলে দিয়েছে তার হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর রণতূর্য। এই প্রেম ও বিদ্রোহের শাশ্বত বাণীর স্রষ্টা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবির নাম কাজী নজরুল ইসলাম। অসাম্প্রদায়িকতার বরপুত্র ও সাম্যবাদী চেতনার ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ ছিলেন তিনি। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাক নাম ‘দুখু মিয়া’। পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুন। বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা হিসেবে নিজের দক্ষতা, যোগ্যতা ও মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিণী সৃষ্টি করে বাংলা সঙ্গীত জগৎকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। প্রেম, দ্রোহ, সাম্যবাদ ও জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস। নজরুলের কবিতা, গান ও সাহিত্য কর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। তিনি ছিলেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। তাঁর লেখনি জাতীয় জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তাঁর কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে।
দারিদ্র্যের কারণে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশিদূর এগোয়নি; কিন্তু প্রতিভাবান নজরুল নিজের চেষ্টায় প্রচুর পড়াশোনা করে সমৃদ্ধ করেছেন তার মনন ও চিন্তার জগৎ। ছোটবেলায় রুটির দোকানে কাজ করা, লেটোর দলে যোগদান, যৌবনে যুদ্ধযাত্রা, সাংবাদিকতা, রাজনীতিতে সংশ্লিষ্টতা সব মিলিয়ে বিচিত্র আর বর্ণাঢ্য ছিল তার জীবন। বাংলা কাব্যের ইতিহাসে ‘বিদ্রোহী’ এবং আধুনিক বাংলা গানের ‘বুলবুল’ খ্যাত এ কবি বিশ ও ত্রিশের দশকে অবিভক্ত বাংলার, এমনকি উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক জগতের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। নজরুল তার কবিতা, গান, সাংবাদিক-রচনা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, উপন্যাসসহ অন্যান্য লেখনী এবং রাজনৈতিক কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে পরাধীন ভারতে বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্য ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও সোচ্চার কণ্ঠ ছিলেন। সে কারণে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তার লেখনী ধূমকেতুর মতো আঘাত হেনে জাগিয়ে দিয়েছিল ঘুমন্ত ভারতবাসীকে। গণবিদ্রোহ সৃষ্টিতে ইন্ধন জোগানোর অভিযোগে ইংরেজ সরকার তার একাধিক গ্রন্থ ও রচনা করেছে বাজেয়াপ্ত, তাকে নিক্ষেপ করেছে কারাগারে। কারাগারেও চিরবিদ্রোহী ছিলেন, প্রতিবাদ করেছিলেন ব্রিটিশ সরকারের জেল-জুলুমের। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসক-শোষকদের ভিত্তিমূল কাঁপিয়ে দিয়েছিল তার আগুনঝরা কবিতা আর শেকল ভাঙার গান। ‘বিদ্রোহী’, ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘ফণীমনসা’, ‘ভাঙার গান’, ‘সাম্যবাদী’, ‘প্রলয় শিখা’র মতো কবিতার ঝঙ্কারে শুধু শোষক-শাসকের ভিত্তিমূলই কাঁপেনি, কেঁপে উঠেছিল সমগ্র বাংলাও। কারণ এমন কবিতা বাঙালি এর আগে কখনও শোনেনি। প্রেমের কবিতায়ও নিয়ে এলেন যেন নতুন জোয়ার। ধর্মান্ধতা, নারীর প্রতি বৈষম্য, সমাজের নিচু শ্রেণীর মানুষদের উপেক্ষা আর ধর্মীয় কূপম-ূকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন বিদ্রোহী কবি। তাই শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও আজও তিনি প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক। আজও মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা আর ধনী-দরিদ্রে দ্বিধাবিভক্ত সমাজে, শোষক আর শোষিতে বিভাজিত পৃথিবীতে তার কবিতা, গান, প্রবন্ধ, গল্প-উপন্যাসসহ বিচিত্র রচনা মানবমুক্তির প্রেরণা জোগায়। তাই তিনি তার গানে লিখতে পেরেছিলেন ‘আমারে দেব না ভুলিতে’। সত্যিই তাকে ভোলা অসম্ভব। কারণ বাংলা কাব্য আর গানে তিনি এনেছিলেন নতুন জোয়ার। ১৯৪২ থেকে বিদ্রোহী কবি নির্বাহ হয়ে যান। নির্বাক থাকেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। ১৯৭২ সালের ২৪ মে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগেই কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। সরকার তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে এবং জাতীয় কবি হিসেবেও ঘোষণা দেয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশেই ছিলেন। তার জীবনকাল ৭৭ বছরের হলেও ১৯৪২ সালের জুলাই থেকেই তিনি অসুস্থ ছিলেন। দীর্ঘ ৩৪ বছর তিনি বাকহীন থেকে ১৯৭৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি’র চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
বেগম খালেদা জিয়া তার এক বাণীতে বলেন, কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের সামনে চলার অন্তহীন প্রেরণার উৎস। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তাঁর কবিতা ও গান যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধা ও এদেশের মুক্তিকামী মানুষকে সাহস ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে, উজ্জীবিত করেছে। আজো আন্দোলন সংগ্রামে তাঁর কবিতা ও গান আমাদেরকে শক্তি ও সাহস জোগায়।
নজরুল মৃত্যুবার্ষিকীতে কর্মসূচী
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশন ও বিভিন্ন বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছেÑ সকালে ফজরের নামাজের পর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে কোরআনখানি অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া সকাল ৭টায় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারিরা জমায়েত হয়ে সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে ভিসির নেতৃত্বে শোভাযাত্রা করে কবির কবরে পুষ্পার্পণ এবং ফাতেহা পাঠ করা হবে। পরে কবির মাজার প্রাঙ্গণে ভিসির সভাপতিত্বে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করবেন বাংলা বিভাগের চেয়ারপার্সন প্রফেসর ড. বেগম আকতার কামাল। এছাড়া বাংলা একাডেমি, নজরুল ইনস্টিটিউট, নজরুল গবেষণা ইনস্টিটিউট, ছায়ানটসহ বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Shilon Malik ২৯ আগস্ট, ২০১৮, ১:৪৫ পিএম says : 0
"তোমাকে শুনেছি যত বুঝা হয়ে উঠেনি অত আবেগ ছলে গাইনি তো কিছু ভুল ক্ষমা কর হে ওগো কবি, প্রিয় নজরুল।" চল্লিশতম প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলী রাশি রাশি...
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন