শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বিনোদন মাধ্যমে শুদ্ধতার চর্চা চাই

আব্দুল্লাহ আলম নুর | প্রকাশের সময় : ১৭ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

সময়টি অনলাইন মাধ্যমের। বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের বেশিরভাগের সময় কাটে এই মাধ্যমে। বিশেষত কোভিড-১৯ পরিস্থিতির এই সময়ে বাসায় বসে কিংবা অলস সময় কাটছে অধিকাংশ তরুণের। হাতে থাকা ছোটো ডিভাউসে সার্বক্ষণিক চালু থাকছে সামাজিক মাধ্যম আর ইন্টারনেট। লকডাউন, হোম কোয়ারেন্টাইনের আগে যে শিক্ষার্থীদের হাতে স্মার্ট ফোন কিংবা ল্যাপটপ-পিসি ছিলো না, অনলাইন ক্লাসের অজুহাতে তাদের অধিকাংশও পরিবার থেকে আদায় করে নিয়েছে ব্যক্তিগত ডিভাইস। কিন্তু শুধুই কি অনলাইন ক্লাস? কতজন করছে এই ক্লাস? ক্লাসে যুক্ত হয়ে ভিডিও-মাইক্রোফোন বন্ধ রেখে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ছে গেমস, ইউটিউব কিংবা অনলাইনে। ট্রল, মিমের নামে রীতিমতো রাষ্ট্রীয় বিষয়, ধর্মীয় বিষয়, সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ এমনকি শিক্ষকদের নিয়েও হাসি-ঠাট্টা করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কিছু গ্রুপ-পেজ থেকে।

গল্প-উপন্যাস, গোয়েন্দা কাহিনী, কিংবা কবিতার বই থেকে যেন ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। রোজ সকালে পত্রিকার পাতা উল্টানো যেন জানে না তারা। সময় কাটানোর একমাত্র মাধ্যমই হয়ে উঠছে হাতে থাকা ছোটো ডিভাইস আর ইন্টারনেট জগৎ। কিন্তু কী পাচ্ছে তারা সেখান থেকে? সংবাদ কিংবা শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান তো বহুদূর, অনলাইনের সুবাদে তরুণরা এখন টেলিভিশনে প্রচারিত সিনেমা-নাটকও দেখে না বললেই চলে।
আজকাল রাস্তাঘাট, বিনোদন কেন্দ্র্র, পাবলিক প্লেস, গণপরিবহন এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও উঠতি বয়সীদের মুখে হামেশাই শোনা যায় বিভিন্ন গালি, অশালীন শব্দ। ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন সংস্কৃতি থেকে আমদানি করা এসব শব্দ, ট্রেন্ডের নামে খুব সহজেই তুলে দেয়া হয় উঠতি বয়সীদের মুখে। অনলাইনে প্রচারিত বিভিন্ন নাটক বা ভিডিও সংলাপে যার ব্যবহার দেখানো হয় অনেকটা স্বাভাবিকভাবে। মাধ্যমটিতে প্রচারিত কোনো নাটকে অভিনেতার টি-শার্টে দেখা যায় অশ্লীল বাক্য। তাদের মুখে যেন গালি আর অশ্রাব্য ভাষার প্রতিযোগিতা থাকে। নাটকে দেখা যায় নারীদের উদ্দেশ্য করে অশালীন কথাবার্তা, বাজে অঙ্গভঙ্গি। শিক্ষক, বয়স্কদের সাথে মজাকরা, তাদের থ্রেট করা, উদ্ভট কথাবার্তা অনেকটা এভাবেই যেন এগিয়ে যায় অনলাইন মাধ্যমে প্রচারিত নাটক বা ভিডিওগুলো।

সাম্প্রতিক সময়ে বিনোদন মাধ্যমে আরেকটি সংযোজন ওয়েব সিরিজ। ওয়েব সিরিজ প্রশ্নবিদ্ধ করছে দর্শক, পর্যালোচকদের। দেশীয় ওয়েব সিরিজ নিয়ে চলছে নানা বিতর্ক। কিছু ওয়েব সিরিজ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। নাটক দেখতে গিয়ে আপত্তিকর দৃশ্য দেখতে হবে, অশ্লীল-অশ্রাব্য শব্দ শুনতে হবে, তা হয়ত কল্পনা করেনি দর্শক। গত বছরে মুক্তি পাওয়া আলোচিত তিনটি ওয়েব সিরিজ নিয়ে দর্শকদের পাশাপাশি যুক্তি-তর্কে শামিল হয়েছিলেন নির্মাতারাও। এসময় ওয়েব সিরিজের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতিও দিয়েছিলেন নির্মাতা, অভিনয়শিল্পীরা। অশালীন বাক্যালাপ আর অঙ্গভঙ্গিই যেন হয়ে উঠছে প্রচারের মূল বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভিডিওর শুরুতে প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য লেখা থাকলেও নানাভাবে তা প্রচারিত হয়ে যায় সব মাধ্যমেই। ওয়েব সিরিজের আপত্তিকর ভিডিওর ছোটো অংশ ছেড়ে দেয়া হয় সামাজিক মাধ্যমে। অনেকে তো আবার ফেসবুক, ইউটিউবে এসে ভিডিওর সমালোচনা করতে করতেই এবিষয়ে জানেন না, এমন দর্শকদেরও পরিচয় করিয়ে দেন, সেসব গল্প আর সমালোচিত দৃশ্যের সাথে। অনেক ভিডিওতে ধূমপান কিংবা অ্যালকোহলের দৃশ্য পরিবেশনের সময় প্রচার করা হয় না কোনো সতর্কতামূলক বাণী।

গত ১৬ ডিসেম্বর অনলাইন প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পাওয়া একটি চলচ্চিত্রে, ধর্ষণের শিকার একজন নারীকে জিজ্ঞাসাবাদের দৃশ্যে অশালীন ভাষা ব্যবহার করে, পুলিশকে হেয় করার অভিযোগে এবং পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা করে পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট। একই মাসের ২৫ তারিখে চলচ্চিত্রটির পরিচালক এবং অভিনেতাকে গ্রেফতারের পর কারাগারে পাঠানো হয়। প্রসঙ্গত আরো উল্লেখযোগ্য ২০১৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর একটি মিউজিক ভিডিওর সাথে সম্পৃক্ত ৭ জনের বিরুদ্ধে আদালতে পর্নোগ্রাফির অভিযোগে মামলা করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী।

ইউটিউব, ওয়েবসাইট, পর্দা যেখানেই প্রচারিত হোক নাটক, সিনেমা হচ্ছে বিনোদনের মাধ্যম, যেখানে থাকবে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বার্তা, থাকবে শিক্ষণীয় বিষয়। এসব পর্যালোচনায় অনলাইন ভিডিও প্রচারের ক্ষেত্রেও প্রিভিউ কমিটি বা সেন্সরশিপের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বিগত বছরের ২২ জুন ওয়েব সিরিজ বিষয়ে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘ওয়েবসিরিজ, সিনেমা বা যেকোনো কিছু নির্মাণ ও প্রচার করার ক্ষেত্রে আমাদের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের একটি কৃষ্টি এবং সংস্কৃতি আছে, আমাদের সমাজের একটি মূল্যবোধ আছে। আমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করে কোনো কিছু করা কখনোই সমীচীন নয়। আইন অনুযায়ী সেটি দন্ডনীয় অপরাধ।’

শুধু দর্শক টানার উদ্দেশ্যে আপত্তিকর দৃশ্য দেখানোর প্রতিযোগিতা কোনো সুফল বয়ে আনবে না বিনোদন জগতে। নাটক, সিনেমা অবশ্যই জীবনের গল্প বলবে, প্রান্তিক থেকে উচ্চবর্গ সবার জীবনাচরণ দেখাবে, উপস্থাপন করবে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষদের। কিন্তু তা উপস্থাপিত হোক সুন্দর এবং সুস্থ ধারায়। আমরা বিনোদন মাধ্যমে সুস্থ ধারা চাই, শুদ্ধতার চর্চা চাই।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন