বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ট্রাম্পের পরাজয় ও পরিণতি থেকে শিক্ষা নিতে হবে

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ১৭ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

গণতন্ত্রের সবচেয়ে সহজ, সরল এবং সর্বজনগ্রহণযোগ্য সংজ্ঞাটি দিয়েছিলন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। ১৮৬১ সাল থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি এমন এক সময়ে প্রেসিডেন্ট হন যখন যুক্তরাষ্ট্র আত্মপরিচয়, সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংকটে ভোগার পাশাপাশি গৃহযুদ্ধে জর্জরিত ছিল। প্রেসিডেন্ট হয়েই তিনি এসব সমস্যার সমাধান এবং দাসপ্রথা বিলুপ্ত ও গৃহযুদ্ধের অবসানে আত্মনিবেদিত হন। সে সময় চরম বর্ণবাদী বিদ্বেষ চলছিল এবং প্রধান বিচারপতি রজার বি টেনি রায় দিয়ে বলেছিলেন, কালোরা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক নয় এবং তাদের কোনো সাংবিধানিক অধিকার নেই। তার এই রায়ের বিরুদ্ধে লিংকন আইনি লড়াই করে কালোদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সব মানুষই সমান এবং প্রত্যেকের সমান অধিকার রয়েছে বলে তিনি অভিমত দিয়েছিলেন। লিংকন গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ফেডারেল গভর্নমেন্টের আওতায় এনে এক করেছিলেন। গৃহযুদ্ধের অবসানের পরপর এক জনসভায় বক্তৃতাকালে তিনি বলেছিলেন, প্রত্যেক আমেরিকান এক ছাতার নিচে এক সৃষ্টিকর্তার অধীনে বসবাস করবে। বক্তৃতা শেষ করেন তিনি এ বলে, ‘গভর্নমেন্ট অফ দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল।’ সরকার জনগণের, নির্বাচিত হবে জনগণের রায়ে এবং কাজ করবে জনগণের জন্য। তার এই উক্তিটিই গণতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা হিসেবে বিবেচিত ও জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তীতে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা বলতে তার এই কথাই সবার আগে উচ্চারিত হয়। বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র যে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তার অন্যতম রূপকার ছিলেন আব্রাহাম লিংকন। নাগরিকদের বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত, দাসপ্রথা বিলোপ, বর্ণবৈষম্যের অবসান এবং বহুজাতিক মানুষের এক অন্যন্য দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। সেই থেকে যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য দেশের জন্য উদাহরণ হয়ে রয়েছে। আমেরিকানরাও তাদের দেশের গণতন্ত্র নিয়ে গর্ববোধ করে। তবে দেড়শ’ বছরের বেশি সময় পর আব্রাহাম লিংকনের যুক্তরাষ্ট্রে বেশ বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছেন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০১৬ সালে নির্বাচিত হয়েই যুক্তরাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোকে প্রায় তছনছ করে দেন তিনি। ‘ট্রু আমেরিকা বা আমেরিকা ফার্স্ট’ শ্লোগান দিয়ে বহুজাতিক যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদকে উস্কে দিয়ে বিভাজিত করে ফেলেন। শ্বেতাঙ্গ, অশ্বেতাঙ্গ, কালো এবং বিভিন্ন দেশের অভিবাসীদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করেন। তার এই নীতির ফলে উগ্রবাদী শ্বেতাঙ্গরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। তারা কালো ও অভিবাসীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে। ট্রাম্পের এ ধরনের নীতি বিশ্বব্যাপী তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেছিলেন, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে ছিন্নভিন্ন রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্য ধ্বংস করে দিচ্ছেন।

দুই.
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই ট্রাম্প শ্বেতাঙ্গদের উস্কে দেন। অভিবাসী নীতি কঠোর করে তা নিয়ন্ত্রণ করেন। বেশ কয়েকটি দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেন। তার কর্মকান্ডে এক ধরনের ‘পাগলামি’ প্রকাশিত হতে থাকে। অবশ্য ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়েই বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করে তিনি সমালোচিত হয়েছিলেন। সে সময় উল্টা-পাল্টা বক্তব্যের কারণে বিশ্লেষকরা তার মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার কথাও বলেছিলেন। তারপরও আমেরিকানরা তাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেন। যদিও তার নির্বাচিত হওয়ার পেছনে তখন রাশিয়ার কানেকশন ছিল বলে অভিযোগ উঠে। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হলেও তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা পড়েনি। নির্বাচিত হয়েই তিনি একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও বক্তব্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোতে আঘাত হানতে থাকেন। তার অন্যতম অস্ত্র ছিল বর্ণবিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়া। ট্রু আমেরিকা নীতি অবলম্বন করে শ্বেতাঙ্গ-অশ্বেতাঙ্গদের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেন। তার সমর্থকদের উস্কে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করেন। এতে অশ্বেতাঙ্গ ও অভিবাসীরা চরম বিপাকে পড়েন। সর্বশেষ গত বছর পুলিশ কর্তৃক এক কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার জেরে বর্ণবিদ্বেষ এবং দাঙ্গা গোটা যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ব্যাপক সহিংসতার সৃষ্টি হয়। এই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ার নেপথ্যে ছিল ট্রাম্পের উস্কানিমূলক বক্তব্য এবং সমর্থন। সূচনা হয় ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের। এই আন্দোলনে কানাডার প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানদেরও সমর্থন দিতে দেখা যায়। আন্দোলনের সূত্র ধরে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের নির্যাতনের বিরুদ্ধেও ‘মুসলিম লাইভস ম্যাটার’-এর সূচনা হয়। বর্ণবাদী এই আন্দোলন দমাতে ট্রাম্পকে শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী নামাতে হয়। বলা হয়ে থাকে, নির্বাচনের কয়েক মাস আগে ট্রাম্প তার পুরনো অস্ত্র বার্ণবাদকে সামনে এনে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চেয়েছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, ২০১৬ সালের মতো শ্বেতাঙ্গদের জাগিয়ে দিতে পারলে সহজে নির্বাচনে জিতে যাবেন। শুধু তাই নয়, নির্বাচনে জেতার জন্য ট্রাম্প হেন কোনো পন্থা নেই যা অবলম্বন করেননি। অশ্বেতাঙ্গদের প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার মতো হীন পথ ধরা, এমনকি নির্বাচনে তাকে জিতিয়ে দেয়ার জন্য চীনের সহযোগিতা পর্যন্ত চেয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এবারের নির্বাচনে তার বিজয়ী হওয়ার পথটি ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন জরিপেও তার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। জো বাইডেন বিজয়ী হতে যাচ্ছেন, এমন ফলাফল স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। ফলে পরাজয়ের বিষয়টি আঁচ করতে পেরে নির্বাচনের আগে তিনি এমনও মন্তব্য করেছিলেন যে, পরাজিত হলেও সহজে তিনি ক্ষমতা ছাড়বেন না। নির্বাচনের ফল দেখে সিদ্ধান্ত নেবেন হোয়াইট হাউস ছাড়বেন কি ছাড়বেন না। নির্বাচনের সকল পূর্বাভাস সত্য প্রমানিত করে শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প পরাজিত হন। পরাজিত হওয়ার পর তিনি আরও উন্মাতাল হয়ে পড়েন, অনেকটা ভারসাম্যহীন আচরণ করতে শুরু করেন। নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, ফল উল্টে দেয়া হয়েছে সহ নানা অভিযোগ করতে থাকেন। এ নিয়ে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের আদালতে মামলা পর্যন্ত করেন। এসব মামলায় তিনি হেরে যান। তার সব আশার প্রদীপ যখন একে একে নিভে যায়, তখন ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার সর্বশেষ অস্ত্র হিসেবে তিনি সহিংস পন্থা অবলম্বন করেন। তার উগ্র সমর্থকদের দিয়ে গত সপ্তাহে ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল হিলের কংগ্রেস ভবনে হামলা চালান। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ২০৬ বছর পর ক্যাপিটল হিলে হামলার এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা দ্বিতীয়বারের মতো ঘটে। ১৮১৪ সালে ইংরেজরা প্রথম এ ভবনে হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। ২০২১ সালে এসে হামলার সরাসরি ইন্ধন দেন যুক্তরাষ্ট্রেরই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। হামলার দিন হোয়াইট হাউজের কাছে একটি সমাবেশে ট্রাম্প তার সমর্থকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমরা ক্যাপিটল ভবনে পদযাত্রা করব। আমাদের সাহসী সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্যদের উৎসাহিত করব। আপনাদের দৃঢ়তা দেখাতে হবে।’ তার এ বক্তব্যের পরপরই হাজার হাজার ট্রাম্প সমর্থক ক্যাপিটল হিলের দিকে যাত্রা শুরু করে। সেখানে গিয়ে বিক্ষোভ এবং হামলা চালায়। পর্যবেক্ষকদের মতে, এ হামলা ক্যাপিটল হিলে হয়নি, হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের উপর। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দিয়ে একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কায়েমের অপচেষ্টা চালিয়েছেন। এ হামলাকে ট্রাম্পের ‘ব্যর্থ অভ্যুত্থান’ হিসেবে তারা অভিহিত করেছেন। শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পের ক্ষমতায় থাকার শেষ অস্ত্রটি ব্যর্থ হওয়ায় তিনি এখন শাস্তির মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন। ক্ষমতার কয়েক দিন বাকি থাকতে তাকে ইমপিচমেন্টের মুখোমুখি এবং ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর ক্ষমতার অপব্যবহারসহ অন্যান্য অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন। ন্যাক্কারজনক এ ঘটনা ঘটিয়ে এখন তিনি ক্ষমা পাওয়ার পথ খুঁজছেন। তিনি ক্ষমা পাবেন কিনা, তা এখন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র মনস্ক নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করছে।

তিন.
শত চেষ্টার পরও ট্রাম্পকে ক্ষমতা ছাড়তেই হচ্ছে। তবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রে যে আঘাত এবং কালিমা লাগিয়েছেন, তা কি সহজে মুছে ফেলা যাবে? কিংবা ট্রাম্প যদি পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি কি দাঁড়াত? এমন প্রশ্ন এখন ঘুরে ফিরে উঠছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব রাজনীতিতে আগের তুলনায় দুর্বল হলেও এখনো এক নম্বর পরাশক্তি হয়ে রয়েছে। বিশ্বে তার যেমন মিত্র রয়েছে, তেমনি বিভিন্ন দেশে প্রভাব খাটানোর সক্ষমতাও রয়েছে। ট্রাম্প যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে একক ক্ষমতার রাজনীতি করেছেন, তার প্রভাব বিভিন্ন দেশের ওপরও পড়েছে। আমরা যদি ভারতের দিকে নজর দেই, তাহলে দেখব, বিশ্বের অন্যতম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত দেশটিতে মোদির একক কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়েছে। গণতন্ত্রকে পেছনে ঠেলে তিনি ইচ্ছামতো যা খুশি তা করছেন। একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। ট্রাম্প যেমন বর্ণবাদী নীতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে একটি শ্বেতাঙ্গ রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা চালিয়েছেন, তেমনি মোদি সরকারও মুসলমানদের নির্মূল করে ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। একইভাবে ফ্রান্স, জার্মান, ব্রাজিলেও এর প্রভাব পড়েছে। চীন সংবিধান পরিবর্তন করে এক ব্যক্তির চিরস্থায়ী শাসন ব্যবস্থা চালু করেছে। রাশিয়াও সে পথেই হাঁটছে। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশই ট্রাম্পের নীতিতে উৎসাহী হয়ে কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর শাসন ব্যবস্থা যদি কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠে, তার প্রভাব উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও পড়ে। কারণ, দেশগুলো কোনো না কোনোভাবে প্রভাবশালী দেশগুলোর নীতি ও নিয়ন্ত্রণের উপর নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা এবং প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতবিক্ষত করে ট্রাম্প যে ক্ষতি করেছেন, তার প্রতিক্রিয়া বিশ্বের গণতন্ত্রকে অত্যন্ত ক্ষতির মুখে ঠেলে দিয়েছে। তিনি যদি পুনরায় নির্বাচিত হতেন, তাহলে বিশ্ব পরিস্থিতি কি হতো, তা কল্পনাও করা যায় না। গণতন্ত্র পুস্তকীয় নীতিতে পরিণত হতো। মুখে গণতন্ত্রের বুলি থাকলেও, তার মোড়কে একনায়কতন্ত্র আরও প্রবল হয়ে উঠত। ট্রাম্পের নীতিতে উৎসাহী হয়ে যেসব দেশের সরকার প্রধান একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিপতি হয়েছিলেন, তার পরাজয়ে এখন তাদের উৎসাহে ভাটা পড়বে। ট্রাম্পের ক্ষমতার শেষ দিকে মোদি সরকার যেভাবে ট্রাম্প, ট্রাম্প করে উল্লসিত হয়ে উঠেছিল, তা এখন কিছুটা হলেও স্তিমিত হবে। ট্রাম্প জিতলে এই উপমহাদেশে তার আচরণ কি হতো, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। বলার অপেক্ষা রাখে না, এখন পর্যন্ত গণতন্ত্র মানুষের কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নীতি। এর মাধ্যমে তার বাক স্বাধীনতা যেমন নিশ্চিত হয়, তেমনি জনগণের রায় ও ইচ্ছার বাইরে গিয়ে কারো পক্ষে দেশ পরিচালনা করাও কঠিন হয়ে পড়ে। আব্রাহাম লিংকন, জনগণের দ্বারা পরিচালিত সরকার প্রতিষ্ঠা করার কারণেই যুক্তরাষ্ট্র আজ সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হয়েছে। দেশটির জনগণ মুক্তভাবে তার মতামত প্রকাশ করতে পারছে। গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্ত হওয়ায় ট্রাম্পের মতো একরোখা, গোয়ার ও ক্ষমতালিপ্সু প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা ছাড়তে হচ্ছে। তা নাহলে, যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং বহু জাতি ও বর্ণের পারস্পরিক সহবস্থানের মাধ্যমে বসবাসের অপূর্ব সংস্কৃতি ধুলিস্মাত হয়ে যেত। যেসব দেশে এক নায়কতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা বলবৎ রয়েছে, সেসব দেশের জনগণের কি অবস্থা তা অনুভব করতে কষ্ট হয় না। তবে এ ধরনের শাসন ব্যবস্থা যে স্থায়ী হয় না, তা ইতোমধ্যে দেখা গেছে। বহু দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার অবসান হয়ে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যদিও এর মধ্যে গণতন্ত্রের পূর্ণ প্রতিষ্ঠায় গলদ বা হেরফের রয়েছে, তারপরও যেটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে তাতেও জনগণের সন্তুষ্টি রয়েছে।

চার.
ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র, সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের যুথবদ্ধ অবস্থান ও বসবাসে যে আঘাত দিয়েছেন এবং অনৈক্য ও বিভাজন সৃষ্টি করেছেন, তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব এখন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের। ক্ষমতাসীন হয়েই যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রেখে একই ছাতার নিচে জনগণকে আনার কাজটি তাকে করতে হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ যে ট্রাম্পের বিভাজনের রাজনীতি, মানুষের মধ্যে ভেদাভেদের বর্ণবাদ নীতি এবং গণতন্ত্র পরিপন্থী শাসন ব্যবস্থা মেনে নেয়নি, তা তাকে নির্বাচিত করে বুঝিয়ে দিয়েছে। যদি তিনি ট্রাম্পের নীতিতে প্রভাবিত হন, তবে যুক্তরাষ্ট্রকে এক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন না। বরং ট্রাম্পের নীতিকে সমূলে উৎপাটন করে গণতান্ত্রিক ও বহুজাতির দেশের সুনাম অক্ষুন্ন রাখার ক্ষেত্রে তাকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে। জনগণের রায়ে ট্রাম্পের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয়েছে, মানুষ সবার আগে গণতন্ত্রকেই প্রাধান্য দেয়। ট্রাম্পের শাসন নীতিতে উৎসাহী হয়ে যেসব দেশের সরকার তা অনুসরণ করেছে, তাদের জন্যও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন থেকে শিক্ষা নেয়ার বিষয় রয়েছে। গণতন্ত্রে যে জনগণের রায়ই শেষ কথা, তা তাদের মানতে হবে। কর্তৃত্ববাদী কিংবা গণতন্ত্রের মোড়কে একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা যে জনগণ মেনে নেয় না এবং কোনো না কোনো সময় তাদের ক্ষমতা ছাড়তে ও বিচারের মুখোমুখি হতে হয়, ট্রাম্পের পরাজয় ও পরিণতি থেকে তাদের এ শিক্ষা নিতে হবে।
darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন