দুপুর ১২টা গ্রুপ স্টাডির জন্য মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ‘ও’ লেভেলের কিশোরী শিক্ষার্থীকে ফোন করে তার ছেলে বন্ধু। এরপর ১২টা ১২ মিনিটে ওই কিশোরী যথারীতি রাজধানীর কলাবাগানে বন্ধু দিহানের বাসায় গিয়ে হাজির। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর দুপুর ১টা ৩৬ মিনিটে বাসা থেকে বের হয় দিহানের গাড়ি। রক্তাক্ত অবস্থায় ওই কিশোরীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। অভিযোগ উঠেছে ধর্ষণের কারণেই মৃত্যু হয়েছে ওই কিশোরীর। ময়নাতদন্তকারি চিকিৎসক প্রাথমিকভাবে বিকৃত যৌনাচারকে মৃত্যুর কারণ হিসেবে দেখছেন। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নাঞ্চলে নৃশংসভাবে হত্যাসহ নানা অপরাধের ঘটনা বেড়েই চলছে। নির্মম নিষ্ঠুরভাবে স্বজনকে হত্যার পর নিজে আত্মহত্যা, পারিবারিককলহের কারণে স্ত্রী-সন্তানদের হত্যা করা, গৃহকর্মী নির্যাতন আর পথচারীকে গাড়িচাপা দেয়াসহ নানা অপরাধ এখন নিত্যদিন ঘটছে। অনেকেই আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ আইন তোয়াক্কা না করে অপরাধ করেই যাচ্ছেন।
অপরাধ ও সমাজ বিষেজ্ঞরা বলছেন, ঘটনার পর দ্রুত অপরাধী গ্রেফতার না হওয়া, বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা, সামাজিক বন্ধনের অনুপস্থিতি, ইন্টারনেটের অপব্যবহার, অসহিষ্ণুতা, মাত্রাতিরিক্ত ক্ষোভ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, নৈতকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের চিত্র ফুটে উঠছে একের পর এক লোমহর্ষক ঘটনায়। তুচ্ছ কারণে খুনের ঘটনা ঘটছে। এ সকল অপরাধের জন্য আইনের মাধ্যমে অপরাধীর দ্রুত এবং কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, বর্তমানে সমাজে যেসব ঘটনা ঘটছে, সেটা আমাদের সমাজের মূল চিত্র নয়। আমাদের সমাজের প্রতিটি পরিবারে একে অন্যের প্রতি সম্মান, সহযোগিতা, সহনশীলতা, ভালোবাসা আছে। এটা আমাদের সমাজের মূল চিত্র। এমনকি গ্রামের সাধারণ কৃষক ও দিনমজুর তাদের স্ত্রীকে অনেক ভালোবাসে। এটা আমাদের সমাজের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর বিপরীত দিক দেখা যায়। সামাজিকরণের জন্য এসব ঘটনা ঘটে থাকে। কারণ আমরা যেসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সামাজিকরণের হয়, সেই প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যর্থ হয়েছে। সেই প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবর্তিত সমাজের মধ্যে খাপ খাওয়াতে পারছি না। আমাদের মধ্যে কখনো কখনো হতাশার কাজ করে। কেউ কেউ স্বাভাবিক জীবনের মধ্যে থাকতে পারছে না। তবে সামাজিকরণের ত্রুটি দূর করতে পারলে, এ ধরনের অপরাধপ্রবণতা কমে যাবে বলে মনে করেন ঢাবির ওই শিক্ষক।
মর্গে আসা মৃত তরুণীদের লাশের সাথে যৌন আচরণের কারণে গত ১৯ নভেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গ থেকে এক ডোম সহকারীকে গ্রেফতার করে সিআইডি। এর আগে, গত বছরের ৬ অক্টোবর মানিকগঞ্জ থেকে এক কথিত সাধক শরিফুল ইসলামকে নিজের মেয়েকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগে গ্রেফতার করে সিআইডি।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালে প্রায় সাড়ে ৩ হজার নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৩১০ জন। আর ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৬০৭। সংস্থাটি বলছে, খুব মারাত্মক কিছু না ঘটলে বেশিরভাগ সময় পরিবারের সদস্যরাই বিষয়টি চেপে যায়। ফলে যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায় তা মোট ঘটনার একটি অংশ মাত্র।
ঢাকা মানসিক হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, সামাজিক অবক্ষয়, মূল্যবোধের অধঃপতনের কারণে বাড়ছে এমন ঘটনা। এসব ঘটনার পেছনে পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা এবং মাদকাসক্তিকেও দায়ী করেছেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, আমাদের দেশটা ছোট; কিন্তু জনসংখ্যা অনেক বেশি। আইন আছে, প্রয়োগ নেই, আইনের শাসন নেই। সব ধরনের আইন আছে; কিন্তু সেভাবে প্রয়োগ নেই। আইন প্রয়োগের সাথে যুক্ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সীমাবদ্ধতাও আছে। রাজনৈতিক প্রভাব আছে। এসব আইনের প্রয়োগ নেই বলে সমাজে বিশৃঙ্খলা হচ্ছে, সামাজিক নিরাপত্তা নেই। মূল্যবোধ নেই কোনো পেশাতে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈততিকভাবে প্রভাবশালীরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় সবকিছু।
তিনি আরো বলেন, মানুষের আচার-আচরণ তার বেড়ে ওঠার ওপর নির্ভর করে। পরিবার হচ্ছে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পিতামাতাকে সন্তানকে বয়স অনুপাতে বিভিন্ন বিষয় উপস্থাপন করতে হবে, যাতে ভালোমন্দ যাচাই করে চলতে পারে। এছাড়া বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত মূল্যবোধ চর্চার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলে এসব অপরাধ বন্ধ হবে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মায়ের হত্যাকারী বাবাকে পুলিশে দিয়েছে ছেলে। গত সোমবার রাজধানীর পল্লবী থানার উত্তর কালশীর সিরামিক কারখানায় সেলিনা খাতুনের সঙ্গে তার স্বামী রবিউল হোসেনের কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে রবিউল হোসেন তার স্ত্রীকে গলা কেটে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় তাদের বড় ছেলে রবিউলকে আটকে রাখে। পরে পুলিশ এসে তাকে গ্রেফতার করে রবিউলকে থানায় নিয়ে যায়। গত ৯ জানুয়ারি শনিবার দুপুরে রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার পূর্ব নাখালপাড়া এলাকায় রনি ইয়াসমিনের বাসায় এসে তাকে বিবাহবিচ্ছেদের নোটিশ প্রত্যাহার করে দুটি মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সংসারটি আবারো করার জন্য অনুরোধ করেন। এ সময় তার স্ত্রী শিমু তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। তখন রনি উত্তেজিত হয়ে শিমুকে গলাটিপে ধরেন। এতে তার মৃত্যু হয়। বোন ইয়াসমিন বাধা দিতে এলে তাকেও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন রিকশা চালক রনি। তাদের সংসাদে আদুরি নামের ১৩ বছরের এবং রোকসানা নামে চার বছরের দুই মেয়ে রয়েছে।
ইয়াসমিনের চাচা সায়েদ আলী জানিয়েছেন, রনি পেশায় একজন রিকশা চালক। তিনি জুয়া খেলতেন এবং নেশাও করতেন। ফলে তাদের সংসারে অশান্তি ছিল। বেশকিছু দিন আগে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন