মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ভ্যাকসিন কূটনীতিতে ভারতের চাতুর্য এবং বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২০ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

গত বছরের জানুয়ারিতে চীনের ওহানে প্রথম করোনাভারাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ার পর দ্রæততম সময়ে তা ইউরোপ-আমেরিকায় মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে সারাবিশ্বে মৃত্যুআতঙ্ক নিয়ে আসে। গত এগারো মাসে বিশ্বে প্রায় ১০ কোটি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। এদের মধ্যে ২০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি শাটডাউন, লকডাউন, স্বাস্থ্যবিধি পালন, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সীমিতকরণ, শারিরীক দূরত্ব অবলম্বন, গণপরিবহন এবং সামাজিক অনুষ্ঠানাদি সীমিত করার পরও কোনো দেশেই করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল থেমে যায়নি। এই শীতে ইউরোপের কোনো কোনো দেশে নতুন ওয়েভ ও নতুন স্ট্রেইন দেখা দেয়ার মাধ্যমে করোনা আতঙ্ক জেঁকে বসেছে। করোনা আতঙ্কের শুরুতেই বিশ্বের রোগতত্ত¡ গবেষকরা ২০২০ সালের শেষ নাগাদ করোনা ভাইরাসের একাধিক সফল ভ্যাকসিন উপহার দেয়ার ঘোষণা দেয়া সত্তে¡ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তরফ থেকে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে অন্তত ২-৩ বছর লেগে যাওয়ার আশঙ্কার কথা বলা হয়েছিল। ২০২০ সাল পেরিয়ে আমরা ২০২১ সালের জানুয়ারির প্রথমার্ধ অতিক্রম করেছি। ইতিমধ্যে বিশ্বের দেশে দেশে করোনা ভ্যাকসিনেশন শুরু হয়েছে। চীন ও ইউরোপ-আমেরিকার মতো দেশগুলোর পাশাপাশি ভারতসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেও ভ্যাকসিনেশন শুরু হয়েছে। গত এক বছর বিশ্বের অর্থনীতি যেমন কোভিড-১৯ দ্বারা সংক্রমিত-নিয়ন্ত্রিত ও স্থগিত হয়েছে, একইভাবে বিশ্বের রাজনীতি, বাণিজ্য ও কূটনৈতিক তৎপরতাও ছিল মূলত করোনাভাইরাসের চিকিৎসা, নিয়ন্ত্রণ এবং ভ্যাকসিনেশনের ভবিষ্যতকে ঘিরে। এটা তখনই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল, যে জাতি যত তাড়াতাড়ি কোভিড-১৯ মোকাবেলা করে নিজেদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড এবং সামাজিক ব্যবস্থা সচল ও নিরাপদ করতে পারবে সে জাতিই সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দৌড়ে এগিয়ে থাকবে। অন্যদিকে সম্ভাব্য করোনা ভ্যাকসিন উদ্ভাবন, ট্রায়াল এবং উন্নয়নের দৌড়ে এগিয়ে থাকা দেশগুলো করোনাভ্যাকসিনের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও কূটনৈতিক সাফল্য কাজে লাগানোর প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অন্তত ৯০টি প্রতিষ্ঠান করোনা ভ্যাকসিন আবিস্কারের ঘোষণা দিয়ে যার যার মতো তার উন্নয়ন ও বাজারজাতকরণের কর্মপন্থা বা গাইডলাইন ঠিক করে নেয়। এগিয়ে থাকা ভ্যাকসিনগুলোর মধ্যে চীনের সিনোভ্যাক, রাশিয়ার গ্যামালিয়া, অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার-বায়োএনটেকসহ বেশকিছু গবেষণা সংস্থা ও ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানীর সাফল্যের খবর বিশ্বে নতুন আশার সঞ্চার করে। ঠিক একই সময়ে বাংলাদেশের গেøাব বায়োটেক উদ্ভাবিত করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন পুরো জাতিকে কিছুটা আশার আলো দেখালেও সরকারের পক্ষ থেকে তেমন প্রত্যাশা, উৎসাহ বা সহযোগিতার ঘোষণা শোনা যায়নি। করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে বাংলাদেশের পরিকল্পনা, প্রকল্প, বাণিজ্য, কূটনীতি এবং আন্তর্জাতিক তৎপরতা কোনো এ এক রহস্যময় অস্বচ্ছতার বাতাবরণ লাভ করে।

বাংলাদেশকে ঘিরে দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক তৎপরতা ও টানাহেঁচড়ার খবর নতুন নয়। বিশ্বরাজনীতির নতুন মেরুকরণে ভারত-চীন, আমেরিকা-রাশিয়া ও ইউরোপ-মধ্যপ্রাচ্যে বিনিয়োগসহ ভবিষ্যতের কানেক্টিভিটি ও উন্নয়ন পরিকল্পনার পুরোভাগে চীনের আধিপত্য এখন অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় চীনের সাফল্য এবং ভ্যাকসিন উদ্ভাবন ও বাণিজ্যিক উৎপাদনে চীনের এগিয়ে থাকার বাস্তবতা এটাই মনে করিয়ে দেয়, আগামীর বিশ্বরাজনীতি-অর্থনীতির সম্ভাব্য প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চীন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় যারা এগিয়ে থাকবে, বিশ্ববাণিজ্য ও অর্থনীতিতেও তারা এগিয়ে থাকার পথ করে নিতে পারবে। অতএব, সমাজে করোনা ভাইরাসের বাস্তব প্রভাব যাই হোক, করোনাভাইরাস মোকাবেলা ও নিয়ন্ত্রণে বাহ্যিক ব্যবস্থা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও এগিয়ে চলার মূল অনুঘটক হয়ে উঠেছে। করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ ব্যবস্থা, চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণে স্বচ্ছতা ও আস্থাপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করা না গেলে করোনা সংক্রমণ দেশে যতই নিম্নমুখী এবং আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্বাভাবিক হোক, বিশ্ববাণিজ্য ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে তা তেমন কাজে নাও লাগতে পারে। করোনার শুরুতে দেশের হাসপাতালগুলোতে বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও জনভোগান্তির খবর তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। করোনা শনাক্তকরণ নিয়ে সরকারি মহলের মদদপুষ্ট একশ্রেণীর ডাক্তার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভুয়া সার্টিফিকেট বাণিজ্য এবং এ ধরণের হাজার হাজার সার্টিফেকেট নিয়ে বাংলাদেশী নাগরিকদের বিদেশ গমনের পর ধরা পড়া এবং ফেরত আসার পর বাংলাদেশের সাথে সব ধরনের ফ্লাইট বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিল কয়েকটি দেশ ও এভিয়েশন সংস্থা। করোনা পরিস্থিতি ‘নিউ নরমাল’ ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পুনরায় শুরু হলেও বাংলাদেশিদের জন্য সেসব নিষেধাজ্ঞা এখনো বহাল আছে। এর সাথে বাংলাদেশের করোনা মোকাবেলা ও ভ্যাকসিনেশন নিশ্চিত করার সাথে রাষ্ট্রের সামাজিক-অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক স্বার্থসহ বহুমাত্রিক স্বার্থ জড়িত। এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়লে জাতি পিছিয়ে পড়বে, এটা প্রায় নিশ্চিত। করোনাভাইরাস মহামারীর শুরুতে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনার কারণে অনেক বড় হোঁচট খেলেও প্রথম ধাক্কা সামলে নিয়ে করোনাভাইরাস মোকাবেলা ও স্বাস্থ্যসেবার প্রায় প্রতিটি ধাপেই বাংলাদেশের উদ্ভাবক ও উদ্যোক্তারা জাতিকে আশার আলো দেখাতে সক্ষম হয়েছিল। স্বল্প সময়ে স্বল্পমূল্যে বিশ্বমানের স্যানিটাইজার, মাস্ক, পিপিই, ওষুধ, কিট, ভেন্টিলেটরসহ যাবতীয় সরঞ্জামাদি তৈরি করে এক্ষেত্রে একটি আত্মনির্ভরশীল অবস্থানই তৈরি করেনি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এসব সরঞ্জাম রফতানি করেও নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার পথ নির্মান করেছে। সেসব সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্ভাবিত করোনা শনাক্তকরণ কিট এবং গেøাব বায়োটেকের ভ্যাকসিন নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টদের সিদ্ধান্তহীনতা, অস্বচ্ছ ভূমিকা এবং অবহেলা না থাকলে এবং করোনা মোকাবেলায় সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার সামন্য অংশও যদি এ খাতে দেয়া হতো, তাহলে দেশের সামর্থ্য ও ভাব-মর্যাদা অনেক উপরে থাকতো।
করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন নিয়ে আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত , বাণিজ্য ও অংশীদারিত্বের চুক্তি চলমান বিশ্বব্যবস্থায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক-বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক নিয়ামক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ খুবই সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। বাংলাদেশ নিয়ে চীন-ভারতের ঠান্ডা লড়াইয়ে চীন বাংলাদেশকে তার অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছিল। করোনাভাইরাসের শুরুতে দিশাহারা অবস্থায় চীনা সরঞ্জাম সহায়তা ও বিশেষজ্ঞ দলের উপস্থিতি এক্ষেত্রে অনেক বড় শুভেচ্ছার নিদর্শন। সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিশ্চিত করতে ট্রায়ালে অংশগ্রহণের চুক্তিও করেছিল বাংলাদেশ। এরপরই নানা টালবাহানা শুরু হয়। প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে দেশের রাজনীতি ও প্রশাসনের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে বসে একটি ভারতীয় দালালচক্র চীনের ভ্যাকসিন ঠেকাতে আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্তহীনতার নেতিবাচক পথ গ্রহণ করে। চীনা ভ্যাকসিন ঠেকাতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রীংলা ঝটিকা সফরে বাংলাদেশে আসেন। অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের ভারতীয় অংশীদার সেরাম ইনস্টিটিউটের ভ্যাকসিন নিয়ে ভারত যে কূটনৈতিক দাবাখেলায় লিপ্ত হয়, তার প্রধান টার্গেট ছিল সম্ভবত বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ছাড়া উপমহাদেশের আর কোনো দেশ ভারতের পাতা ভ্যাকসিন ফাঁদে পা দেয়নি। ভারতের ভ্যাকসিন আলোর মুখ দেখার আগেই বাংলাদেশে চীনা ভ্যাকসিনের সফল প্রয়োগ ঠেকাতে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের উপর যে চুক্তি চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল, তা ছিল অনেকটাই প্রতারণাপূর্ণ। বেক্সিমকোর সাথে চুক্তিবদ্ধ ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের নাকি ভ্যাকসিন রফতানি করার বৈধ কোনো কর্তৃত্বই নেই। তবে ভারতের পররাষ্ট্রসচিবসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল যখন দু’দেশের তথাকথিত বন্ধুত্বের সম্পর্কের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ভারত এবং বাংলাদেশে টিকা কার্যক্রম একই সাথে শুরু হবে, তখন আমাদের সরকারের অসহায় ও ভারত বশংবদ মন্ত্রী-আমলারা সে কথা বিশ্বাস করে তাদের উপর আস্থা রেখেছিলেন। গত সপ্তাহে যখন ভারত-বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ভ্যাকসিন রফতানিতে নিষেধাজ্ঞার কথা প্রকাশিত হয়, দেশের মানুষ যখন রাগে, ক্ষোভে, ঘৃণা-ধিক্কারে প্রতিবাদ করছিল, তখনো আমাদের মন্ত্রী-আমলাদের কেউ কেউ ভারতের উপর আস্থা রাখার কথা বলেছেন। যথারীতি ভারত তার কথা রাখেনি। ভারতে গত সপ্তাহে করোনা ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রাম শুরু হলেও বাংলাদেশ সরকার বিশ্বের প্রায় সর্বোচ্চ মূল্যে ভ্যাকসিন কেনার চুক্তি করে অগ্রিম ৬০০ কোটি টাকা সেরাম ইনস্টিটিউটের ফান্ডে পাঠিয়ে দিলেও এখনো ভ্যাকসিনের প্রথম চালান নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হয়নি।

ভারত কি বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র মনে করে, বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্ব ও সুসম্পর্কের ক্ষেত্রে নিজের দায়-দায়িত্বে বিশ্বাস করে? যত দিন যাচ্ছে ততই বেশি সংখ্যক মানুষের মনে এ প্রশ্ন আরো প্রগাঢ় হয়ে দেখা দিচ্ছে। নামকাওয়াস্তে গঙ্গার পানি চুক্তি করে পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করা, বছরের পর বছর ধরে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে না বসা, তিস্তা চুক্তি নিয়ে বছরের পর বছর ধরে আশ্বাসের মূলা ঝুলিয়ে রাখা, গঙ্গা ব্যারাজ, তিস্তা ব্যারাজ নিয়ে বাংলাদেশের আত্মরক্ষামূলক প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারতের প্রতিবন্ধকতা, প্রায় প্রতিদিন সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিবর্ষণ, বাংলাদেশি পণ্যের উপর ভারতের এন্টি-ডাম্পিং ট্যারিফ ব্যারিয়ার, ভারতের সাথে সীমান্ত বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল নিত্যপণ্যের উপর যখন-তখন নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে বাংলাদেশের ভোক্তাদের বিপদে ফেলা এবং অসময়ে বাংলাদেশে ভারতীয় কৃষিপণ্য ঢুকিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের কৃষকদের ক্ষতিগ্রস্ত করার সাক্ষী ও ভুক্তভোগী এ দেশের জনগণ ভারতের কোনো প্রতিশ্রæতিতে বিশ্বাস রাখতে পারেনা। তিস্তার পানিবন্টন চুক্তি নিয়ে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অনেকবার প্রতিশ্রæতি দিলেও বাংলাদেশকে পানি বঞ্চিত করে দেশকে মরুভূমিতে পরিনত করার চক্রান্ত অব্যাহত রেখেছে। ভারতের পানি আগ্রাসনে বিশ্বের বৃহত্তম গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো নাব্য হারাচ্ছে। সদ্য শুকিয়ে যাওয়া নদীবক্ষে সবুজ ফসলের হাতছানি বেশি দিন থাকে না। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার পাশাপাশি অনাবৃষ্টিতে এসব ভূপ্রকৃতি বালুময় ঊষর মরুভূমিতে পরিনত হবে। তখন বাংলাদেশে ফসলহানি ও চরম খাদ্য ঘাটতি দেখা দিলে দুর্ভিক্ষ এবং ভারতের বাণিজ্যিক মুনাফাবাজির চরম শিকারে পরিনত করা ভারতের পক্ষে সহজ হবে। একের পর এক উজানে বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশকে যৌথ নদীর পানি থেকে বঞ্চিত করার এটাই কি তাদের নেপথ্য অভিসন্ধি? দেশপ্রেমিক সচেতন মহলকে এই আশঙ্কা মাথায় রেখেই এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে হবে।

কোভিড-১৯ নিয়ে চীন-মার্কিন বেøইম গেম শেষ হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পালাবদলের পর জো বাইডেন প্রশাসনের ভূমিকা কোথায় দাঁড়ায় তা দেখার অপেক্ষা এখন। তবে বিশ্বের সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর পোস্ট-কোভিড পরিস্থিতি অনেক বড় প্রভাব রাখবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বের কর্পোরেট ফার্মা কোম্পানি ফাইজার-বায়োএনটেক, অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকার প্রতিযোগিতা ছাপিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে চীনের সিনোভ্যাক এবং ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কূটনৈতিক রশি টানাটানিতে চীন নি:সন্দেহে এগিয়ে আছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ শুধু করোনা মোকাবেলা এবং অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়েনি, সেই সাথে রোহিঙ্গা সংকটের মত বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে চীনকে আরো হার্ডলাইনে ঠেলে দেয়া হয়েছে। যদিও চীন শুরু থেকেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষে রয়েছে। তবে এই ইস্যুর একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রস্তাবেও চীনের সাড়া পাওয়া গেছে। করোনাভ্যাকসিনের অগ্রাধিকার ভিত্তিক প্রাপ্তির প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকার টিকা তৃতীয় পক্ষ ভারতের কাছ থেকে অনেক বেশি দামে কেনার চুক্তি করে প্রতারিত হওয়ার পর চীন তার কৌশলগত মিত্র মিয়ানমারের সাথে আরো ঘনিষ্ট যোগাযোগ রক্ষা করছে। এ সপ্তাহে চীনের ভ্যাকসিন কূটনীতির অংশ হিসেবে চীন সরকারের প্রতিনিধিরা মিয়ানমারসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো চীনা ভ্যাকসিনের চুক্তি করেছে। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, নেপাল, ভূটান, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, ফিলিপাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশকিছু দেশ চীনা ভ্যাকসিনের সরবরাহ নিশ্চিত করে তাদের ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রামের শিডিউল ঠিক করেছে। ভ্যাকসিন কূটনীতি ও বাণিজ্যের সিরিজ সফরে গিয়ে চীনা পররাষ্ট্র দফতরের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে চীন। বাংলাদেশ যদি চীনা ভ্যাকসিনের প্রস্তাবে সাড়া দিতে পারত, তাহলে এই সিরিজ সফরে বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত হতো। সেক্ষেত্রে চীনা প্রতিনিধিরা রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারকে এমন প্রকাশ্য পাশে থাকার ঘোষণা হয়তো দিত না। চীন-ভারত বিরোধে ইউরোপের দেশগুলো দ্বিধাবিভক্ত হলেও মার্কিন প্রভাবাধীন পশ্চিমা বিশ্ব ভারতের পক্ষে নীরব সমর্থন দিচ্ছে। একইভাবে রোহিঙ্গা সংকট প্রশ্নেও তারা বাংলাদেশের পক্ষে লিপ সার্ভিস যেমন দিচ্ছে, পাশাপাশি জাতিসংঘের ভোটাভুটিতেও তারা মিয়ানমারের বিপক্ষে ভোট দিচ্ছে। কিন্তু ভারতের ভূমিকা কখনো বাংলাদেশের পক্ষে যায়নি। তারা একদিকে বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বের অনন্য উচ্চতার বয়ান দিচ্ছে, আবার রোহিঙ্গা গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে মিয়ানমারকে সমর্থন করছে। বঙ্গোপসাগরের বøু-ইকোনমির নিরাপত্তায় চীন যখন বাংলাদেশকে সাবমেরিন দিয়েছিল, তখন ভারতের প্রতিক্রিয়া ছিল বিস্মিত হওয়ার মতো। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেই থেমে থাকেনি, সাবমেরিন দিয়ে সহায়তা করে মিয়ানমারের নৌশক্তি বৃদ্ধি করার পাল্টা ত্বরিৎ ব্যবস্থা নিয়েছিল। এই হচ্ছে বাংলাদেশের সাথে ভারতের বন্ধুত্বের নমুনা।


গত এক দশকে চীনের হাজার হাজার কোটি ডলারের বিনিয়োগ এবং উন্নয়ন সহায়তার পথ ধরে পদ্মাসেতুসহ বাংলাদেশ তার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ট্রাডিশনাল উন্নয়ন সহযোগী দেশ জাপানের ভূমিকাও অনেক। মাতারবাড়ি বিদ্যুতকেন্দ্র এবং সমুদ্রবন্দরে জাপানি বিনিয়োগ দেশের অন্যতম অগ্রসরমান মেগা প্রকল্প। অন্যদিকে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা ও বাংলাদেশকে নিজের প্রভাব বলয়ে রাখতে এবং বাংলাদেশের কাছ থেকে বিনা পয়সায় ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট, বন্দর ও অবকাঠামো ব্যবহারের সুযোগ পেতে বিভিন্ন প্রকল্পে কয়েক বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তার সমঝোতা চুক্তি করলেও গত একযুগে তার ১০ ভাগও পূরণ করেনি। অর্থাৎ বাংলাদেশকে বড় ঋণ সহায়তা দেয়ার মুলা ঝুলিয়ে এখানেও চাতুর্যের আশ্রয় নিয়েছে ভারত। ভারতের ক্ষমতাসীনরা শুরু থেকেই তাদের বাংলাদেশ বিরোধী অবস্থান প্রকাশ করে আসছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনীর আইনের নামে সেখানকার মুসলমান নাগরিকদের রাষ্ট্রহীন নাগরিকে পরিনত করা এবং বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছিল বিজেপি নেতারা। চার দশক আগে আশির দশকের শুরুতে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইনে রাখাইনের রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বহীন করে দেয়ার মধ্য দিয়ে যে সংকটের সৃষ্টি করা হয়েছিল, মিয়ানমার বাহিনীর গণহত্যার মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশের জন্য এক দুর্বহ বোঝা হয়ে উঠেছে। বিশ্ব সম্প্রদায় এ বিষয়ে বাংলাদেশের পাশে থাকলেও ভারতের ভূমিকা রহস্যময়। নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন এনে ভারতীয় বাঙ্গালী মুসলমানদেরকে মিয়ানমারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে তারা ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা সংকটের মত আরেকটি কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির দূরভিসন্ধি করছে বলে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। সে প্রসঙ্গটি এখন আলোচনায় না আসলেও করোনা পরিস্থিতি উত্তরণের পাশাপাশি আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারসাম্যপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হলে ভ্যাকসিন ডিপ্লোম্যাসিতে পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশ কিভাবে ক্ষতি কাটিয়ে উঠে সামনে এগিয়ে যাবে সেদিকেই এখন আমাদের মনোযোগ নিবদ্ধ হওয়া জরুরী। নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য হলেও ভারত জানুয়ারী মাসের মধ্যেই করোনা ভ্যাকসিনের প্রথম চালান পৌঁছে দিক ভারত। সরকারের সংশ্লিষ্টদের সাথে আমরাও এই প্রত্যাশা রাখতে চাই।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Jack+Ali ২০ জানুয়ারি, ২০২১, ১১:৫২ এএম says : 0
Why we cannot invent our own vaccine??????? because our government is Dumb/Deft and Blind.. In the past muslim was super power and also they the best in science and technology because they used rule by the Law of Allah.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন