বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

৪২ শতাংশ মানুষ এখনও গরিব

দারিদ্র্য ও জীবিকার ওপর কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব শীর্ষক জরিপের ফলাফল প্রকাশ

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৪ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০০ এএম

করোনার প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার (আপার পোভার্টি রেট) বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ। দেশব্যাপী খানা পর্যায়ের জরিপেরভিত্তিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে। নিজেদের অর্থায়নে এই জরিপ পরিচালনা করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২০ সালে দ্বিগুণ বেড়েছে দারিদ্র্যের হার। আর অতি দরিদ্রের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ২৮ ভাগে। সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্যের হার রংপুর বিভাগে।
বিবিএসের খানা জরিপ অনুসারে, ২০১৬ সালে দেশের গ্রামাঞ্চলের সার্বিক দারিদ্র্য ছিল ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ, ২০১৮ সালের জিইডি-সানেম জরিপ অনুসারে যা ছিল ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু করোনার প্রভাবে ২০২০ সালে এই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশ। শহরাঞ্চলে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ২০১৬ সালে ছিল ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০১৮ সালে ছিল ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ আর করোনার সময়ে ২০২০ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ। দারিদ্র্য ও জীবিকার ওপর কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব শীর্ষক এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে গতকাল শনিবার এই জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
জরিপের আরেকটি উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো, ২০২০ সালে দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে রেমিট্যান্স বা প্রবাসীয় আয়ের ব্যাপক প্রবৃদ্ধি হলেও ব্যক্তিক পর্যায়ে তা বরং কমে গেছে। কারণ হিসেবে বলা হয়, অনানুষ্ঠানিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবাসী আয় এসেছে। এতে বিনিময় হার কমে গেছে। ৮২ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ পরিবার বলেছে, দেশের বাইরে থেকে আসা প্রবাসী আয় কমেছে। একই ক্ষেত্রে আগের মতো আছে বলেছে ১৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ পরিবার। ফলে প্রবাসী আয়ের প্রভাব সমাজে অতটা অনুভূত হয়নি, যতটা বলা হয়েছে, সে তুলনায়।
জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন সানেমের গবেষণা পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, জরিপ পরিচালনার খরচ আছে। তবে তহবিল পাওয়া না গেলেও সানেম নিজস্ব অর্থায়নে জরিপটি পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। তার ভাষ্যমতে, এটা না হলে আমরা একটি পরিপ্রেক্ষিত হারিয়ে ফেলতাম। সেই তাড়না থেকেই এই জরিপ। দারিদ্র্য, অসমতা ও কর্মসংস্থানএই তিনটি ক্ষেত্রে কোভিডের প্রভাব নিরূপণ করা হয়েছে বলে জানান সেলিম রায়হান।
জরিপের ফলাফলে বলা হয়, করোনার প্রভাবে দারিদ্র্যের কারণে মানুষ খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খেয়েছেন, ঋণ নিয়েছেন, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনেছেন। আবার জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ পরিবার বলেছে, তারা খাপ খাওয়ানোর পথই খুঁজে পায়নি। ২০১৬ সালে দেশের গ্রামাঞ্চলের সার্বিক দারিদ্র্য ছিল ২৬.৪%, ২০১৮ সালের জিইডি-সানেম জরিপ অনুসারে যা ছিল ২৪.৫%। কিন্তু করোনার প্রভাবে ২০২০ সালে এই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫.৩%। আর এই দারিদ্র্যের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে অসমতায়। ভোগের ক্ষেত্র জিনিসসহ দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৩৩। অথচ ২০১৮ সালে সানেম ও জিইডির আরেক জরিপে দেখা গিয়েছিল, এর মান শূন্য দশমিক ৩১। ২০১৬ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুসারে এটি ছিল শূন্য দশমিক ৩২। দারিদ্র্যের আরেকটি ফল হলো, শিক্ষাগ্রহণ ব্যাহত হওয়া। জরিপে দেখা গেছে, ২০১৮ ও ২০২০ সালের মধ্যে মাথাপিছু গড় শিক্ষাব্যয় কমেছে। অতিদরিদ্র পরিবারের জন্য এই হার হ্রাস সবচেয়ে বেশি ৫৮ শতাংশ। পাশাপাশি অনলাইন শিক্ষায় দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণও কম।
জরিপের ফলাফল নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, দারিদ্র্য পরিমাপ করা হয় সাধারণত ভোগ দিয়ে। কিন্তু দারিদ্র্য যে বহুমুখী ধারণা, যেমন শিক্ষা ও চিকিৎসায়ও এর প্রভাব দেখা যায়, সানেমের জরিপ এই প্রথম এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিচ্ছে।
জাহিদ হোসেন বলেন, শিক্ষাদারিদ্র্য বেড়েছে, শিক্ষায় ব্যয় কমেছে, বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থায় বেশির ভাগই অংশ নিতে পারছে না এমনকি বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা আগের শিক্ষাব্যবস্থার তুলনায় কতটা কম কার্যকর, সেটিও জানতে পারলে আরও ভালো হতো।
২০২০ সালে দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে রেমিট্যান্স বা প্রবাসীয় আয়ের ব্যাপক প্রবৃদ্ধি হলেও ব্যক্তিক পর্যায়ে তা বরং কমে গেছে। জাহিদ হোসেন বলেন, পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয়-ব্যয় জরিপে দারিদ্র্য যেভাবে পরিমাপ করা হয়, খাদ্য ও অন্যান্য ভোগের তথ্য যেভাবে আলাদা পদ্ধতিতে সারা বছর ধরে সংগ্রহ করা হয়, সানেমের জরিপে সেই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়নি। সে জন্য তিনি মনে করেন, এই দুই জরিপের তথ্য তুলনা করা ঠিক নয়।
২০১৮ সালের সাথে গত বছর দেশে দারিদ্য এবং জীবিকার সাথে তুলনামূলক গবেষণা করেছে সানেম। গবেষণায় উঠে এসেছে ২০২০ সালে করোনার প্রভাবে দেশে দারিদ্র্যের হার দ্বিগুন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ ভাগে। মহামারিতে কাজ হারানো, পারিশ্রমিক না পাওয়া, কর্মক্ষেত্র বন্ধ হওয়াসহ বিভিন্ন কর্মসংস্থান-সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে অনেকেই। এতে করে আয় কমায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং খাদ্য বহির্ভূত খাতে ব্যয় কমেছে ব্যপক হারে। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং-সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান জানান, সানেমের হিসেবে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যে বেতন কমেছে প্রায় ২৪ ভাগ চাকরিজীবীর। এছাড়া আয় কমেছে ২৯ ভাগ শ্রমিকের ও ৩২ ভাগ উদ্যোক্তার।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড.ফাহমিদা খাতুন, করোনার প্রভাবে বেড়েছে দরিদ্রতা এবং আয় বৈষম্যও। এই হার কমানো না গেলে দেশ দারিদ্র্য বিমোচনের অর্জন থেকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়বে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মাহবুবুল মোকাদ্দেম জানান, দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনতে করোনা মোকাবিলা, নগদ লেনদেন কমানোসহ সামাজিক সুরক্ষা বৃদ্ধি, পণ্যের দাম সহনীয় রাখা, দুর্নীতি কমানো এবং কর্মসংস্থান তৈরি করা প্রয়োজন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন