নদী থেকে আহরিত নুড়ি পাথরে জীবিকা নির্বাহ করছে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার মহানন্দা তীরবর্তী বাসিন্দারা। পাড়ে বিছানো নানা আকারের পাথরই তাদের জীবিকার প্রধান উৎস।
সর্ব উত্তরের উপজেলার সীমান্তে অবস্থিত এই নদীটি। বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টের পশ্চিম দিক দিয়ে ভারত থেকে এসে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ৩২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পুরাতন তেঁতুলিয়া বাজারের দক্ষিণ দিক দিয়ে আবারও ফিরে গেছে ভারতে। বাংলাদেশ-ভারত সীমানা নির্ধারণ করেছে এই নদী। নদীর মধ্যস্থল থেকে পূর্বে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমে ভারত রয়েছে। যুগ যুগ ধরে মহানন্দা নদী থেকে নুড়ি পাথর তুলছেন এখানকার পাথর শ্রমিকরা। এই পাথর বিক্রি করেই সংসার চলে তাদের।
বর্ষায় ভারত থেকে আসা পানিতে দুই ক‚ল ছাপিয়ে আবাদি জমি তলিয়ে যায়। বর্ষা মৌসুমের পর প্রায় সারা বছরই খরস্রোতা থাকে এই নদীটি। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে মহানন্দা বয়ে আনে প্রচুর ছোট-বড় পাথর। নদীর পানি কমে গেলেই শ্রমিকেরা দল বেঁধে নেমে পড়ে নুড়ি পাথর তুলতে। তাদের কাছে জীবন মানেই এই পাথর। যত বেশি পাথর তুলতে পারবেন তত বেশি মজুরি। এতেই তাদের ভালো থাকার সম্ভাবনা।
পাথরের খোঁজে প্রথমে লোহার সরু রড নদীর বুকে দাবিয়ে দিয়ে পরীক্ষা করা হয়। যেখানে রড আটকে যায় সেখানে গর্ত করে পানিতে ডুবে পাথর জালির ভিতরে দেয়। বড় লোহার চাকতি বসানো হয় গাড়ির চাকার টিউবের ভেতর। বিশেষভাবে তৈরি এ ভেলায় নদীর মাঝখান থেকে উত্তোলিত হয় পাথর। সেই ভেলা পাথর বয়ে নিয়ে আসে পাড়ে। পাড়ে তারের জালির কাঁচানি দিয়ে টুকরিতে উঠান শ্রমিকেরা। এর আগে পানিতে নেড়ে-চেড়ে যতটুকু সম্ভব বালিমুক্ত করা হয়।
সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, মহানন্দা নদীপাড়ের বাংলাবান্ধা, পাগলিডাঙ্গী, স›ন্যাসীপাড়া, উকিলজোত, খয়খাটপাড়া, ইসলামপুরসহ আশপাশের প্রায় ৪০টি গ্রামের মানুষের জীবন-জীবিকা এই পাথরের উপর নির্ভর। কঠিন পাথরের সঙ্গেই বাঁধা এই মানুষগুলোর জীবন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা খাটুনির পর একজন শ্রমিক ২০-২৫ সিএফটি পাথর তুলতে পারেন। কখনো কম হয়। গড়ে দিনে মুজুরি পড়ে ৫০০-৭০০ টাকা। সন্ধ্যায় মহাজনের কাছে বিক্রি করা টাকায় অর্থ আহারে জোটে স্ত্রী-সন্তান পরিবার-পরিজনের। এই পাথরই জড়িয়ে গেছে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের জীবন।
শ্রমিকদের সাথে কথা হলে তারা জানান, খুব ঝুঁকি নিয়ে তাদের পাথর তুলতে হয়। জীবিকার এই লড়াইও নিরবচ্ছিন্ন থাকে না ওপারের বিএসএফ। সীমান্ত টহলদার বাহিনী বিএসএফ এর বাঁধা, কখনো মারধরের ঘটনাও ঘটে। আর তখনই থমকে যায় শ্রমিকদের জীবিকা নির্বাহের পথ। তেঁতুলিয়ায় নেমেই চোখে পড়ে নানা আকৃতির পাথরের স্তূপ। পাশে পাথর ভাঙার যন্ত্র। সমানতালে কাজ করছে নারী -পুরুষ মিলে। বিকট শব্দে যন্ত্রগুলোতে পাথর ভাঙা চলছে। মনে হয়, শান্ত প্রকৃতির মধ্যে যেন দানবের চিৎকার চলছে।
ভাঙা পাথরগুলো চাহিদা অনুযায়ী ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতে ক্রমাগত ছুটে চলছে বহু ট্রাক। ট্রাকে করে পাথর পৌঁছে দেয়া হয় ক্রেতার কাছে। ঢাকা ও পঞ্চগড়সহ সারাদেশ থেকেই পাথর ব্যবসায়ীরা এখান থেকে পাথর সংগ্রহ করেন। সিরাজগঞ্জ থেকে পঞ্চগড়ে পাথর নিতে আসা আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, প্রতি সিএফটি পাথর সিরাজগঞ্জে পৌঁছানো খরচ পড়ে ১৪৩ টাকা।
ইসলামপুর গ্রামের পাথর শ্রমিক আমজাদ হোসেন বলেন, পাথর তুলে আয় করে চলে পরিবারের খাদ্য-বস্ত্রসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা। কখনো কখনো পাথর তোলা বন্ধ হয়ে গেলেই পরিবারে নেমে আসে দূর্ভোগ। একই কথা বলেন, শ্রমিক আকবর আলী, জাহাঙ্গীর, মুসা, করিমসহ অনেকেই।
তেঁতুলিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মাহামুদুর রহমান ডাবলু জানান, দুই সীমান্তের বুক চিরে প্রবাহিত নদী, মহানন্দায় হাজার হাজার পাথর শ্রমিক, নুড়ি পাথর তুলে জীবন নির্বাহ করছে। মহানন্দার তীরে দাঁড়িয়ে যেমন উপভোগ হয়েছে হিমালয়-কাঞ্চনজঘা দেখার। তেমনি নদীর বুকে দলবেঁধে শ্রমিকদের পাথর উত্তালনের দৃশ্য পর্যটকদের মনোমুগ্ধকর অনুভ‚তির।
ভ‚গোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষক ও পঞ্চগড় রকস মিউজিয়ামের তত্ত্বাবধায়ক গোলাম কিবরিয়া জানান, মহানন্দা নদীর বুকে নুড়ি পাথর তুলে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছে হাজারও শ্রমিক। ওপারের বন্দুক তাক করা ঝুঁকি নিয়ে, জীবন জীবিকা নির্বাহের জন্য পাথর তুলছে শ্রমিকরা । এই মহানন্দা নদীতে যেন নির্ভরে পাথর তুলতে পারে, তাদের জন্য সরকারের সহায়তার হাত প্রসারিত করা উচিত। এখানকার বালু আর সিলিকা বালিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারলে বদলে যেতে পারে অর্থনীতির চাকা। তাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে হাজার হাজার বেকারের।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন